ঢাকা ০২:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫

সমাজের রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সর্বনাশা অসুখ ঘুষের নামান্তর ‘বকশিশ’

  • আপডেট সময় : ০৫:২৮:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

‘বকশিশ’ শব্দটি সবার কাছেই পরিচিত। বাংলা একাডেমি অভিধান অনুযায়ী এর অর্থ পারিতোষিক, পুরস্কার, উপহার কিংবা পাওনার অতিরিক্ত কিছু দেওয়া। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তার পরিশ্রম বা দায়িত্বের বাইরেও কিছু পেলে সেটিকে বলা হয় বকশিশ। আর শুদ্ধ বাংলায় ঘুষের অন্য নাম উৎকচ। ঘুষ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘নিজের কোনো অন্যায় কাজকে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে যে অর্থ প্রদান করা হয় বা কোনো কাজে সাহায্য লাভের জন্য বা কার্যসিদ্ধির জন্য গোপনে দেওয়া পুরস্কার বা অর্থ।’ যে ঘুষ নেয় তাকে বলে ঘুষখোর। ঘুষ একটি অভিশাপের নাম। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ঘুষ একটি বহুল পরিচিত শব্দ। আমাদের সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে এই সর্বনাশা অসুখ। এ বিষয় নিয়েই এবারের লাইফস্টাইল পাতার প্রধান ফিচার

বকশিশ প্রথার ইতিহাস নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এটি প্রথম চালু হয়। ওই সময় ছাত্র, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা বিভিন্ন কর্মকর্তাকে উপঢৌকন দিয়ে নিজেদের অবস্থান সহজ করতেন। পরে এটি ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বকশিশের প্রকৃত স্বরূপ হলো, স্বেচ্ছায় খুশি হয়ে কাউকে কিছু দেওয়া। কেউ খুশি হয়ে দেয়, কেউ আবার খুশি রাখার জন্য আগেভাগেই দিয়ে রাখে। কখনো নিজে খুশি হয় আবার কখনো অন্যকে খুশি করতেই বকশিশ দেওয়া হয়।

বকশিশের উৎপত্তি: বকশিশ প্রথা খুব প্রচলিত হলেও এর উৎপত্তি কখন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে কেউ কেউ বলেছেন, ষোড়শ শতাব্দীতে এটি ইংল্যান্ডে প্রথম চালু হয়। ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা এসে এই এলাকায় নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য এখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে উপঢৌকন দিতেন। তবে বর্তমান সময়ে কিছু বকশিশ দিতে হয় একেবারে বিরক্ত হয়ে। এখানে খুশি হওয়ার বা খুশি করার কোনো উদ্দেশ্য লেশমাত্র থাকে না।

বকশিশের বিস্তৃতি: ষোড়শ শতাব্দীতে বকশিশ প্রথা চালু হলেও এখন এর বিস্তৃতি অনেক দিকে, অনেক গভীরে। আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক সব দিকেই প্রায় এর বিস্তৃতি আছে। আমরা যদি দেখি কোন কোন জায়গায় এটি ছড়িয়ে পড়ছে? তাহলে সহজেই বোঝা যায় এর প্রভাব ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন অফিসে বকশিশ দেওয়া ছাড়া কাজ উঠিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। এটি প্রকাশ্যে ঘুষ হলেও ভদ্র ভাষায় বকশিশ বলা হয়। এইতো সেদিন গেলাম এক সরকারি অফিসে কিছু কাগজ সত্যায়ন করতে। তারা গেটেই ধরে বসল। প্রশ্ন করল আজকে লাগবে, নাকি সাত দিন পর? আজকে হলে পাঁচ হাজার সাত দিন পরে হলে এক হাজার। অবস্থা এমন, তাদের এই কাজ না দিলে আপনাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবে না। নিরুপায় হয়ে বকশিশের নামে ঘুষ দিতে বাধ্য থাকা। দেশের প্রায় অফিসেই এমন বকশিশের প্রচলন রয়েছে।

হোটেল রেস্তোরাঁয় মানুষ নিয়মিত যাওয়া-আসা করে আড্ডা দেয় এবং মুখরোচক খাবার খায়। খাবার শেষে বেরিয়ে আসার সময় বিল দেওয়ার পরে বয় যারা তাদের হাতেই একটি কমিশন ধরিয়ে দেওয়া লাগে। এটি আবার হতে হবে সম্মানজনক, নাহলে তারা মাইন্ড করবে। আবার বাইরে যেখানে গাড়ি রেখেছেন সেখানে আরেকজন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে আপনাকে একটি সালাম দেবে, বুঝে নিতে হবে তার কিছু চাই। এ দুই শ্রেণিকেই আপনি যদি কিছু না দেন তাহলে তারা আপনাকে অভদ্র মনে করবে। কী বিব্রতকর পরিস্থিতি! তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয়, এটি তাদের অধিকার।

আপনি কোনো শপিংমলে যাবেন সেখানেও একই পরিস্থিতি। যেকোনো জায়গায় যেতে যদি গাড়ি রিজার্ভ করেন তাহলে তার নির্দিষ্ট ভাড়া আছে। বিয়ে বাড়িতে, পিকনিকে যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়া করলেন। ভাড়া যদি পাঁচ হাজার টাকা হয়, তাহলে নির্দিষ্ট ভাড়া দেওয়ার পর ড্রাইভার হেলপার তাদের বকশিশ চাইবে। অথচ তারা এই ভাড়ার মধ্যে বেতন পাবে। তারা বলে, বকশিশ খুশি হয়ে দেবেন। কিন্তু আপনি না দিলে রাগ করবে আবার কম দিলে নিতে চাইবে না। তাহলে এটি কেমন বকশিশ? এটি তো রীতিমতো বিড়ম্বনা। অন্যদিকে আপনি যা খাবেন, ড্রাইভার হেলপার তাদের ইচ্ছেমতো খেয়ে আপনাকে বিল দিতে বলবে। এটি না দিলে আপনি অভদ্র, অসামাজিক।

প্রশাসনের কোনো অংশে বকশিশ ছাড়া কাজ হয় বলে আমার জানা নেই। ট্রাফিক পুলিশকে পাঁচ টাকা দিলে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। আবার কিছু আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃত জ্যাম লাগায়। এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়ে থানায় থাকলে তাকে খাবার দিতেও টাকা লাগে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় কিছু দালাল কাজ করেন। কিছু অফিসে এমনকি হাসপাতালেও তারা বিদ্যমান। যেকোনো কাজ করতে হলে তাদের খুশি করে সামনে এগোতে হবে নচেৎ আপনি হোঁচট খাবেন। হাসপাতালের একটি স্ট্রেচার নিতে হলেও তাদের বকশিশ দেওয়া লাগবে। গরু-ছাগলের হাটেও এই সমস্ত লোকদের বকশিশ দেওয়া লাগে।

উচ্চ পর্যায়ের বকশিশ এটি একটু ভদ্র ভাষায় বলা যায়। আপনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, অফিস থেকে পেনশন ওঠাবেন। এটি ওঠাতে হয়তো আপনার দুই জোড়া জুতা ক্ষয় হবে। পেনশন যদি সাত লাখ টাকা পান তাহলে বকশিশ হয়তো এক লাখ দেওয়া লাগবে। এভাবেই আপনাকে বকশিশ নামক ভদ্রতা সব সেক্টরে দেখাতে হবে।

মূলত বকশিশ নামক সংস্কৃতিটি এখন শুধু প্রথা নয়, এটি একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে এখন ভদ্রতা-অভদ্রতা, সামাজিকতা-অসামাজিকতা জড়িত। কিন্তু যে যাই বলুক, এটি রীতিমতো একটি বিরক্তিকর এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন সমাজসংস্কারের আরও বেশি প্রয়োজন নতুনভাবে রাষ্ট্র নির্মাণের। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভিন্ন। এখন অনেক ক্ষেত্রেই বকশিশ দিতে হয় বিরক্ত হয়ে; যেখানে খুশির ছিটেফোঁটাও নেই।

বর্তমানে বকশিশের বিস্তার এতাই ব্যাপক যে, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ছায়া পড়েছে। অফিসে কোনো কাজ করাতে গেলে ‘বকশিশ’ ছাড়া তা সম্পন্ন হওয়া যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে ঘুষ না বললেও এটিকে ‘ভদ্র ভাষায়’ বকশিশ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ- একবার একটি সরকারি অফিসে কাগজ সত্যায়নের জন্য গেলে গেটেই বলা হলো, ‘আজকে লাগলে ৫ হাজার, ৭ দিন পরে লাগলে এক হাজার।’ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় টাকা না দিলে আপনি ভেতরেই ঢুকতে পারবেন না। এটি ঘুষেরই নামান্তর, শুধু নামে ভদ্রতা।

এই সমাজে এখন বকশিশ না দেওয়া মানে আপনি ‘অভদ্র’, ‘অসামাজিক’। আর কম দিলে আপনি ‘কৃপণ’। এর ফলে একধরনের সামাজিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। অনেকেই চান না, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। ফলে বকশিশ এখন আর ইচ্ছাধীন নয়, বরং একধরনের অনৈতিক প্রথায় রূপ নিয়েছে। এক সময় বকশিশ ছিল আন্তরিকতার প্রতীক। আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির সামাজিক মোড়ক।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

প্রতিষ্ঠানের স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখার আহ্বান ফায়ার সার্ভিস ডিজির

সমাজের রন্ধ্রে ঢুকে গেছে সর্বনাশা অসুখ ঘুষের নামান্তর ‘বকশিশ’

আপডেট সময় : ০৫:২৮:০৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫

‘বকশিশ’ শব্দটি সবার কাছেই পরিচিত। বাংলা একাডেমি অভিধান অনুযায়ী এর অর্থ পারিতোষিক, পুরস্কার, উপহার কিংবা পাওনার অতিরিক্ত কিছু দেওয়া। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি তার পরিশ্রম বা দায়িত্বের বাইরেও কিছু পেলে সেটিকে বলা হয় বকশিশ। আর শুদ্ধ বাংলায় ঘুষের অন্য নাম উৎকচ। ঘুষ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘নিজের কোনো অন্যায় কাজকে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে যে অর্থ প্রদান করা হয় বা কোনো কাজে সাহায্য লাভের জন্য বা কার্যসিদ্ধির জন্য গোপনে দেওয়া পুরস্কার বা অর্থ।’ যে ঘুষ নেয় তাকে বলে ঘুষখোর। ঘুষ একটি অভিশাপের নাম। বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ঘুষ একটি বহুল পরিচিত শব্দ। আমাদের সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে এই সর্বনাশা অসুখ। এ বিষয় নিয়েই এবারের লাইফস্টাইল পাতার প্রধান ফিচার

বকশিশ প্রথার ইতিহাস নিয়ে স্পষ্ট কিছু জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে এটি প্রথম চালু হয়। ওই সময় ছাত্র, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা বিভিন্ন কর্মকর্তাকে উপঢৌকন দিয়ে নিজেদের অবস্থান সহজ করতেন। পরে এটি ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বকশিশের প্রকৃত স্বরূপ হলো, স্বেচ্ছায় খুশি হয়ে কাউকে কিছু দেওয়া। কেউ খুশি হয়ে দেয়, কেউ আবার খুশি রাখার জন্য আগেভাগেই দিয়ে রাখে। কখনো নিজে খুশি হয় আবার কখনো অন্যকে খুশি করতেই বকশিশ দেওয়া হয়।

বকশিশের উৎপত্তি: বকশিশ প্রথা খুব প্রচলিত হলেও এর উৎপত্তি কখন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে কেউ কেউ বলেছেন, ষোড়শ শতাব্দীতে এটি ইংল্যান্ডে প্রথম চালু হয়। ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকরা এসে এই এলাকায় নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য এখানকার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে উপঢৌকন দিতেন। তবে বর্তমান সময়ে কিছু বকশিশ দিতে হয় একেবারে বিরক্ত হয়ে। এখানে খুশি হওয়ার বা খুশি করার কোনো উদ্দেশ্য লেশমাত্র থাকে না।

বকশিশের বিস্তৃতি: ষোড়শ শতাব্দীতে বকশিশ প্রথা চালু হলেও এখন এর বিস্তৃতি অনেক দিকে, অনেক গভীরে। আমাদের জীবনের প্রাত্যহিক সব দিকেই প্রায় এর বিস্তৃতি আছে। আমরা যদি দেখি কোন কোন জায়গায় এটি ছড়িয়ে পড়ছে? তাহলে সহজেই বোঝা যায় এর প্রভাব ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন অফিসে বকশিশ দেওয়া ছাড়া কাজ উঠিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। এটি প্রকাশ্যে ঘুষ হলেও ভদ্র ভাষায় বকশিশ বলা হয়। এইতো সেদিন গেলাম এক সরকারি অফিসে কিছু কাগজ সত্যায়ন করতে। তারা গেটেই ধরে বসল। প্রশ্ন করল আজকে লাগবে, নাকি সাত দিন পর? আজকে হলে পাঁচ হাজার সাত দিন পরে হলে এক হাজার। অবস্থা এমন, তাদের এই কাজ না দিলে আপনাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেবে না। নিরুপায় হয়ে বকশিশের নামে ঘুষ দিতে বাধ্য থাকা। দেশের প্রায় অফিসেই এমন বকশিশের প্রচলন রয়েছে।

হোটেল রেস্তোরাঁয় মানুষ নিয়মিত যাওয়া-আসা করে আড্ডা দেয় এবং মুখরোচক খাবার খায়। খাবার শেষে বেরিয়ে আসার সময় বিল দেওয়ার পরে বয় যারা তাদের হাতেই একটি কমিশন ধরিয়ে দেওয়া লাগে। এটি আবার হতে হবে সম্মানজনক, নাহলে তারা মাইন্ড করবে। আবার বাইরে যেখানে গাড়ি রেখেছেন সেখানে আরেকজন। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে আপনাকে একটি সালাম দেবে, বুঝে নিতে হবে তার কিছু চাই। এ দুই শ্রেণিকেই আপনি যদি কিছু না দেন তাহলে তারা আপনাকে অভদ্র মনে করবে। কী বিব্রতকর পরিস্থিতি! তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয়, এটি তাদের অধিকার।

আপনি কোনো শপিংমলে যাবেন সেখানেও একই পরিস্থিতি। যেকোনো জায়গায় যেতে যদি গাড়ি রিজার্ভ করেন তাহলে তার নির্দিষ্ট ভাড়া আছে। বিয়ে বাড়িতে, পিকনিকে যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়া করলেন। ভাড়া যদি পাঁচ হাজার টাকা হয়, তাহলে নির্দিষ্ট ভাড়া দেওয়ার পর ড্রাইভার হেলপার তাদের বকশিশ চাইবে। অথচ তারা এই ভাড়ার মধ্যে বেতন পাবে। তারা বলে, বকশিশ খুশি হয়ে দেবেন। কিন্তু আপনি না দিলে রাগ করবে আবার কম দিলে নিতে চাইবে না। তাহলে এটি কেমন বকশিশ? এটি তো রীতিমতো বিড়ম্বনা। অন্যদিকে আপনি যা খাবেন, ড্রাইভার হেলপার তাদের ইচ্ছেমতো খেয়ে আপনাকে বিল দিতে বলবে। এটি না দিলে আপনি অভদ্র, অসামাজিক।

প্রশাসনের কোনো অংশে বকশিশ ছাড়া কাজ হয় বলে আমার জানা নেই। ট্রাফিক পুলিশকে পাঁচ টাকা দিলে সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। আবার কিছু আদায়ের জন্য ইচ্ছাকৃত জ্যাম লাগায়। এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়ে থানায় থাকলে তাকে খাবার দিতেও টাকা লাগে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বা ক্রয়-বিক্রয়ের সময় কিছু দালাল কাজ করেন। কিছু অফিসে এমনকি হাসপাতালেও তারা বিদ্যমান। যেকোনো কাজ করতে হলে তাদের খুশি করে সামনে এগোতে হবে নচেৎ আপনি হোঁচট খাবেন। হাসপাতালের একটি স্ট্রেচার নিতে হলেও তাদের বকশিশ দেওয়া লাগবে। গরু-ছাগলের হাটেও এই সমস্ত লোকদের বকশিশ দেওয়া লাগে।

উচ্চ পর্যায়ের বকশিশ এটি একটু ভদ্র ভাষায় বলা যায়। আপনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, অফিস থেকে পেনশন ওঠাবেন। এটি ওঠাতে হয়তো আপনার দুই জোড়া জুতা ক্ষয় হবে। পেনশন যদি সাত লাখ টাকা পান তাহলে বকশিশ হয়তো এক লাখ দেওয়া লাগবে। এভাবেই আপনাকে বকশিশ নামক ভদ্রতা সব সেক্টরে দেখাতে হবে।

মূলত বকশিশ নামক সংস্কৃতিটি এখন শুধু প্রথা নয়, এটি একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে এখন ভদ্রতা-অভদ্রতা, সামাজিকতা-অসামাজিকতা জড়িত। কিন্তু যে যাই বলুক, এটি রীতিমতো একটি বিরক্তিকর এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন, প্রয়োজন সমাজসংস্কারের আরও বেশি প্রয়োজন নতুনভাবে রাষ্ট্র নির্মাণের। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টি ভিন্ন। এখন অনেক ক্ষেত্রেই বকশিশ দিতে হয় বিরক্ত হয়ে; যেখানে খুশির ছিটেফোঁটাও নেই।

বর্তমানে বকশিশের বিস্তার এতাই ব্যাপক যে, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর ছায়া পড়েছে। অফিসে কোনো কাজ করাতে গেলে ‘বকশিশ’ ছাড়া তা সম্পন্ন হওয়া যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। প্রকাশ্যে ঘুষ না বললেও এটিকে ‘ভদ্র ভাষায়’ বকশিশ বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ- একবার একটি সরকারি অফিসে কাগজ সত্যায়নের জন্য গেলে গেটেই বলা হলো, ‘আজকে লাগলে ৫ হাজার, ৭ দিন পরে লাগলে এক হাজার।’ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় টাকা না দিলে আপনি ভেতরেই ঢুকতে পারবেন না। এটি ঘুষেরই নামান্তর, শুধু নামে ভদ্রতা।

এই সমাজে এখন বকশিশ না দেওয়া মানে আপনি ‘অভদ্র’, ‘অসামাজিক’। আর কম দিলে আপনি ‘কৃপণ’। এর ফলে একধরনের সামাজিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। অনেকেই চান না, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে। ফলে বকশিশ এখন আর ইচ্ছাধীন নয়, বরং একধরনের অনৈতিক প্রথায় রূপ নিয়েছে। এক সময় বকশিশ ছিল আন্তরিকতার প্রতীক। আজ তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতির সামাজিক মোড়ক।

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ