প্রত্যাশা ডেস্ক: ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভার বাসিন্দা খাদিজা বেগম। অভাবের সংসারে বসে না থেকে নিজের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সফলতা পেয়েছেন। ঘাস থেকে গুড় তৈরি করে সংসারের অভাব দূর করেছেন। পরিবারে সচ্ছলতার পাশাপাশি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পৌরসভার নাওরা মিঠাপুর গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম। তিনি মাত্র ১০ শতক জমিতে বিশেষ ধরনের ঘাস চাষ করে তৈরি করছেন গুড়। এ উদ্ভাবনী উদ্যোগ তাকে শুধু আর্থিক সচ্ছলতাই এনে দেয়নি বরং স্থানীয়দের কাছেও নতুন উদ্যোক্তা ও অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
সূত্র জানায়, খাদিজা বেগমের তিন সন্তান। সংসারের অভাব তাকে নতুন কিছু করার প্রেরণা জোগায়। স্বামীর সীমিত আয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়লে বিকল্প আয়ের পথ খুঁজতে থাকেন। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ১০ শতক জমিতে লিপিয়া (লাল জাতের) নামক বিশেষ জাতের ঘাস চাষ শুরু করেন। এ ঘাস থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুড় তৈরির কৌশল শিখে নেন।
শুরুর দিকে ঘাসের রস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে গুড় তৈরি করেন। এ গুড় তৈরি করে এলাকায় সাড়া ফেলেন। প্রতি কেজি গুড় ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। গুড় ও ঘাস বিক্রি করে দৈনিক গড় আয় প্রায় ১৩০০ টাকা। এক কেজি গুড় তৈরি করতে ৬০টি ঘাসের গাছ লাগে। যার ওজন প্রায় ১৫ কেজি। প্রতিটি গাছ লম্বায় প্রায় ৮ ফুট, আখের চেয়ে একটু চিকন। ৬০টির মতো ঘাসে রস হয় ৬-৭ কেজি। এতে ১ কেজি গুড় হয়।
এ ছাড়া তিনি ১ একর জমিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ফল ও সবজি চাষ করছেন। তার বাগানে আপেল, পেঁপে, আঙুর এবং সৌদি আরবের খেজুর গাছও আছে। এসব ফল ও সবজি বিক্রি করে তিনি প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ টাকার মত আয় করেন। সব মিলিয়ে তারা এখন স্বাবলম্বী। তাদের অভাবের সংসারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। সন্তানেরাও এখন ভালোভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছেন।
খাদিজা বেগম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রথমদিকে এসব দেখে অনেকেই হাসাহাসি করতো। কিন্তু আমি তাতে দমে যাইনি। হাল ছাড়িনি। এখন আমার এই কাজ দেখে অনেকেই উৎসাহ পাচ্ছেন। আমি চাই আমার মতো আরো অনেক নারী সামনে আসুক এবং স্বাবলম্বী হোক।’
খাদিজা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি পল্লী বিদ্যুতে ছোট পদে চাকরি করি। এতে সংসার চলে না। চাকরির পাশাপাশি স্ত্রীকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করি। তার সাফল্যে আমি গর্বিত। ১০ একর জায়গায় ঘাস বুনতে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। গুড় তৈরিতে খরচ হয় ৩ হাজার টাকা। এতে পনেরো হাজার টাকার গুড় বিক্রি করা সম্ভব। গুড় খেতে আখের গুড়ের মতো। তবে আখের গুড় থেকে একটু লবণাক্ত বেশি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন করে বেশি জমিতে ঘাস রোপণ করেছি। এই নতুন ঘাস দিয়ে আবার গুড় তৈরির করবো। এ ছাড়া বিএসটিআইতে আবেদন করেছি। আমার এই ঘাসের গুড় মানবদেহের কোনো ক্ষতি করে কি না। যদি ক্ষতিকর না হয়, তাহলে বড় পরিসরে শুরু করবো।’
স্থানীয় বাসিন্দা নুরু তালুকদার বলেন, ‘আমি কয়েক কেজি গুড় চারশ টাকা দরে কিনেছি। বাড়ির সবাই খেয়ে দেখেছি। স্বাদে-মানে বেশ ভালো। এই গুড়ের স্বাদ অনন্য। স্বাস্থ্যসম্মত এবং বিশুদ্ধ হওয়ায় আমি নিয়মিত এখান থেকে গুড় সংগ্রহ করি।’
ফারজানা আক্তার বলেন, ‘আমি দুই কেজি গুড় কিনে নিয়েছি। বাড়ির সবাই স্বাদ নিয়েছি। যদিও আখের গুড়ের থেকে একটু নোনতা, তবে ঘাসের গুড় না জেনে খেলে টের পাওয়ার উপায় নেই। এ ছাড়া এ গুড় খেয়ে আমাদের কোনো প্রকার ক্ষতি হয়নি।’
আলফাডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তুষার সাহা বলেন, ‘খাদিজা বেগমকে শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তার সাফল্য এলাকার জন্য দৃষ্টান্ত। তার দেখাদেখি অনেক নারী কৃষিকাজে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি। তার পরিশ্রম ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রমাণ করে, সঠিক সুযোগ ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে নারীরাও যে কোনো ক্ষেত্রে সফল হতে পারেন।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নিয়াজ মুস্তাফি চৌধুরী বলেন, ‘পুষ্টিমান উদ্ভিদজাত প্রাণীদেহের জন্য উপকারী। তবে ঘাসে যদি বিষাক্ত কীটনাশক ও গ্রোথ হরমোন প্রয়োগ না করে সঠিক প্রক্রিয়ার মধ্যে রস থেকে গুড় তৈরি করেন, তাহলে এটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়।’
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপপরিচালক (ফুড অ্যান্ড ব্যাক্ট.) ও অফিস প্রধান মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘সাধারণত আখের গুড়কে আমরা গুড় বলে থাকি। ঘাসের রস থেকে যেটা তৈরি হয়, সেটা আসলে গুড় নয়। সে ক্ষেত্রে আখের গুড় ছাড়া লাইসেন্স দেওয়ার নীতিমালা নেই। ঘাসের গুড় মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না জানা নেই। সে ক্ষেত্রে ঢাকার সায়েন্সল্যাব থেকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’
এসি/আপ্র/১৪/১০/২০২৫