ইয়াহিয়া নয়ন
বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়েছে বলে ২৪ সালের অক্টোবরে মন্তব্য করেছেন, বিশ্ব জরিপ সংস্থার মুখপাত্র সাইয়্যিদ মুহম্মদ আকতার ই-কামাল। তিনি বলেন, বিগত ২৭ বছরে জনসংখ্যার একই হিসাব দেয়া হচ্ছে। এর পেছনে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও। ২৪ সালের ১৬ অক্টোবর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার নতুন এই চিত্র প্রকাশ করে বিশ্ব জরিপ সংস্থা।
আকতার ই-কামাল বলেছেন, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি। এরপর থেকে বিগত ২৭ বছরে জনসংখ্যার একই হিসাব দেয়া হচ্ছে। তারপর প্রত্যেক সরকারই বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রকৃত সংখ্যা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে। এর পেছনে সরকারের পাশাপাশি কাজ করেছে বিভিন্ন এনজিও। দেশের জনসংখ্যা কমাতে বিদেশি দাতা সংস্থা কর্তৃক দেয়া তহবিলের সঠিক ব্যবহার হয়েছে এটা প্রমাণ করাই ছিল জনসংখ্যা কম দেখানোর আসল উদ্দেশ্য। জনসংখ্যা কমানো যায়নি বা জনসংখ্যা বেশি দেখালে বিদেশি তহবিল আসা বন্ধ হয়ে যাবে-এমন আশঙ্কা থেকেই জনসংখ্যার প্রকৃত সংখ্যা লুকানো হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা কত গুণ বেড়েছে তার একটা হিসাব আমরা এখানে তুলে ধরছি- পাকিস্তান আমলে মোট জনসংখ্যা ছিল ৯ কোটি। তখনকার হিসাবে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব বললেন- বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি। (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি ১৯৭৪ অনুযায়ী- বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৬৪ লাখ।) এরপর জিয়াউর রহমান (১৯৭৭ সাল) ক্ষমতায় আসার পর বললেন- বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৯ কোটি। এরপর এরশাদ (১৯৮২ সাল) ক্ষমতায় বসার পর বললেন- বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১১ কোটি। এরপর ১৯৯১ তে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঘোষণা দিলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। তারপর ১৯৯৬-তে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বললো, ‘বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি’। ওই ১৭ কোটি থেকে দেশের জনসংখ্যা কি আর বাড়েনি? প্রশ্ন রাখেন বিশ্ব জরিপ সংস্থা।
আমরা যদি ১৯৬৯ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ২৭ বছরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখি, তাহলে সেটা দেখতে পাই সোয়া তিন গুণেরও (৩.২৬ গুণ) বেশি। তাহলে ১৯৯৬ থেকে ২০২৪ সালের এই ২৮ বছরেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩-৪ গুণ বাড়ার কথা। কারণ পূর্বের চেয়ে গড় আয়ু বেড়েছে। বর্তমানে ৪০ কোটি জনসংখ্যা ধরলে সেটা আড়াই গুণেরও কম (২.৩৫ গুণ) ধরা হয়। কাজেই বাস্তবতা হচ্ছে- বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর সোয়া তিন গুণ হিসাব করলে জনসংখ্যা হয় প্রায় ৫৫ কোটি। বিবৃতিতে আদমশুমারি সম্পর্কে সরকারি তথ্য প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ভুল ও প্রতারণামূলক বলেও উল্লেখ করা হয়।
দেশের জনসংখ্যা থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতের তথ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। এর অন্যতম কারণ পরিসংখ্যান প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব এবং সেকেলে পদ্ধতির অনুসরণ। অনেক ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত অস্পষ্টতার কারণেও তথ্য-উপাত্ত ঘিরে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে দেশের জনমিতিক পরিসংখ্যান ঘিরে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৯ কোটি। অন্যদিকে বিবিএসের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার। এ ছাড়া সংস্থাটির স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ২০২৩ অনুযায়ী জনসংখ্যা ১৭ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৫ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৫৭ লাখ। অর্থাৎ সরকারি দুই সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যানে এক থেকে আড়াই কোটি মানুষের অমিল থেকে যাচ্ছে; এমনকি পার্থক্য আছে রাজধানী ঢাকায় বসবাসকৃত মোট জনসংখ্যা নিয়েও।
বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার পরিস্থিতি প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ প্রতিনিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশু জন্মাচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। তাই প্রকৃত জনসংখ্যা জানতে গেলে প্রয়োজন রিয়েল-টাইম ডাটা। তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে বর্তমানে এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে ও আন্তর্জাতিক সংস্থার জনসংখ্যার রিয়েল টাইম ডেটা প্রকাশ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ইউএস সেন্সাস ব্যুরো) ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে এক পাশে দেশটির, অন্যপাশে বিশ্বের জনসংখ্যার রিয়েল টাইম ডাটা দেখা যায়। একই সঙ্গে আগের দিন জনসংখ্যা কত দাঁড়িয়েছে সেটিও ওয়েবসাইটে উল্লেখ থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের জনসংখ্যা আজকের তারিখে কত বা গতকাল কত ছিল—তেমন কোনো তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বছরান্তে যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করে সেটিও বেশির ভাগ সময় হয় কয়েক বছর আগের। অথচ দেশে প্রতিদিন দশমিক ২ শতাংশের বেশি শিশু জন্মগ্রহণ করে।
২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে জনসংখ্যার মতো মুহূর্তে পরিবর্তনশীল একটি বিষয় বিবিএসের ২০২২ সালের আদমশুমারি কিংবা ২০২৩ সালের এসভিআরএসের তথ্য তাই খুব বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে না সেটিই স্বাভাবিক। জনমিতিক পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিবিএসের সেকেলে পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।
একটা দেশের জনমিতিক পরিসংখ্যান যথাযথ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এর ওপর অন্যান্য তথ্যও নির্ভর করে। মাথাপিছু আয়, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী, জনগণের প্রকৃত চাহিদা ইত্যাদি। তাই জনসংখ্যার পরিমাণ কত তা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলে সেটি নীতির সঠিক প্রণয়নও বাধাগ্রস্ত করবে। এ জন্য বিবিএসের উচিত গণনা পদ্ধতির আধুনিকায়ন করা। তবে এ কথাও সত্য উন্নত দেশগুলোর তথ্য যতটা গোছানো থাকে, এ দেশে সেটি হয় না। উন্নত দেশে শিশু জন্মানো বা কেউ মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় সার্ভারে সে তথ্য পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় এ দেশে। এখানে হাসপাতাল, বিশেষত উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বা ইউনিয়ন পর্যায়ে এ ধরনের ডাটা সেভাবে সংরক্ষিত থাকে না। এমন প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী ডাটাবেজ তৈরির জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন। তাহলে সেই তথ্য ব্যবহার করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে।
আমরা সবাই জানি, পদ্ধতিগত বা তথ্যের অপ্রতুলতা সঠিক পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা। এর বাইরে অন্যতম সমস্যা সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার অভাব। বিবিএস দেশে বসবাসরত মানুষের সংখ্যার ভিত্তিতে আদমশুমারির ফল প্রকাশ করেছে। তাদের হিসাবে নেই প্রবাসীরা। অন্যদিকে ইসির ভোটার তালিকায় প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিবিএসের আদমশুমারি চলাকালে অনেকেই ভোটার ছিলেন না। তারা বর্তমানে ভোটার হয়েছেন। ফলে ইসির ভোটার তালিকা অনুযায়ী জনসংখ্যা বেড়েছে। আবার ঢাকার জনসংখ্যা নিরূপণের ক্ষেত্রে দুটি সংস্থার নেয়া প্রশাসনিক সীমানায়ও ভিন্নতা রয়েছে। ফলে ঢাকার জনসংখ্যার তথ্যেও মিল নেই। এ ধরনের সমন্বয়হীনতার কারণে মূলত জনগণ ও নীতিনির্ধারকরা বিভ্রান্ত হন। তথ্যের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়। আর বিষয়টি কেবল পরিসংখ্যানের বিভ্রান্তি নয়; এর সরাসরি প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। মাথাপিছু আয় হিসাব, কর্মসংস্থান পরিকল্পনা, কৃষিপণ্য উৎপাদন, আমদানি-রফতানি চাহিদা নিরূপণ—সব ক্ষেত্রেই জনসংখ্যা একটি মূল সূচক।
প্রকৃত জনসংখ্যা অজানা থাকলে কার্যকর নীতি-কৌশল নেয়া যায় না। চাহিদার তুলনায় পণ্য সরবরাহ ঘাটতির একটি কারণ হিসেবেও এটি কাজ করে, যা বাজারদরে প্রভাব ফেলে। অতীতে বিবিএসের তথ্যে রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বচ্ছতার ঘাটতির অভিযোগ উঠেছে। ফলে তথ্য যতই সঠিক হোক, তার প্রতি জনগণ ও বিশেষজ্ঞদের আস্থা কমেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে, যেখানে আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরও সেটি হয়নি।
এভাবে চলতে থাকলে কোনো খাতের প্রকৃত চিত্র কখনই জানা যাবে না। এ থেকে উত্তরণে প্রয়োজন স্বচ্ছ, আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ করা। কেবল জনমিতিক পরিসংখ্যানই নয়, অন্যান্য খাতের তথ্যও একই উপায়ে প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য বিবিএসকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। পরিসংখ্যান আইন ২০১৩ অনুযায়ী বিবিএসের পরিসংখ্যানই বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সংস্থাটির পরিসংখ্যান দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও গবেষণা প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হয়।
বিগত সময়ে বিবিএসের তথ্য প্রভাবিত হতে দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানটি অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণের শিকার হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ওই চিত্রে বদল এসেছে। তবে বিবিএসের তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে খুব বেশি কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি এ সরকার। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের এটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন- যেন বিবিএসের তথ্য বিগত সময়ের মতো আর কোনো সরকার প্রভাবিত করতে না পারে। এর পাশাপাশি বিবিএসের সংস্কারের লক্ষ্যে গঠন করা টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করা; যাতে আগামীতে নির্বাচিত সরকার ওই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে। এ কাজটি যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল।
লেখক : সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ























