ঢাকা ০৫:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫

আগুন লাগার পর ঘুম ভাঙে কেন?

  • আপডেট সময় : ০৬:২৮:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫
  • ৭ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেল দেশে। ১৪ অক্টোবর ২০২৫ মিরপুরের রূপনগরে, তার একদিন বাদেই চট্টগ্রাম ইপিজেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় ১৮ অক্টোবর ২০২৫।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের মতো বিশেষায়িত শিল্প এলাকায় আগুন লাগবার পর বিমানবন্দরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়ও লেগেছে আগুন। এই দুটো ঘটনাতেই আগুন পুরোপুরি নেভাতে এক দিনের মতো সময় লেগেছে। কেউ মারা না গেলেও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। আবার মিরপুরের রূপনগরের আগুনে ১৬ জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে নানা ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। সব ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি সামগ্রিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে আবারও। ফলে শহরের পরিকল্পনা, ভবনের ডিজাইন, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবকিছু নিয়েই আমাদের গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একই সয়েমড় এসব আগুনের ঘটনাতে নাশকতার সম্ভাবনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করার দাবি উঠেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজসহ অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে যা জানা গিয়েছে, বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের নেপথ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কার্যকর সমন্বয়ের অভাব ছিল। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই উপযুক্ত মনিটরিং, পেট্রোলিং ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা সক্রিয় থাকলে দ্রুত এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়তো সম্ভব হতো।

ফায়ার স্টেশনের কর্মীদের অনেকে বলেছেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে তারা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়া হলে আগুনের কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেত। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ত না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও এড়ানো যেত।

একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে সব ধরনের আগুন নির্বাপণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরে তা নেই। বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যেও চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার দায় রয়েছে এই অগ্নিকাণ্ডে। ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় ইতিপূর্বেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তখন ফায়ার সার্ভিস কিছু সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাস্তবায়ন করা হলে আগুনে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মোটামুটি একই রকম। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) এলাকায় আগুন লাগা সাততলা ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। কারখানার ভেতরে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ছিল। সেটা নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না কারখানায়। ভবনের সেট ব্যাক বা দুটো ভবনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে ভবনের দুই পাশ দিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ ছিল না।

ফায়ার সার্ভিস এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘চট্টগ্রাম ইপিজেডের কারখানাতে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের (অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা) আবেদন করা হয়েছে কেবল। তবে নিয়ম অনুযায়ী এখনো পরিদর্শন হয়নি। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’

দুর্ঘটনা তো এভাবেই ঘটে। তাহলে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছাড়া কীভাবে কারখানাটি চলছিল। এভাবেই তো বাংলাদেশে হাজার হাজার শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কারখানা চালানো হচ্ছে। ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে মানুষের জীবন।

চট্টগ্রাম ইপিজেডে মানুষ মারা যায়নি। কিন্তু মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে রাসায়নিক গুদাম ও পোশাক কারখানায় ১৬ জনের মতো মানুষ মারা গেলেন। যথাযথ অনুমোদন ও অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়া রাজধানীর বুকে কীভাবে এই ধরনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদাম দিনের পর দিন চলতে পারে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার তদারকির ব্যর্থতায়ই এতগুলো মানুষকে মরতে হলো। ফলে এটি অবহেলাজনিত আর কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে বিবেচনা করে অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে এসে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

অনুমোদনহীনভাবে যত্রতত্র বিপদজনক শিল্পকারখানা স্থাপন, ফায়ার লাইসেন্স ও অগ্নি নিরাপত্তা সনদ না নেওয়া, যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ভবন ও কারখানার যথাযথ ব্যবহার অনুমোদন না নিয়েই বিপদজনক ব্যবহার করা এবং মহাপরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনা অনুসরণ না করবার কারণেই দারিদ্র্যপীড়িত ও বিপন্ন শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে অসহায়ভাবে মরতে হলো। শিল্প মালিকরা শহরের পরিকল্পনা, ইমারত ও শিল্প সংশ্লিষ্ট সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। ভবনের যথাযথ কর্মপরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই মানুষের দরিদ্র্যতাকে পুঁজি করে শ্রমিকদের বাধ্য করেন এই ধরনের কারখানায় কাজ করতে।

শিল্প মালিকদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে অগ্নিঝুঁকি কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। প্রত্যেকেই তাদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এভাবে মানুষ মারা যেত না। ফলে এ ঘটনাকে কাঠামোগত ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা একান্ত জরুরি।

ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর এলাকায় যত্রতত্র ওইসব শিল্পকারখানা অবাধে গড়ে ওঠার পেছনে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতির একটা চক্র গড়ে উঠেছে; যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর দেড় দশক পার হয়ে গেলেও রাসায়নিক গুদামগুলো নিরাপদ শিল্প জোনে কেন স্থানান্তর করা গেল না, সরকারকে অবিলম্বে এই সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে করণীয় ঠিক করা প্রয়োজন। আমাদের বিদ্যমান শিল্প আইনে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের জীবনের ক্ষতিপূরণের দাম মাত্র দুই লাখ টাকা। এই আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করা হলে এবং গাফিলতিজনিত দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বিবেচনা না করলে আমাদের শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।

বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ওষুধের বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। আগুনের ঘটনায় বিদেশিদের মধ্যে বন্দরে পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ক্রমাগত ঘটে যাওয়া আগুনের ঘটনায় আমাদের ওষুধ, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মানুষের জীবনে নাশকতার শঙ্কা আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও বেড়েছে। বেড়েছে ভবনে বা কারখানায় বেঘোরে আগুনে পুড়ে মরে যাওয়ার ভয়।

বিল্ডিং কোড, নির্মাণ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান মেনে নিয়ে শিল্প কারখানার অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। ভবন বা কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে উন্নত ও নিরাপদ করতে হবে। শহরের মহাপরিকল্পনাকে আমলে না নিয়ে এবং শিল্প জোনে না গিয়ে যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে শ্রমিক ও আশপাশের জনবসতির জীবনের নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করবার অধিকার কারো নেই। শ্রমিক ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি দিয়ে এই প্রবণতা রোধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

আগুনে কত মানুষের স্বপ্ন নিভে গেছে। আর কত মানুষ অঙ্গার হলে ঘুম ভাঙবে রাষ্ট্রের…।

লেখক: অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

আগুন লাগার পর ঘুম ভাঙে কেন?

আপডেট সময় : ০৬:২৮:৪৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫

ড. আদিল মুহাম্মদ খান

পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেল দেশে। ১৪ অক্টোবর ২০২৫ মিরপুরের রূপনগরে, তার একদিন বাদেই চট্টগ্রাম ইপিজেডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় ১৮ অক্টোবর ২০২৫।

চট্টগ্রাম ইপিজেডের মতো বিশেষায়িত শিল্প এলাকায় আগুন লাগবার পর বিমানবন্দরের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়ও লেগেছে আগুন। এই দুটো ঘটনাতেই আগুন পুরোপুরি নেভাতে এক দিনের মতো সময় লেগেছে। কেউ মারা না গেলেও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। আবার মিরপুরের রূপনগরের আগুনে ১৬ জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।

তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেশে নানা ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছে। জনমনে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। সব ক্ষেত্রেই আমাদের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার পাশাপাশি সামগ্রিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে আবারও। ফলে শহরের পরিকল্পনা, ভবনের ডিজাইন, অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবকিছু নিয়েই আমাদের গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একই সয়েমড় এসব আগুনের ঘটনাতে নাশকতার সম্ভাবনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করার দাবি উঠেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজসহ অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে যা জানা গিয়েছে, বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনের নেপথ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কার্যকর সমন্বয়ের অভাব ছিল। অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই উপযুক্ত মনিটরিং, পেট্রোলিং ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সদস্যরা সক্রিয় থাকলে দ্রুত এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়তো সম্ভব হতো।

ফায়ার স্টেশনের কর্মীদের অনেকে বলেছেন, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে তারা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়া হলে আগুনের কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেত। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ত না। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও এড়ানো যেত।

একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে সব ধরনের আগুন নির্বাপণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরে তা নেই। বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যেও চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার দায় রয়েছে এই অগ্নিকাণ্ডে। ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় ইতিপূর্বেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তখন ফায়ার সার্ভিস কিছু সুপারিশ করেছিল। সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাস্তবায়ন করা হলে আগুনে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

সব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মোটামুটি একই রকম। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) এলাকায় আগুন লাগা সাততলা ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না। কারখানার ভেতরে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ ছিল। সেটা নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না কারখানায়। ভবনের সেট ব্যাক বা দুটো ভবনের মধ্যবর্তী দূরত্ব ছিল অপর্যাপ্ত। ফলে ভবনের দুই পাশ দিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ ছিল না।

ফায়ার সার্ভিস এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘চট্টগ্রাম ইপিজেডের কারখানাতে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের (অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা) আবেদন করা হয়েছে কেবল। তবে নিয়ম অনুযায়ী এখনো পরিদর্শন হয়নি। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।’

দুর্ঘটনা তো এভাবেই ঘটে। তাহলে ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছাড়া কীভাবে কারখানাটি চলছিল। এভাবেই তো বাংলাদেশে হাজার হাজার শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কারখানা চালানো হচ্ছে। ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে মানুষের জীবন।

চট্টগ্রাম ইপিজেডে মানুষ মারা যায়নি। কিন্তু মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়িতে রাসায়নিক গুদাম ও পোশাক কারখানায় ১৬ জনের মতো মানুষ মারা গেলেন। যথাযথ অনুমোদন ও অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়া রাজধানীর বুকে কীভাবে এই ধরনের অতি ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক গুদাম দিনের পর দিন চলতে পারে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার তদারকির ব্যর্থতায়ই এতগুলো মানুষকে মরতে হলো। ফলে এটি অবহেলাজনিত আর কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।

রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে বিবেচনা করে অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় নিয়ে এসে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের সুচিকিৎসা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

অনুমোদনহীনভাবে যত্রতত্র বিপদজনক শিল্পকারখানা স্থাপন, ফায়ার লাইসেন্স ও অগ্নি নিরাপত্তা সনদ না নেওয়া, যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ভবন ও কারখানার যথাযথ ব্যবহার অনুমোদন না নিয়েই বিপদজনক ব্যবহার করা এবং মহাপরিকল্পনা ও নগর পরিকল্পনা অনুসরণ না করবার কারণেই দারিদ্র্যপীড়িত ও বিপন্ন শ্রমিকদের আগুনে পুড়ে অসহায়ভাবে মরতে হলো। শিল্প মালিকরা শহরের পরিকল্পনা, ইমারত ও শিল্প সংশ্লিষ্ট সব আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। ভবনের যথাযথ কর্মপরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই মানুষের দরিদ্র্যতাকে পুঁজি করে শ্রমিকদের বাধ্য করেন এই ধরনের কারখানায় কাজ করতে।

শিল্প মালিকদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে অগ্নিঝুঁকি কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। প্রত্যেকেই তাদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করলে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এভাবে মানুষ মারা যেত না। ফলে এ ঘটনাকে কাঠামোগত ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা একান্ত জরুরি।

ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নগর এলাকায় যত্রতত্র ওইসব শিল্পকারখানা অবাধে গড়ে ওঠার পেছনে সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতির একটা চক্র গড়ে উঠেছে; যা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অতি জরুরি। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর দেড় দশক পার হয়ে গেলেও রাসায়নিক গুদামগুলো নিরাপদ শিল্প জোনে কেন স্থানান্তর করা গেল না, সরকারকে অবিলম্বে এই সংক্রান্ত কমিশন গঠন করে করণীয় ঠিক করা প্রয়োজন। আমাদের বিদ্যমান শিল্প আইনে, দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের জীবনের ক্ষতিপূরণের দাম মাত্র দুই লাখ টাকা। এই আইনে প্রয়োজনীয় সংস্কার না করা হলে এবং গাফিলতিজনিত দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বিবেচনা না করলে আমাদের শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না।

বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আগুনে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং ওষুধের বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। আগুনের ঘটনায় বিদেশিদের মধ্যে বন্দরে পণ্যের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ক্রমাগত ঘটে যাওয়া আগুনের ঘটনায় আমাদের ওষুধ, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মানুষের জীবনে নাশকতার শঙ্কা আর উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও বেড়েছে। বেড়েছে ভবনে বা কারখানায় বেঘোরে আগুনে পুড়ে মরে যাওয়ার ভয়।

বিল্ডিং কোড, নির্মাণ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিবিধান মেনে নিয়ে শিল্প কারখানার অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে। ভবন বা কারখানার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাকে উন্নত ও নিরাপদ করতে হবে। শহরের মহাপরিকল্পনাকে আমলে না নিয়ে এবং শিল্প জোনে না গিয়ে যত্রতত্র শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে শ্রমিক ও আশপাশের জনবসতির জীবনের নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করবার অধিকার কারো নেই। শ্রমিক ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি দিয়ে এই প্রবণতা রোধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

আগুনে কত মানুষের স্বপ্ন নিভে গেছে। আর কত মানুষ অঙ্গার হলে ঘুম ভাঙবে রাষ্ট্রের…।

লেখক: অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)