শেরপুর সংবাদদাতা: শেরপুর পৌর শহরের কালীর বাজারে মা ভবতারা কালীমন্দির চত্বরে ‘পাখির বাসায় দেবী দুর্গা’ এমন ভিন্ন শিল্পকর্ম নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। পরিবেশ, প্রকৃতি আর পাখি সংরক্ষণের বার্তা ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় মার্চেন্ট ক্লাব সাজিয়েছে পূজামণ্ডপটি।
মার্চেন্ট ক্লাব সূত্রে জানা যায়, অর্ধশতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি প্রতিবছরই নতুন কিছু শিল্পকর্ম দিয়ে দুর্গাপূজা আয়োজন করে। এবার দুর্গোৎসব উদযাপন করছে পরিত্যক্ত বাক্স, কার্টন কাগজ, নারকেলের ছোবড়া, পাট ও কাঠের গুড়া দিয়ে তৈরি প্রতিমা আর সাজসজ্জায়।
আয়োজকরা জানিয়েছেন, এবার ৫১ বছরে পদার্পণ করল তাদের সর্বজনীন দুর্গোৎসব। আর এবারের থিম ‘পাখি সংরক্ষণ মানে প্রকৃতি সংরক্ষণ’।
মণ্ডপের প্রবেশপথ সাজানো হয়েছে পাখির পালকের মোটিফে। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বাবুই পাখির বাসার আদলে তৈরি মণ্ডপে বসানো হয়েছে দুর্গার প্রতিমা। তারপর একটু ভেতরেই মশারির কাপড়ে অনেকগুলো পাখি বসে আছে। এর তিন পাশে কার্টন ও কাঠের গুড়া দিয়ে সাজানো হয়েছে শতশত পাখির বাসা। বাসা থেকে উঁকি দিচ্ছে পাখিরা। তুলা ও কাগজে তৈরি পাখিদের ঝাঁক যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে কিচিরমিচির মধুর শব্দ।
মহালয়ার পর থেকেই দর্শনার্থীরা মণ্ডপটি দেখতে ভিড় করেন। কেউ এসেছেন নতুন এ আয়োজন দেখতে আবার কেউবা প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে সেলফি তুলছেন। ভেতরে কৃত্রিম পাখির কিচিরমিচির শব্দ সবার মনকেই আকৃষ্ট করছে।
শেরপুর সরকারি ভিক্টোরিয়া স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী দেব মালাকার বলেন, পরিবেশ দিনদিন বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। আর এর জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন পুরো শেরপুর শহরের নয়ানী বাজার, খরমপুর, নিউমার্কেট, মুন্সিবাজার, ঘোষপট্টি, তিনানী বাজারের কয়টা গাছ আছে? নেই বললেই চলে। তাহলে আমাদের পাখিগুলো কোথায় বসবে, তারা কোথায় যাবে? প্রকৃতি রক্ষায় এই মণ্ডপ হতে আমরা একটি বার্তা দিতে চাই, আসুন আমরা সবাই সম্মিলিতভাবে প্রাণ প্রকৃতি রক্ষা করি।
বন্ধুদের নিয়ে মন্দিরে ঘুরতে এসেছে নবারুণ পাবলিক স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী অপূর্ব সাহা। সে জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে নানান অশনি লক্ষণ। যার কারণে ঠিকমতো বৃষ্টিপাত হয় না, শীতের সময় শীত হয় না, আবার তীব্র গরম পড়ে সবমিলিয়ে প্রকৃতি ভালো নেই। মানুষের নানান কার্যকলাপে আজ প্রকৃতির এ হাল। অতিরিক্ত বৃক্ষ নিধনে আজ পাখিসহ বিভিন্ন প্রাণী হারিয়েছে তাদের বাসস্থান।এ মণ্ডপ হতে প্রকৃতি রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান করা হয়েছে।
প্রতিমাশিল্পী তরুণ নিতাই মালাকার বলেন, প্রকৃতি হলো আমাদের মা। মা-ই তো দেবী। তাই এবারের থিম করেছি পাখি সংরক্ষণ, মানে প্রকৃতি সংরক্ষণ। বন বাঁচাও, পাখি রক্ষা করো— এমন বার্তাই আমরা দিতে চেয়েছি। সবকিছুই সাজানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে। তিন সপ্তাহ ধরে তৈরি করা এ মণ্ডপে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
মার্চেন্ট ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক টুকন সাহা বলেন, মন্দিরের দুটি গাছে সারাবছর পাখির কলরব থাকে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকে চারিপাশ। পাখির আবাসস্থল ধীরে ধীরে নষ্ট হচ্ছে। তাই এবারের পূজায় তারা সচেতনতার বার্তা দিতে চেয়েছেন। তাদের ক্লাব বরাবরই ব্যতিক্রমী থিম নিয়ে পূজার আয়োজন করে থাকে।
শেরপুর বার্ড ক্লাবের সভাপতি মুগনিউর রহমান মনি বলেন, মার্চেন্ট ক্লাব সব সময় ভিন্নভাবে মণ্ডপ সাজায়। তবে এবার পাখি ও পরিবেশ সুরক্ষার বার্তা দিচ্ছে। দিনদিন গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, বিশেষ করে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে এ অবস্থা।
জেলা পূজা উদযাপন ফ্রন্টের সভাপতি জিতেন চন্দ্র মজুমদার বলেন, জেলায় এবার ১৭২টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর মা ভবতারা কালীমন্দিরের ভিন্ন একটি আয়োজন করেছে। যা ইতোমধ্যে জেলায় সাড়া ফেলেছে। এদিকে আনসার, পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনীসহ সবাই মিলে পূজার সার্বিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। বিগত ফ্যাসিবাদী আমলের চেয়ে এবার অত্যন্ত সুন্দর ও প্রাণবন্তভাবে পূজা চলছে।
জেলা পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শারদীয় দুর্গোৎসব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও তৎপর রয়েছেন।
এসি/আপ্র/২৯/০৯/২০২৫