কৃষি ও কৃষক ডেস্ক: দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। হেমন্তের শুরু থেকেই গ্রামীণ প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা বইছে। ঝিনাইদহের প্রকৃতিতেও সাড়া ফেলেছে হেমন্ত। আসন্ন শীতে খেজুরের রস ও গুড় তৈরির প্রস্তুতি শুরু করেছেন গাছিরা। জেলার গ্রামে গ্রামে চলছে খেজুর গাছের পরিচর্যা। খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। গাছিরা জানান, গাছের সংখ্যা কমে গেলেও তাদের রস সংগ্রহের চেষ্টা থেমে নেই।
বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামে গ্রামে চলছে খেজুর গাছ প্রস্তুত করার কাজ। রাস্তার ধারে কিংবা জমির আইলে থাকা খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। ভোর হলেই ঠুঙ্গি, বাইলধারা, দড়ি, গাছিদা হাতে ছুটছেন তারা। ধারালো দা দিয়ে নিপুণ হাতে খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার করছেন। মাথা পরিষ্কার করার পর গাছগুলোকে দুই সপ্তাহের বিশ্রাম দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে শীতে খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির মহাযজ্ঞকে ঘিরে কৃষকের চোখেমুখে স্বপ্নের হাতছানি।
সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের গাছি আনিছুর রহমান বলেন, ‘কার্তিক মাসের শুরু থেকে খেজুর গাছ তোলার (রস সংগ্রহের উপযোগী করা) কাজ শুরু করি আমরা। এক সপ্তাহ পর থেকে খেজুরের রস পাওয়া যাবে।’
মজিবার রহমান বলেন, ‘আমি প্রায় ৪৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটি। রস ও গুড় বিক্রি করে শীত মৌসুমে ভালো আয় হয়। এখন নতুন গাছি আর পাওয়া যায় না। কেউ এসব কাজে আসতে চান না। খেজুর গাছও কমছে, গাছিও হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ঝিনাইদহের ঐতিহ্য খেজুর রস, গুড় ও গাছি সবই হারিয়ে যাবে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খেজুর গুড় ও রসের ঐতিহ্যের অন্যতম ভাগিদার ঝিনাইদহ। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ুর কারণে ঝিনাইদহ অঞ্চলে খেজুর গাছ ভালো জন্মে। জেলা থেকে প্রতি বছর অন্তত ৮০০ থেকে ৮৫০ টন খেজুর গুড় উৎপাদন করা হয়।
প্রাকৃতিক ও নিরাপদ উপায়ে গ্রামের গাছিরা এসব গুড় তৈরি করেন। কাঁচা রসের জনপ্রিয়তাও ব্যাপক। সারাদেশে খেজুর গুড়, রস ও পাটালির ব্যাপক চাহিদা। ঝিনাইদহ অঞ্চল থেকে এসব রস, গুড় ও পাটালি সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য বলছে, বর্তমানে জেলায় ১ লাখ ৪২ হাজার ২৩৫টি খেজুর গাছ আছে। রস আহরণযোগ্য গাছের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার ৭৬০টি। বাকি গাছগুলোর মধ্যে কিছু চারা গাছ। কিছু গাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করেন না। শীত মৌসুমে জেলায় ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ২৪১ লিটার খেজুর রস ও ৮৭২ মেট্রিন টন খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। জেলার মধ্যে কোটচাঁদপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ৪৭ হাজার ৮৫৩টি খেজুর গাছ আছে।
কোটচাঁদপুর ইউনিয়নের সাবদারপুর গ্রামের আনজের বিশ্বাস বলেন, ‘খেজুর গুড়ের স্বাদ সবচেয়ে মিষ্টি। শীত এলেই শহর-গ্রামের মানুষ খেজুরের রস ও গুড় নিতে আমাদের কাছে আসে। এগুলো গ্রাম-গঞ্জের ঐতিহ্য। দেশের ঐতিহ্য। যেভাবেই হোক এগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ বছর এখনো রস সংগ্রহ শুরু হয়নি। গাছ পরিচর্যার কাজ চলছে। দুই-এক সপ্তাহের ভেতরেই রস সংগ্রহ শুরু হয়ে যাবে।’
সদর উপজেলার বারকোদালিয়া গ্রামের গৃহবধূ আছিয়া বেগম বলেন, ‘আগে অনেক রস হতো। এখন গাছ কম, রসও কম। খেজুরের রস জ্বালানোর বাইন (বড় চুলা) ঠিকঠাক করা হয়েছে। আমরা গ্রামের মানুষ। এসব করেই সংসার চালাতে হয়। খেজুরের রস, গুড় ও পাটালি বিক্রি করে বছরের এ সময়ে আমাদের একটু বাড়তি রোজগার হয়।’
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘নিরাপদ উপায়ে খেজুর রস সংগ্রহ, গুড় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে গাছিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের পরিকল্পনা আছে। ইক্ষু গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমরা যোগাযোগ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘গত বছর তাদের মাধ্যমে জেলার অসংখ্য গাছিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। এবারও চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ বছর খেজুর গুড়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৯০০ মেট্রিক টন। এরই মধ্যে জেলার সব এলাকায় গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করে ফেলেছেন। আগামী সপ্তাহ থেকে রস সংগ্রহ শুরু হয়ে যেতে পারে।’
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

























