কৃষি ও কৃষক ডেস্ক: অসংখ্য মানুষ, গাড়ি আর কংক্রিটের অট্টালিকার ভিড়ে এক অদ্ভুত ঘনত্বে শ্বাস নেয় রাজধানী ঢাকার মানুষ। এমন নগরে প্রতিদিন নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়। এর ভেতর দিয়েই মানুষ খুঁজে নেয় বেঁচে থাকার উপায়। এই শহরে ফুটপাথ ঘেঁষে গড়ে ওঠা নার্সারিগুলো তেমনই এক বাস্তবতার নাম। সরকারি জায়গা দখল করে, কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই নার্সারি মালিকেরা গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট সবুজের বাজার। কারো কাছে এগুলো হলো পথচলার অন্তরায় আবার কারো কাছে সুলভে গাছ পাওয়া এবং শহরে এক চিলতে সবুজ ফেরানোর সুযোগ। এ দুই বিপরীত বাস্তবতার ভেতর দিয়েই ঢাকার ফুটপাথঘেঁষা নার্সারিগুলো দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য বৈপরীত্যে।
শহরে সবুজের তীব্র অভাব। মানুষের মানসিক প্রশান্তি, ছাদবাগান কিংবা ইনডোর সাজসজ্জার জন্য গাছ কেনার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। অন্যদিকে শহরে পর্যাপ্ত উন্মুক্ত জায়গা না থাকায়, নার্সারি ব্যবসায়ীরা বেছে নিয়েছেন ফুটপাতকে। ফলে গড়ে উঠেছে এক অঘোষিত বাজার; যা একদিকে যেমন পথচারীর জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে তেমনি শহরের সৌন্দর্যও কিছুটা হলেও ধরে রাখছে।
ঢাকায় এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে অন্তত কিছুটা না হলেও ফুটপাথের ওপর গড়ে ওঠেনি গাছের দোকান। সবচেয়ে বড় এবং সুপরিচিত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে আগারগাঁও বেগম রোকেয়া সরনি। শিশু মেলার মোড় থেকে শুরু করে আইডিবি ভবন পর্যন্ত লম্বা এক সারিতে বসানো টব আর চারাগাছ যেন ফুটপাথের বিকল্প দৃশ্য তৈরি করে। এখানে ইনডোর-আউটডোর গাছ থেকে শুরু করে ছোট টবের ফুল, ফলজ চারা, এমনকি ল্যান্ডস্কেপিংয়ের গাছও মেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহবাগ এলাকা, দোয়েল চত্বর, কার্জন হল, সুপ্রিম কোর্ট ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় গাছের দোকান। বছরের বিভিন্ন সময়ে এখানে ফুলের বাহার থাকে সবচেয়ে বেশি। গাঁদা, টগর, বেলি, গোলাপের টব সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয় পথের ধারে। শিক্ষার্থীরা যেমন ছাদবাগানের জন্য এখান থেকে গাছ কেনেন, তেমনি পথচারীরাও থেমে থেমে কিছু না কিছু নিয়ে যান।
গুলশান-বারিধারা এলাকার নার্সারিগুলো তুলনামূলকভাবে দামি। কারণ এখানকার ক্রেতারা সাধারণত অভিজাত শ্রেণির। তারা ইনডোর ডেকোরেশন, অফিস লবি সাজানো কিংবা বাগান নকশার জন্য গাছ কিনে থাকেন। ফলে এখানে দাম একটু বেশি হলেও বৈচিত্র্য ও মান বজায় থাকে।
উত্তরা-এয়ারপোর্ট রোড ঘিরেও মৌসুমি গাছের স্টল বসে। শীতকালে ফুলের টবের বিক্রি যেমন জমে ওঠে, বর্ষায় আবার ফলজ চারা বেশি বিক্রি হয়। মূলত রাজধানীকে ঘিরে থাকা সাভার ও গাজীপুরের বড় নার্সারিগুলো থেকেই এই সরবরাহ আসে। ফলে শহরের ভেতরে ফুটপাতকেন্দ্রিক নার্সারিগুলো হয়ে উঠেছে শেষ প্রান্তের বাজার।
ঢাকার ফুটপাতের নার্সারিগুলোতে হাজারো মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রতিটি নার্সারিতে গড়ে তিন থেকে আটজন কর্মী থাকে। মৌসুমভেদে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ থেকে ২০ পর্যন্ত। শীতকাল বা বসন্তের শুরুতে গাছের চাহিদা বাড়ে, তখন অতিরিক্ত শ্রমিক ভাড়া করা হয়।
নার্সারি মালিকদের অনেকেই মূলত গ্রামের মানুষ। কেউ সাভার বা গাজীপুরে নিজেদের ছোট নার্সারি থেকে গাছ এনে এখানে বিক্রি করেন। কেউ আবার পাইকারি বাজার থেকে গাছ কিনে এনে ফুটপাথে সাজিয়ে বসেন। রাজধানীর কংক্রিটে বন্দি মানুষের কাছে সহজে গাছ পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করছেন।
একজন নার্সারি কর্মী দিনে গড়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা মজুরি পান। যারা মালিক, তারা মাসে ৩০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন, নির্ভর করে লোকেশন ও মৌসুমি বিক্রির ওপর। অনেক পরিবার আছে যাদের পুরো জীবিকা নির্ভর করছে এই নার্সারি ব্যবসার ওপর। অথচ বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই, নেই কোনো স্থায়ী জায়গা। ফলে প্রতিনিয়ত তাদের উচ্ছেদ অভিযানের ভয়ে থাকতে হয়। তবু জীবন চলে, কারণ শহরের মানুষ প্রতিনিয়ত গাছ কিনতে আসে।
নার্সারিগুলো যেমন শহরে সবুজ ছড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি সৃষ্টি করছে নানারকম জটিলতা। পথচারীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- ফুটপাত দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা যায় না। টব আর চারার সারিতে ফুটপাত সরু হয়ে যায়। ফলে মানুষকে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামতে হয়। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। শাহবাগ, দোয়েল চত্বর বা আগারগাঁও এলাকায় এমন চিত্র প্রতিদিনই দেখা যায়। যানজটও বেড়ে যায় এসব নার্সারির কারণে। ব্যস্ত মোড়ের কাছে টব সাজিয়ে রাখলে রিকশা বা গাড়ির চলাচল ব্যাহত হয়। অনেক সময় দেখা যায় গাছের সংখ্যা বেশি হলে রাস্তায় গাছ সাজিয়ে রাখেন।
ঢাকার ফুটপাতের নার্সারিগুলো হলো ছোট্ট এক সবুজ জগৎ। এখানে যে বৈচিত্র্য মেলে, তা অনেক সময় বড় বাজারেও পাওয়া যায় না। মৌসুমি ফুলের মধ্যে আছে গোলাপ, জবা, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, টগর, বেলি ও বোগেনভিলিয়া। শীতকালে আবার বিদেশি ফুল যেমন পেটুনিয়া, ক্যালেন্ডুলাও পাওয়া যায়। ফলজ গাছের চাহিদাও প্রচুর। থাই পেয়ারা, কমলা, লেবু, কামরাঙা, ডালিম, কুল, জামরুল এসব চারা সহজেই পাওয়া যায়। অনেকেই ছাদবাগান বা টবেই ফলজ গাছ লাগান। সব মিলিয়ে ঢাকার নার্সারিগুলোতে তিন শতাধিক প্রজাতির গাছ পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। টব, মাটি, সার, কীটনাশক সবকিছুই মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের ‘ওয়ান স্টপ মার্কেট’।
ফুটপাত দখল করে নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে নার্সারিগুলোকে জায়গা দেওয়া উচিত বলে মনে করেন নগরবিদরা। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশন চাইলে প্রতিটি অঞ্চলে নির্দিষ্ট ‘প্ল্যান্ট মার্কেট জোন’ করতে পারে। সেখানে বৈধভাবে নার্সারিগুলো বসবে, আর ফুটপাত পথচারীর জন্য খালি থাকবে। এ ছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পলিব্যাগ রিসাইক্লিং ও ড্রেন পরিষ্কারের জন্য নার্সারি মালিকদের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা উচিত। অন্যদিকে সরকার চাইলে ছাদবাগান প্রণোদনার সাথে নার্সারিগুলোকে যুক্ত করতে পারে। এতে মান ও দামের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। নার্সারি মালিকদেরও স্থায়ী নিরাপত্তা ও বৈধ ব্যবসার সুযোগ দেওয়া যাবে।
ঢাকার ফুটপাতের নার্সারিগুলো এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের প্রতিচ্ছবি। এগুলো যেমন অবৈধভাবে জায়গা দখল করে শহরের চলাচল ব্যাহত করছে, তেমনি শহরের সবুজ ফেরানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবেও কাজ করছে। মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই ব্যবসা, আবার নগরের সৌন্দর্যও অনেকটা নির্ভর করছে এগুলোর ওপর। তাই নগরবিদরা বলছেন, সমাধান একটাই—অবৈধকে বৈধ করার মতো পরিকল্পিত পদক্ষেপ। যদি নির্দিষ্ট জায়গা, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও করপোরেশনের নজরদারির মাধ্যমে নার্সারিগুলো টিকিয়ে রাখা যায়, তবে ঢাকার মতো কংক্রিট নগরীতেও ধীরে ধীরে সবুজের পরশ ফিরে পাবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও নগর পরিকল্পনাবিদ আক্তার মাহমুদ বলেন, ‘যে কোনো শহরের জন্য ফুটপাথ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক ও টেকসই নগরের ক্ষেত্রে ফুটপাথের বিকল্প নেই। ছোট শহর থেকে শুরু করে মেগাসিটি পর্যন্ত, বাসযোগ্য শহর গড়তে হলে নিরাপদ ও প্রশস্ত ফুটপাথ অপরিহার্য। এসডিজির লক্ষ্যেও বলা আছে, হাঁটার যোগ্য শহর গড়ে তুলতে ফুটপাথকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় দেখা যায়, দুর্বল শাসনব্যবস্থার কারণে ফুটপাথ দখল হয়ে যায়। দোকানদার থেকে শুরু করে নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, সবাই মিলে ফুটপাথকে দখল করে নেয়। অনেক সময় রাস্তা প্রশস্ত করার নামে ফুটপাথই ছোট করে ফেলা হয় এটিও ভুল পদক্ষেপ।’
বুয়েটের শিক্ষক ও নগর পরিকল্পনাবিদ হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের সিটি করপোরেশনের ফুটপাতসংক্রান্ত যে নীতিমালা আছে, সেখানে ফুটপাথকে নাগরিকদের জন্য প্রাধান্য দেওয়ার পাশাপাশি সীমিতসংখ্যক ভেন্ডরকে লাইসেন্স দিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। কাগজে-কলমে বিষয়টি আকর্ষণীয় মনে হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ প্রায় অসম্ভব। কারণ কে লাইসেন্স নিয়ে বসছে আর কে লাইসেন্স ছাড়াই ফুটপাত দখল করছে এটি মনিটরের সক্ষমতা সিটি করপোরেশনের নেই। প্রয়োজনীয় জনবল ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা না থাকায় এই নীতিমালা কার্যকর করা প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।’
দোয়েল চত্বরের পাশে নার্সারি মালিক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা তো অন্য কোনো কাজ জানি না, ছোটবেলা থেকেই গাছপালা নিয়ে আছি। এই দোকান দিয়ে আমার সংসার চলে। কিন্তু শহরে নির্দিষ্ট করে কোনো জায়গা নেই, তাই ফুটপাত ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকে না। সিটি করপোরেশন যদি নির্দিষ্ট জায়গা করে না দেয়, তাহলে আমরা কোথায় যাবো। আমরাও তো চাই মানুষ নির্বিঘ্নে ফুটপাথে হাঁটুক। মানুষের হাঁটার জন্য জায়গা রেখেই আমরা দোকান সাজাই।’
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ