ঢাকা ০৩:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৫

সেফ এক্সিটের প্রশ্ন কেন?

  • আপডেট সময় : ০৫:৫৯:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে
  • আমীন আল রশীদ

কোনো একটা বিশেষ স্থানে বা কাজে কেউ যখন নিজেকে ‘আনসেইফ’ মনে করে, তখনই তার ‘সেইফ এক্সিট’ প্রয়োজন হয়। সেইফ এক্সিটের সহজ বাংলা নিরাপদ প্রস্থান বা নিরাপদে সরে যাওয়া। তীর্যক ভাষায় বললে, কৌশলে সটকে পড়া। প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের কী এমন হলো যে তাদের সেইফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের বিষয়টি সামনে এলো? সরকারের উপদেষ্টারা কি নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে আছেন বা তারা কি এমন কিছু করেছেন যে এখন তাদের দায়মুক্তি প্রয়োজন বা দ্রুত এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেলেই বাঁচেন?

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি গঠিত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে এসেছিল। ওই সরকারও নানাবিধ সংস্কারে হাত দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘সংস্কারপন্থী’ বলে একটি আলাদা অংশ তৈরি হয়েছিল—যেটি গড়ে তোলার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী। নির্যাতনের মুখে অনেক সিনিয়র নেতা তাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিষয়ে এমন সব তথ্য দিয়েছিলেন, যা রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়।

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগে তখন নতুন নেতৃত্ব আনার বিষয়টি সামনে আনা হয়। তখন আলোচনায় আসে এই দুই নেত্রীর সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি। দুর্নীতি মামলার ফাঁদ থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের নিরাপদে দেশ থেকে বের করে দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। এ সময় দুই নেত্রকেই গ্রেপ্তার করা হয়। বছরখানেক পরে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে রাজি হননি। তার মানে দেশের প্রধান দুই দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর সেইফ এক্সিটের নামে রাজনীতি থেকে তাদের বিদায় করা সম্ভব হয়নি।

সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার—যারা এক-এগারো বা ওয়ান ইলেভেনের সরকার নামে পরিচিত ছিল, তারা দ্রুতই জনপ্রিয়তা হারায়, বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধে। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সংঘর্ষ। অনেক শিক্ষককেও তখন গ্রেপ্তার করা হয়।

ওই সরকার ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, না ভোটের বিধান চালুর মতো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও তাদেরও সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ নির্বাচনের পরে যাতে এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কোনো ধরনের বিচারের মুখোমুখি না হয়, সেজন্য সম্ভাব্য বিজয়ী দলের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল—এমন কথাও শোনা যায়। যদিও ওই সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের কেউই আর পরবর্তীতে দেশে থাকেননি বা থাকতে পারেননি। তারা উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এটাও কি তাহলে একধরনের সেইফ এক্সিট?

এবার নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকারেরও সেইফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের প্রশ্নটি সামনে আসছে। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবতেছে।’

নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। রাজনীতিতে তো বটেই। তবে এ বিষয়ে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশের জাতি হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন আছে। গত ৫৫ বছর দুঃশাসন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল। এই ভয়াবহ রাষ্ট্রকাঠামো থেকে সেফ এক্সিট প্রয়োজন।’

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট (নিরাপদ প্রস্থান) নিতে চান, এ বিষয়গুলো নাহিদ ইসলামকেই পরিষ্কার করতে হবে। উনি যদি কখনো পরিষ্কার করেন, তখন সেটি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের কথা আসে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, তাই সেফ এক্সিট আমার জন্য নয়। আমি এ দেশেই থাকব।’

ফেসবুক পোস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান লেখেন, বাহাত্তরোর্ধ্ব বছর বয়সে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা তার জন্য গভীর দুঃখের বিষয় হবে। তিনি লিখেছেন, ‘নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিনি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দিই নাই। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার সূত্রে, ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগ গ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়!’

সেইফ এক্সিট প্রশ্নে সরকারের চার উপদেষ্টার মধ্যে ফাওজুল কবির খানের অবস্থান সবচেয়ে শক্ত। নিজের সততার ওপর আস্থাবান এই বয়স্ক মানুষটি বলছেন, নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করেননি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দেননি। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে সত্যিই তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন নেই। প্রয়োজন নেই। তিনি নিজের কাছে পরিষ্কার। অর্থাৎ কেউ যদি অন্যায় না করেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, রাষ্ট্রীয় পদে থেকে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করেন—তাহলে তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন উঠবে না।

কিন্তু যারা রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসেই সেই চেয়ারটাকে টাকা কামানোর মেশিন ভাবেন; একবার ক্ষমতা পেয়ে গেছেন বলে সারা জীবনের আখের গুছিয়ে নিতে চান; নিজের ও পরিবারের নামে-বেনামে ব্যবসার দরজা খুলে দেন; সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের পার্সেন্টিজসহ নানা খাত থেকে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান; নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারকম সুবিধা নিতে থাকেন—তাহলে তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন আসবে।

প্রশ্ন হলো, ফাওজুল কবির খানের মতো এরকম বুকে হাত দিয়ে এই সরকারের আর কতজন উপদেষ্টা বলতে পারবেন যে, রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসে তারা কোনো অন্যায় করেননি; কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেননি; নগদ না হলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধা নেননি; নিজেদের আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিতজনদের সুবিধা অনৈতিক সুবিধা দেননি; কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বিশেষ সুবিধা দেননি?

মূলত সরকার তার কাজগুলো ঠিকমতো করলে এবং কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলে সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে আসতো না। যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে একটা ঐকমত্য খেয়াল করা যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন, উপদেষ্টারা এক বছরেও তাদের নিজেদের সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে তুলে ধরছেন না এবং সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে কেন সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য করছেন না?

স্মরণ করা যেতে পারে, ক্ষমতা গ্রহণের দুই সপ্তাহের মাথায় গত বছরের ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, শিগগিরই তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের আয় ও সম্পদের বিবরণী জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন।

এরপর উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশে সরকার আলাদা করে একটি নীতিমালা তৈরি করেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পরেও উপদেষ্টাদের কারও আয় ও সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়নি। বরং কোনো কোনো উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একের পর এক অভিযোগ ওঠে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ‘সীমাহীন দুর্নীতির’ অভিযোগ তুলে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন সরকারের সাবেক একজন সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের না হয় চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু যারা আন্দোলন করে আজকে চেয়ারে বসেছেন, অন্তত আটজন উপদেষ্টার আমি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বুঝায় দিতে পারবো, আমার সচিব আছেন দুইজন, যে তারা (উপদেষ্টারা) সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।’

শুধু অন্যায় বা দুর্নীতি করা নয়, বরং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে না পারলেও সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন ওঠে। যেমন, এই সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে সৎ অথবা ধরা যাক তারা সকলেই অর্থনৈতিকভাবে সৎ, কিন্তু গত এক বছর ধরে তারা কি ঠিকমতো নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি পালন করতে পারছেন? প্রত্যেকে উপদেষ্টার ওপর একাধিক মন্ত্রণালয়। তারা কি এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, তাদের মন্ত্রণালয়গুলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ভালো চলছে বা ওই আমলের চেয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম কিছুটা হলেও কমেছে?

যদি কোথাও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না হয়; যদি সবকিছু আগের মতোই কিংবা আগের চেয়েও খারাপ চলতে থাকে, তাহলে একটি বিরাট অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের প্রাণ দেয়ার কোনো মানে নেই। যদি কোথাও সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সকল দলের সম্মতিতে গঠিত সরকারের ব্যর্থতা প্রকারান্তরে একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতাও বটে। যদি তাই হয়, তাহলে ব্যক্তির অর্থনৈতিক সততা বা ব্যক্তিজীবনে তার নির্মোহ থাকার কোনো মানে হয় না। কারণ তিনি যখন রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসেছেন, তাকে কাজটা করতে হবে। কাজ করতে না পারলে তার ব্যক্তিগত সততা মূল্যহীন। তখনেই তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে আসে।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

সানা/আপ্র/১৪/১০/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

সেফ এক্সিটের প্রশ্ন কেন?

আপডেট সময় : ০৫:৫৯:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
  • আমীন আল রশীদ

কোনো একটা বিশেষ স্থানে বা কাজে কেউ যখন নিজেকে ‘আনসেইফ’ মনে করে, তখনই তার ‘সেইফ এক্সিট’ প্রয়োজন হয়। সেইফ এক্সিটের সহজ বাংলা নিরাপদ প্রস্থান বা নিরাপদে সরে যাওয়া। তীর্যক ভাষায় বললে, কৌশলে সটকে পড়া। প্রশ্ন হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের কী এমন হলো যে তাদের সেইফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের বিষয়টি সামনে এলো? সরকারের উপদেষ্টারা কি নিরাপত্তাহীনতার ভেতরে আছেন বা তারা কি এমন কিছু করেছেন যে এখন তাদের দায়মুক্তি প্রয়োজন বা দ্রুত এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা চলে গেলেই বাঁচেন?

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি গঠিত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে এসেছিল। ওই সরকারও নানাবিধ সংস্কারে হাত দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, তখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘সংস্কারপন্থী’ বলে একটি আলাদা অংশ তৈরি হয়েছিল—যেটি গড়ে তোলার পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী। নির্যাতনের মুখে অনেক সিনিয়র নেতা তাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিষয়ে এমন সব তথ্য দিয়েছিলেন, যা রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়।

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগে তখন নতুন নেতৃত্ব আনার বিষয়টি সামনে আনা হয়। তখন আলোচনায় আসে এই দুই নেত্রীর সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি। দুর্নীতি মামলার ফাঁদ থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের নিরাপদে দেশ থেকে বের করে দেয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। এ সময় দুই নেত্রকেই গ্রেপ্তার করা হয়। বছরখানেক পরে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে রাজি হননি। তার মানে দেশের প্রধান দুই দলের দুই শীর্ষ নেত্রীর সেইফ এক্সিটের নামে রাজনীতি থেকে তাদের বিদায় করা সম্ভব হয়নি।

সেনা নিয়ন্ত্রিত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার—যারা এক-এগারো বা ওয়ান ইলেভেনের সরকার নামে পরিচিত ছিল, তারা দ্রুতই জনপ্রিয়তা হারায়, বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বাঁধে। বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় সংঘর্ষ। অনেক শিক্ষককেও তখন গ্রেপ্তার করা হয়।

ওই সরকার ভোটার তালিকা হালনাগাদ, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, না ভোটের বিধান চালুর মতো অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও তাদেরও সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ নির্বাচনের পরে যাতে এই সরকারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কোনো ধরনের বিচারের মুখোমুখি না হয়, সেজন্য সম্ভাব্য বিজয়ী দলের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছিল—এমন কথাও শোনা যায়। যদিও ওই সরকারের প্রধান ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এবং তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের কেউই আর পরবর্তীতে দেশে থাকেননি বা থাকতে পারেননি। তারা উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এটাও কি তাহলে একধরনের সেইফ এক্সিট?

এবার নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকারেরও সেইফ এক্সিট বা নিরাপদ প্রস্থানের প্রশ্নটি সামনে আসছে। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছে, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের (নিরাপদ প্রস্থান) কথা ভাবতেছে।’

নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। রাজনীতিতে তো বটেই। তবে এ বিষয়ে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘আমরা উপদেষ্টারা নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারও কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নেই। তবে বাংলাদেশের জাতি হিসেবে সেফ এক্সিটের প্রয়োজন আছে। গত ৫৫ বছর দুঃশাসন, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল। এই ভয়াবহ রাষ্ট্রকাঠামো থেকে সেফ এক্সিট প্রয়োজন।’

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট (নিরাপদ প্রস্থান) নিতে চান, এ বিষয়গুলো নাহিদ ইসলামকেই পরিষ্কার করতে হবে। উনি যদি কখনো পরিষ্কার করেন, তখন সেটি নিয়ে সরকারের বক্তব্যের কথা আসে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা, তাই সেফ এক্সিট আমার জন্য নয়। আমি এ দেশেই থাকব।’

ফেসবুক পোস্টে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান লেখেন, বাহাত্তরোর্ধ্ব বছর বয়সে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা তার জন্য গভীর দুঃখের বিষয় হবে। তিনি লিখেছেন, ‘নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করিনি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দিই নাই। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার সূত্রে, ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার নিশ্চিত সুযোগ গ্রহণ করিনি। তাই আজ ৭২ প্লাস বছর বয়সে আমাকে যদি সেফ এক্সিটের কথা ভাবতে হয়, তা হবে গভীর দুঃখের বিষয়!’

সেইফ এক্সিট প্রশ্নে সরকারের চার উপদেষ্টার মধ্যে ফাওজুল কবির খানের অবস্থান সবচেয়ে শক্ত। নিজের সততার ওপর আস্থাবান এই বয়স্ক মানুষটি বলছেন, নিজে পদে থেকে অন্যায় সুবিধা গ্রহণ করেননি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কাউকে ব্যবসা বা চাকরি দেননি। নিজের সীমিত সামর্থ্যের সবটুকু ব্যবহার করে জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে সত্যিই তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন নেই। প্রয়োজন নেই। তিনি নিজের কাছে পরিষ্কার। অর্থাৎ কেউ যদি অন্যায় না করেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, রাষ্ট্রীয় পদে থেকে কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করেন—তাহলে তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন উঠবে না।

কিন্তু যারা রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসেই সেই চেয়ারটাকে টাকা কামানোর মেশিন ভাবেন; একবার ক্ষমতা পেয়ে গেছেন বলে সারা জীবনের আখের গুছিয়ে নিতে চান; নিজের ও পরিবারের নামে-বেনামে ব্যবসার দরজা খুলে দেন; সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের পার্সেন্টিজসহ নানা খাত থেকে শত শত কোটি টাকা কামিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান; নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে সরকারি কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারকম সুবিধা নিতে থাকেন—তাহলে তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন আসবে।

প্রশ্ন হলো, ফাওজুল কবির খানের মতো এরকম বুকে হাত দিয়ে এই সরকারের আর কতজন উপদেষ্টা বলতে পারবেন যে, রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসে তারা কোনো অন্যায় করেননি; কাউকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে ঘুষ নেননি; নগদ না হলেও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সুবিধা নেননি; নিজেদের আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিতজনদের সুবিধা অনৈতিক সুবিধা দেননি; কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলকে বিশেষ সুবিধা দেননি?

মূলত সরকার তার কাজগুলো ঠিকমতো করলে এবং কোনো কোনো উপদেষ্টার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ না উঠলে সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে আসতো না। যেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে একটা ঐকমত্য খেয়াল করা যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তাদের অর্থনৈতিক সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। যদি তাই হয়, তাহলে প্রশ্ন, উপদেষ্টারা এক বছরেও তাদের নিজেদের সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে তুলে ধরছেন না এবং সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে কেন সম্পদের হিসাব দিতে বাধ্য করছেন না?

স্মরণ করা যেতে পারে, ক্ষমতা গ্রহণের দুই সপ্তাহের মাথায় গত বছরের ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, শিগগিরই তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা নিজেদের আয় ও সম্পদের বিবরণী জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন।

এরপর উপদেষ্টাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশে সরকার আলাদা করে একটি নীতিমালা তৈরি করেছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের এক বছর পরেও উপদেষ্টাদের কারও আয় ও সম্পদের হিসাব জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয়নি। বরং কোনো কোনো উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের একের পর এক অভিযোগ ওঠে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ‘সীমাহীন দুর্নীতির’ অভিযোগ তুলে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলেন সরকারের সাবেক একজন সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের না হয় চরিত্র খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু যারা আন্দোলন করে আজকে চেয়ারে বসেছেন, অন্তত আটজন উপদেষ্টার আমি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বুঝায় দিতে পারবো, আমার সচিব আছেন দুইজন, যে তারা (উপদেষ্টারা) সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত।’

শুধু অন্যায় বা দুর্নীতি করা নয়, বরং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে না পারলেও সেইফ এক্সিটের প্রশ্ন ওঠে। যেমন, এই সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে সৎ অথবা ধরা যাক তারা সকলেই অর্থনৈতিকভাবে সৎ, কিন্তু গত এক বছর ধরে তারা কি ঠিকমতো নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটি পালন করতে পারছেন? প্রত্যেকে উপদেষ্টার ওপর একাধিক মন্ত্রণালয়। তারা কি এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে, তাদের মন্ত্রণালয়গুলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে ভালো চলছে বা ওই আমলের চেয়ে দুর্নীতি ও অনিয়ম কিছুটা হলেও কমেছে?

যদি কোথাও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন না হয়; যদি সবকিছু আগের মতোই কিংবা আগের চেয়েও খারাপ চলতে থাকে, তাহলে একটি বিরাট অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের প্রাণ দেয়ার কোনো মানে নেই। যদি কোথাও সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সকল দলের সম্মতিতে গঠিত সরকারের ব্যর্থতা প্রকারান্তরে একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতাও বটে। যদি তাই হয়, তাহলে ব্যক্তির অর্থনৈতিক সততা বা ব্যক্তিজীবনে তার নির্মোহ থাকার কোনো মানে হয় না। কারণ তিনি যখন রাষ্ট্রীয় চেয়ারে বসেছেন, তাকে কাজটা করতে হবে। কাজ করতে না পারলে তার ব্যক্তিগত সততা মূল্যহীন। তখনেই তার সেইফ এক্সিটের প্রশ্নটি সামনে আসে।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

সানা/আপ্র/১৪/১০/২০২৫