প্রযুক্তি ডেস্ক: দীর্ঘ সময় ধরে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন, আমাদের সূর্য ধীরে ধীরে ঘুমের মতো এক নিস্তব্ধ অবস্থায় চলে যাচ্ছে। আর এ সময়টি ‘গভীর সৌর ন্যূনতম’ নামে পরিচিত। এর শুরু হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে এবং শেষ হয় ২০০৮ সালে।
কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা, সূর্যের এই শান্ত অবস্থা হয়ত কয়েক শত বছর ধরে চলবে। তবে ২০০৮ সালে হঠাৎ অদ্ভুতভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে সূর্য, যেন নিজেই ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিল নিজেকে। তার পর থেকে সূর্য ক্রমশ আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সূর্যে আরো বেশি প্লাজমা বিস্ফোরণ ও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র লক্ষ্য করেছেন নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির গবেষকরা, যা সূর্যের কার্যকলাপ বাড়ারই ইঙ্গিত বলে দাবি তাদের। এর মানে হচ্ছে সূর্য থেকে আরো ঘন ঘন সৌরচ্ছ্বটা, করোনাল ভর নির্গমন ও ভূ-চৌম্বক ঝড় ঘটতে পারে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে প্রযুক্তি বিষয়ক সাইট স্ল্যাশগিয়ার।
গবেষকরা বলছেন, এর প্রমাণও এরইমধ্যে মিলেছে, বিশেষ করে গত বছর সূর্য গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌর ঝড় তৈরি করেছিল, যার ফলে উত্তর মেরুর আলো এতটাই দক্ষিণে পৌঁছেছিল যে, মেক্সিকো পর্যন্ত তা দেখা গিয়েছে।
পৃথিবীতে আমরা নর্দার্ন লাইট বা অরোরার সুন্দর যে দৃশ্য দেখি তা পুরো ঘটনার একটি ছোট অংশ মাত্র। সৌর ঝড় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রযুক্তির জন্য বড় হুমকি হতে পারে। বিদ্যুৎ সরবরাহের নেটওয়ার্ক, জিপিএস এবং রেডিও সিগনাল সৌরচ্ছ্বটার প্রভাবে সহজেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এসব সৌর ঝড় নাসার আর্টেমিস মিশনকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। নাসার এ মিশনের লক্ষ্য মানুষকে আবার চাঁদে পাঠানো ও পরবর্তী সময়ে মঙ্গল গ্রহে পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া। এ কারণে বিভিন্ন মহাকাশ সংস্থা এখন নিজেদের আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যবস্থা উন্নত করতে কাজ করছে, যাতে ভবিষ্যতে মহাকাশে আরো ভয়াবহ ‘আবহাওয়ার’ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে পারেন তারা।
মানবদেহের ওপর প্রভাব: বর্তমান গবেষণা অনুসারে, সৌরচ্ছ্বটা আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলে না। ফলে এই নিয়ে চিন্তার তেমন কিছু নেই। কিছু বিজ্ঞানী সূর্যের কার্যকলাপের সঙ্গে হৃদরোগ, মাথাব্যথা ইত্যাদি সমস্যার সম্ভাব্য সম্পর্ক খুঁজে দেখেছেন। তবে এখনও পর্যন্ত এর প্রমাণ খুব সীমিত।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সুরক্ষার নিচে যারা রয়েছেন তাদের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য প্রভাব হতে পারে কেবল সিগনাল দুর্বল হওয়া বা হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সৌর ঝড়ের প্রধান প্রভাব পড়তে হঠাৎ ব্ল্যাকআউট বা বিদ্যুৎ চলে যাওয়া।
ঝুঁকিতে পড়বে অনেক প্রযুক্তি: এ সৌর ঝড়ের কারণে মানুষের শরীর পুড়ে যাবে বা এক্স-রে রশ্মিতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনটি নয়। কারণ, আমাদের পৃথিবীর ঘন বায়ুমণ্ডল ও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র এক ধরনের প্রাকৃতিক ঢালের মতো আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই এর থেকে সুরক্ষা দেবে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি এ সৌড়ঝড় থেকে সুরক্ষা পাবে না। সৌর ঝড় তৈরি হলে সূর্যের জটপাকানো চৌম্বক ক্ষেত্র টানতে টানতে হঠাৎ ছিঁড়ে গিয়ে আবার সংযুক্ত হয়। এ প্রক্রিয়ায় সূর্য থেকে প্রচণ্ড শক্তি ও বিকিরণ বেরিয়ে আসে।
এ বিকিরণ ও শক্তির বিস্ফোরণ কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে। তখন এটি স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট সংযোগ, এমনকি বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ঘটনাটি প্রথমে শুনতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতো মনে হতে হলেও এর ঝুঁকি একেবারেই বাস্তব। ১৯৮৯ সালে একটি সৌর ঝড়ের কারণে তৈরি ভূ-চৌম্বক ক্রিয়া কেবল ৯০ সেকেন্ডের মধ্যেই কানাডার কুইবেক প্রদেশে লাখ লাখ মানুষের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল।
এখনকার পৃথিবী আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। ফলে উচ্চ-তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিও সিগনাল, যেমন– বিমান চলাচল, জাহাজ পরিবহন ও জরুরি যোগাযোগে ব্যবহৃত সংকেত– এসবই সৌর ঝড়ের কারণে এখন বড় ঝুঁকিতে রয়েছে, এমনকি বিমান বা রাইড-শেয়ারিং অ্যাপে ব্যবহৃত জিপিএসও পুরোপুরি বিকল হয়ে যেতে পারে।
পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে থাকা বিভিন্ন স্যাটেলাইটও সৌর ঝড়ের ক্ষতির শিকার হতে পারে। কারণ এগুলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থান করেছে। শক্তিশালী সৌরচ্ছ্বটা ও সৌর ঝড় স্যাটেলাইটের বৈদ্যুতিক সার্কিট পুড়িয়ে ও এদের কাজ বন্ধ করে দিতে পারে, এমনকি এদের আয়ু কমিয়ে দিতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী বছরগুলোতে এ ধরনের সৌর ঝড় আরো ঘন ঘন ঘটবে। ফলে এসব প্রযুক্তিকেও সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে ও আরো টেকসই হতে হবে, বিশেষ করে এখন যখন মহাকাশে হাজার হাজার স্যাটেলাইট ঘুরছে।
সানা/আপ্র/১৩/১০/২০২৫