ঢাকা ০১:৪৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হারিয়ে গেছে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ‘পালকি’

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • ৭৪ বার পড়া হয়েছে

বারী সুমন : পালকি এক ধরনের বিলাসবহুল যানবাহন যাতে সাধারণত ধনিকগোষ্ঠী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি ঘাড়ে বহন করে পালকিকে ঝুলন্ত অবস্থায় স্থানান্তরে অগ্রসর হয়। যারা পালকির ভার বহন করেন, তারা পালকি বেহারা নামে পরিচিত। প্রথমদিকে দেব-দেবীকে আরোহণ কিংবা দেবমূর্তি বহনের উদ্দেশ্যে এরূপ যানবাহন তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক মন্দিরেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরার দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এতে করে মুখ্যত ইউরোপীয় উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলাগণ ভারতীয় উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত চলাফেরা করতেন। আধুনিককালে পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে।
প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে।
একসময় বাংলাদেশে পালকির ব্যাপক প্রচলন ছিলো। রিক্সা বা চাকা যুক্ত অন্যান্য যানবাহন যখন ছিলোনা তখন পালকিই ছিলো যাতায়তের একমাত্র বাহন। তবে সবাই এই পালকি ব্যবহার করতে পারতো না। শুধু মাত্র ধরী, শৌখিন ব্যক্তিরাই এই পালকি ব্যবহার করতো। বেহারা গণ কাঁধে করে পালকি নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতো। পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ বিয়ে শাদীর কাজে পালকি ব্যবহৃত হতো। বর পালকি চড়ে যেতো তারপর নতুন বউকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে আসতো। আমরা কেবল বিয়ে শাদীর কাজে পালকির ব্যবহারটুকু দেখেছি। চৌকোণা কাঠের কারুকার্য মন্ডিত ছোট্ট একটি ঘরের মতো বাহন বিশেষ। দুপাশে দুটি দরজা থাকতো। দরজাগুলো কাপড় দ্বারা ঢাকা থাকতো। পালকির এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত শক্ত বাঁশ বা কাঠের একটি দন্ড থাকতো। যার মধ্যে বেহারা পালকিটিকে কাঁধে নিতো। দু’পাশে দুজন করে মোট চারজন বেহারা থাকতো। বেহারা সাধারণত সাদা ধুতি পড়তো, মাথায় এবং কোমরে লাল গামছা বাধা থাকতো। হাতে থাকতো একটি করে লাঠি। পালকি নিয়ে চলার সময় বেহারা বিভিন্ন ধরণের গান বা সুর করে ছড়া কাটতো, যা শুনতে অনেক ভালো লাগতো। রাজবাড়িতে নাকি একসময় হাতির দাঁতের পালকি দেখা যেতো।
পালকির ভেতরে বসে পুরোটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্বামীর বাড়ি আসতো স্ত্রী। এই পালকির ভেতরে বসে তার মনে কত ভয়-ভীতি, অজানা আশঙ্কা, কান্না কত কথা, কতো স্মৃতি যে পালকির ভেতরে পড়ে থাকতো তা কেবল সেই জানতো, যে পালকি চড়ে আসতো। বউদের সম্মানের সাথে আনার জন্য পালকি ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। আর কিছু পরিবার ছিলো যারা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় জড়িত ছিলো। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। বেহারা কম থাকার কারণে পালকির চাহিদা ছিলো প্রচুর। প্রতিদিনই তাদের কোন না কোন জায়গায় যেতে হতো। পালকির দরকার পড়লে বেশ কয়েকদিন আগে বেহারাদের সাথে যোগাযোগ করতে হতো। তা না হলে পালকি পাওয়া যেতোনা। কারণ হয়তো সেদিন অন্য কেউ পালকির জন্য বায়না করে রেখেছে। এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিলোনা। ফোন সোবাইল ছিলোনা। তাই যাদের পালকি দরকার তারা সপ্তাহ খানেক আগেই বেহারাদের বাড়িতে গিয়ে পালকির জন্য বায়না করে আসতো। বিয়ে উপলক্ষে পালকিকে রঙিণ কাগজের ঝালর কেটে সাজানো হতো। বেহারাদের উহুমনা উহুমনা সুরে মুখরিত করতো তাদের চলার পথ। যে পথে পালকি নিয়ে যেতো, সেদিকের আশেপাশের বাড়ির ছোট বড় সবাই বেড়িয়ে আসতো পালকি দেখার জন্য আর তাদের সেই পালকি চলার সময় ছড়া বা গান শোনার জন্য।
বর্তমান সময়ে পালকি আর চোখে পড়েনা। বর্তমান প্রজন্মও পালকির সাথে পরিচিত নয়। যাদুঘরে কিছু পালকির নমুনা সংগ্রহ করা আছে। একমাত্র যাদুঘরেই এখন পালকির দেখা মিলে। কিছু কিছু প্রদর্শনীতে প্রতিকী পালকি প্রদর্শন করা হয়। আবার কিছু কিছু লোকজ অনুষ্ঠানে প্রতিকী পালকি ব্যবহার করে পালকির ব্যবহার সস্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেওয়া হয়। তবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পালকি একটি কল্পণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সম্ভব হলে আমাদের স্মৃতি পরিষদ, স্কুল-কলেজ, পাঠাগার কিংবা সংস্কৃতাঙ্গণে প্রতিকী পালকি সংরক্ষণ করে এর ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালকি সস্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে তারা।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হারিয়ে গেছে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ‘পালকি’

আপডেট সময় : ০৯:৪৯:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

বারী সুমন : পালকি এক ধরনের বিলাসবহুল যানবাহন যাতে সাধারণত ধনিকগোষ্ঠী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে থাকে। চাকাবিহীন যানবাহন হওয়ায় কয়েকজন ব্যক্তি ঘাড়ে বহন করে পালকিকে ঝুলন্ত অবস্থায় স্থানান্তরে অগ্রসর হয়। যারা পালকির ভার বহন করেন, তারা পালকি বেহারা নামে পরিচিত। প্রথমদিকে দেব-দেবীকে আরোহণ কিংবা দেবমূর্তি বহনের উদ্দেশ্যে এরূপ যানবাহন তৈরি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। অনেক মন্দিরেই পালকি সহযোগে দেবতাদের বহনের দৃশ্যমালা ভাস্কর্য আকারে তুলে ধরার দৃশ্য চিত্রিত করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এতে করে মুখ্যত ইউরোপীয় উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ও ভদ্রমহিলাগণ ভারতীয় উপমহাদেশে রেলগাড়ি প্রবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত চলাফেরা করতেন। আধুনিককালে পালকির ব্যবহার নেই বললেই চলে।
প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান ইত্যাদি নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে।
একসময় বাংলাদেশে পালকির ব্যাপক প্রচলন ছিলো। রিক্সা বা চাকা যুক্ত অন্যান্য যানবাহন যখন ছিলোনা তখন পালকিই ছিলো যাতায়তের একমাত্র বাহন। তবে সবাই এই পালকি ব্যবহার করতে পারতো না। শুধু মাত্র ধরী, শৌখিন ব্যক্তিরাই এই পালকি ব্যবহার করতো। বেহারা গণ কাঁধে করে পালকি নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতো। পরবর্তী সময়ে বেশিরভাগ বিয়ে শাদীর কাজে পালকি ব্যবহৃত হতো। বর পালকি চড়ে যেতো তারপর নতুন বউকে পালকিতে চড়িয়ে নিয়ে আসতো। আমরা কেবল বিয়ে শাদীর কাজে পালকির ব্যবহারটুকু দেখেছি। চৌকোণা কাঠের কারুকার্য মন্ডিত ছোট্ট একটি ঘরের মতো বাহন বিশেষ। দুপাশে দুটি দরজা থাকতো। দরজাগুলো কাপড় দ্বারা ঢাকা থাকতো। পালকির এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত শক্ত বাঁশ বা কাঠের একটি দন্ড থাকতো। যার মধ্যে বেহারা পালকিটিকে কাঁধে নিতো। দু’পাশে দুজন করে মোট চারজন বেহারা থাকতো। বেহারা সাধারণত সাদা ধুতি পড়তো, মাথায় এবং কোমরে লাল গামছা বাধা থাকতো। হাতে থাকতো একটি করে লাঠি। পালকি নিয়ে চলার সময় বেহারা বিভিন্ন ধরণের গান বা সুর করে ছড়া কাটতো, যা শুনতে অনেক ভালো লাগতো। রাজবাড়িতে নাকি একসময় হাতির দাঁতের পালকি দেখা যেতো।
পালকির ভেতরে বসে পুরোটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে স্বামীর বাড়ি আসতো স্ত্রী। এই পালকির ভেতরে বসে তার মনে কত ভয়-ভীতি, অজানা আশঙ্কা, কান্না কত কথা, কতো স্মৃতি যে পালকির ভেতরে পড়ে থাকতো তা কেবল সেই জানতো, যে পালকি চড়ে আসতো। বউদের সম্মানের সাথে আনার জন্য পালকি ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। আর কিছু পরিবার ছিলো যারা বংশ পরম্পরায় এই পেশায় জড়িত ছিলো। তবে তাদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। বেহারা কম থাকার কারণে পালকির চাহিদা ছিলো প্রচুর। প্রতিদিনই তাদের কোন না কোন জায়গায় যেতে হতো। পালকির দরকার পড়লে বেশ কয়েকদিন আগে বেহারাদের সাথে যোগাযোগ করতে হতো। তা না হলে পালকি পাওয়া যেতোনা। কারণ হয়তো সেদিন অন্য কেউ পালকির জন্য বায়না করে রেখেছে। এখনকার মতো যোগাযোগ ব্যবস্থাও তেমন ভালো ছিলোনা। ফোন সোবাইল ছিলোনা। তাই যাদের পালকি দরকার তারা সপ্তাহ খানেক আগেই বেহারাদের বাড়িতে গিয়ে পালকির জন্য বায়না করে আসতো। বিয়ে উপলক্ষে পালকিকে রঙিণ কাগজের ঝালর কেটে সাজানো হতো। বেহারাদের উহুমনা উহুমনা সুরে মুখরিত করতো তাদের চলার পথ। যে পথে পালকি নিয়ে যেতো, সেদিকের আশেপাশের বাড়ির ছোট বড় সবাই বেড়িয়ে আসতো পালকি দেখার জন্য আর তাদের সেই পালকি চলার সময় ছড়া বা গান শোনার জন্য।
বর্তমান সময়ে পালকি আর চোখে পড়েনা। বর্তমান প্রজন্মও পালকির সাথে পরিচিত নয়। যাদুঘরে কিছু পালকির নমুনা সংগ্রহ করা আছে। একমাত্র যাদুঘরেই এখন পালকির দেখা মিলে। কিছু কিছু প্রদর্শনীতে প্রতিকী পালকি প্রদর্শন করা হয়। আবার কিছু কিছু লোকজ অনুষ্ঠানে প্রতিকী পালকি ব্যবহার করে পালকির ব্যবহার সস্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেওয়া হয়। তবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পালকি একটি কল্পণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। সম্ভব হলে আমাদের স্মৃতি পরিষদ, স্কুল-কলেজ, পাঠাগার কিংবা সংস্কৃতাঙ্গণে প্রতিকী পালকি সংরক্ষণ করে এর ঐতিহ্য সম্পর্কে ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাহলে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী পালকি সস্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে তারা।