ঢাকা ০৩:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভক্তদের সাথে ‘কাঁদল’ আকাশ

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ফরিদা পারভীনের অনন্তে যাত্রা

  • আপডেট সময় : ০৯:৩৭:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৫০ বার পড়া হয়েছে

ফরিদা পারভীন -ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: ঢাকায় তখন মুষলধারে বৃষ্টি। বর্ষণ উপেক্ষা করেই অনেকে এলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লালনের গানের ভক্ত রইস উদ্দীন বললেন, ‘গানের পাখি’ ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে ‘আকাশও যেন কাঁদছে’। ফরিদা পারভীনের বিদায়ের দিনের আকাশও যেন সত্যি সত্যি কেঁদেছে দিনভর!

‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানের বাণীর মতোই পাখিশূন্য হলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। যার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষকে ছুঁয়ে চলেছে পাঁচ দশক ধরে, যার নাম হয়েছে লালনের গানের সমার্থক, সেই সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন জাগতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ঢাকার মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয় বলে সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন তিনি।

এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ফরিদা পারভীনকে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পরই নেওয়া হয় আইসিইউতে। পরে তাঁকে লাইফ সাপোর্টেও নেওয়া হয়; সেখান থেকে আর ফেরানো গেল না শিল্পীকে।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক শিল্পীকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে যান পরপারে।

প্রধান উপদেষ্টার শোক: লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক শোক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক নানা ধরনের গান করলেও শ্রোতাদের কাছে ফরিদা পারভীনের পরিচিতি ‘লালনকন্যা’ হিসেবে। এতে বলা হয়, পাঁচ দশক ধরে তার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। তার গান আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্লীন দর্শন ও জীবনবোধকেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছিল। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গান থেকে দূরে থাকেননি ফরিদা পারভীন। সঙ্গীতের প্রতি তার এই অনুরাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পী বাংলাদেশের সংগীত জগতে যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিত্যনতুন চিন্তা ও সৃষ্টির খোরাক জোগাবে। প্রধান উপদেষ্টা লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন: কথা ছিল, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজন শুরু হবে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায়। তবে তেজকুনি পাড়ার বাড়ি থেকে ফ্রিজিং গাড়িতে করে কফিন পৌঁছাতে বেলা সোয়া ১১টা বেজে যায়। ততক্ষণে শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। ফরিদা পারভীনের গানের ভক্তরাও অনেকে এসেছেন শহরের নানা প্রান্ত থেকে।
পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। জাতীয় কবিতা পরিষদ, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল- জাসাস, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় শিল্পীর কফিনে।
এই শিল্পীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভক্তদের অনেকের চোখ ভিজে এলো, কণ্ঠে ভর করলো আবেগ। কেরানীগঞ্জ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছিলেন ‘তৌহিদের পাঠশালা’ নামে একটি ভাববাদী প্রতিষ্ঠানের প্রধান খাদেম আলী আরিফ আকবর। ভাবতত্ত্বের এই অনুরাগী বলছিলেন, বাংলার সহজীয়া যে ভাববাদের চর্চা, তাকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়েছেন ফরিদা পারভীন। গুরুবাদী শিক্ষা, মুর্শিদ ভজনের শিক্ষার প্রচার করেছেন আজন্ম। এজন্যই তিনি ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।

আখড়াবাড়ি থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে ফরিদা পারভীন: শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ফরিদা পারভীন দুইটা ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় শিল্পী। সংগীতজীবনের প্রথম দিকে তিনি আধুনিক গানের চর্চা করেছেন। পরে তিনি লালন সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন। লালনের গান পরিবেশনায় উনার যে গায়কী, তাতে একটা ‘মধ্যবিত্ত ভাব’ আছে। এই ভাব দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছেন। লালনসংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি মধ্যবিত্তের কাছে এমন উচ্চতায় গিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা আসলে হয় না। শেষের দিকে তিনি আসলে লালন সাধক হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন। তিনি বলেন, আরেকটা বিশেষ দিক বলা যায়, একজন শিল্পীই যে সংস্কৃতির একটা ভিন্ন মাত্রা তৈরি করতে পারেন, তার উদাহরণ কিন্তু খুব বেশি নেই। ফরিদা পারভীন আমাদের সেরকম উদাহারণ, তিনি একাই ঘরানা তৈরি করতে পেরেছেন।
লালনের গান আখড়াবাড়ি থেকে তুলে এনে ফরিদা পারভীন প্রতিটি বাঙালীর ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন গবেষক তপন বাগচী। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের ফাঁকে তিনি বলেন, আখড়ার শিল্পীদের আপত্তিকেও ফরিদা পারভীন কখনো কখনো তোয়াক্কা করেননি। তার গায়কি আখড়ার ঘরানা থেকে কিছুটা আলাদা হলেও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করার মতো উপকরণ তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন।

লালনের গান গাওয়ার পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় হারিয়ে গেছে মন্তব্য করে তপন বাগচী বলেন, আমরা তাকে চিনতাম আধুনিক গানের অনেক বড় একজন শিল্পী হিসেবে। ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’ গানটি তার কণ্ঠে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই গানটির গীতিকার আবু জাফর তার প্রথম স্বামী। তাকেও আজকের দিনে স্মরণ করি। কারণ গীতিকার জাফরের লেখা গানেই রাজশাহী বেতারের মাধ্যমে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান ফরিদা পারভীন। তপন বাগচী বলেন, এই পুরস্কার দেওয়ার সময় ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটি টুলস ব্যবহার করে ওই পুরস্কার কর্তৃপক্ষ দেখিয়েছিলেন যে- বিশ্বের সেরা সংগীতশিল্পীদের কাতারেই উনি। ফরিদা পারভীন সংগীতের একটি বড় ধারার সাধক। তিনি শুধু গান গাওয়া নয়, গানের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি লালনের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা এখন কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা জানি না। তার মতো একজন গুণি মানুষকে শ্রদ্ধা জানাই।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক চিত্রনায়ক উজ্জ্বল বলেন, কিংবদন্তি একজন সংগীতশিল্পীকে হারালাম আমরা। এই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। উনার কোনো রিপ্লেসমেন্ট হবে না। কিন্তু এমন গুণি শিল্পী যেন আমরা আরো পেতে পারি, তার জন্য সবাইকে নিয়ে পরিবেশ গড়তে হবে। শহীদ জিয়াউর রহমান নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুদের প্রতিভাকে সামনে আনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার নতুন কুঁড়ি আবার শুরু করেছে। শিশুদের নিয়ে আমাদের এরকম আরো কাজ করতে হবে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলেন, শিল্পচর্চা যে সাধনার বিষয়, এই ব্যাপারটা আমরা ভুলেই গেছি। ফরিদা পারভীন এমন একজন মানুষ, যিনি জীবনটা সাধনার মধ্যেই কাটিয়েছেন। ফরিদা পারভীন আজকে যে অবস্থানে এসেছেন, তা হওয়ার জন্য অন্তত ৫০ বছর পার করতে হয়েছে। আমি এখানে এসে এটাই কেবল ভাবছিলাম, যে আমাদের মহান মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে একে একে চলে চলে যাচ্ছেন। আমাদের প্রজন্মের কেউ কি এমন উচ্চতায় কখনো যেতে পারব? এমন সাধনায় নিমগ্ন থাকা কি আমাদের মধ্যে আছে? ফরিদা পারভীনের কাজগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত এবং তার ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোত জন্য তার কাজগুলো সংরক্ষণের উদ্যেগ নেওয়া উচিত।

বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম। তিনি জানান শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর জানাজার পর কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে কফিন। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ফরিদা পারভীন।

লালনের গানে এক জীবন: ১৯৫৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা বেড়ে ওঠেন কুষ্টিয়ায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা গৃহিনী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া ফরিদার গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। বাবা-মায়ের উৎসাহে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া ফরিদার ইচ্ছা ছিল নজরুলসংগীতের শিল্পী হওয়ার। এগোচ্ছিলেনও সেই পথেই।
রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। গেয়েছেন আধুনিক ও দেশের গানও। তরুণ বয়সে লালনের গান একরকম ‘উপেক্ষিতই’ ছিল তার কাছে। তবে সংগীতের অন্য সব ধারাকে পাশে সরিয়ে কীভাবে, কোন তাড়নায় তিনি লালনের গানে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন সেই গল্প ফরিদা শুনিয়েছিলেন এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। ফরিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার বছরখানের পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে গুরু মোকছেদ আলী তাকে অনুরোধ করেছিলেন লালনের গান গাইতে।
তার ভাষ্য ছিল, তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন। এরপর ‘বড় অনিচ্ছায় কেবল গুরুর মান রাখতে’ লালনের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান ফরিদা করেছিলেন।

ওই গানই তার শিল্পী জীবনের বাঁক বদলে দেয় ফরিদার। নিজের ভেতরে এক ধরনের ‘অনুরণন’ অনুভব করেন বলে ভাষ্য ছিল তার। ফরিদা বলেছিলেন, যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হলো আমাকে এই গান আরো করতে হবে, এই গান শিখতে হবে। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। অনেকে তাকে লালনের গানের ‘রানি বা সম্রাজ্ঞী’ বললেও, এ ধরনের উপাধি পছন্দ করতেন না ফরিদা। তার কথায়, এসব আমি একদমই পছন্দ করি না। কেউ যদি লালনের বাণীগুলো অন্তর থেকে আত্মস্থ করতে পারে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এসব নাম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ ছিল, নতুন প্রজন্ম ‘শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না’। লালনের গান উপস্থাপনার হালের প্রবণতাও ‘সঠিক নয়’ বলে তার ভাষ্য। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।

লালনের গান ছাড়াও ফরিদা পারভীনের গাওয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকা দির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন এই শিল্পী। নানা রোগ সয়েও লালন চর্চায় নিবেদিত ছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন চর্চা ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি। কিন্তু ফরিদা পারভীনের শারীরিক অসুস্থতা, প্রতিষ্ঠানের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়া এবং নিজস্ব ভবন না থাকায় এ প্রতিষ্ঠানটিও ধুকছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।

জন্ম ও সংগীত জীবন: ১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। এরপর পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা। গানের প্রতি বাবার টান ছিল বেশি। দাদিও গান করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন, তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকেননি। নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা মূলত লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল, তারপর আর থেমে থাকেননি।

শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। এ প্রসঙ্গে ফরিদা পারভীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি, তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন। তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি। আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, ‘ভালো না লাগলে গাইবি না।’ এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি।
‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’, লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরো একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, ‘আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।’ এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এক পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা: ৫৫ বছরের সংগীতজীবনে ফরিদা পারভীনের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে। সে রকম একটি ঘটনার কথা এভাবেই বলেছিলেন, ‘১৯৭৩ সাল। বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউলশিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর দাস, কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞেরা। খুব ভয় হয়েছিল। তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাঁদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।’

চঞ্চল কিশোরী থেকে লালনসম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন: ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া শহরে বসে লালনসংগীতের চর্চা করেছেন। নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ তিনি দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে বেড়াতেন। তাঁর দাদা ও নানার বাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নদ। আত্রাইয়ের সেই শাখানদের নাম ছিল গুর। ওই নদ পার হয়ে অধিকাংশ দিন তরুণী ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশে ছিল বিরাট একটা বিল। ছোটবেলায় খেলার সঙ্গী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শাপলা তুলতে যেতেন সেই বিলে।

ছোটবেলা থেকেই ফরিদা পারভীনের ভালো লাগত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। তখন তিনি বুঝতেনও না যে তিনিই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রেডিও ছেড়ে দিয়ে তাঁর গান শুনতেন। ফরিদা পারভীনের বেড়ে ওঠাটা একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে নয়। কারণ, তাঁর বাবা মেডিকেলে চাকরি করতেন আর তাঁর চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন সময়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ফরিদাকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। এ কারণে ফরিদার বেড়ে ওঠায় বিভিন্ন জায়গার ছাপ পড়েছে। ফরিদা পারভীনের স্কুলজীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে। তবে তাঁর স্কুলজীবনের শুরুটা মাগুরায়। একাধিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন।

ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। সেটা ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা, তখন তিনি মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে। সে সময় মাগুরায় তাঁকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই তিনি থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্নজনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার পারভীনের যোগাযোগ, তখন তিনি কুষ্টিয়াতে থাকতেন। সেখানে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীতের তালিম নেন।

স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভীন ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর গাওয়া গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হলো। মোকছেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন। তিনি ফরিদা পারভীনকে ঢাকায় কিছু লালনের গান গাইতে বলেন। তাঁর অনুরোধে তিনি তখন ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ গানগুলো গাইলেন। তখন তিনি কুষ্টিয়া থেকে এসে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শিখে ট্রান্সক্রিপশনে রেকর্ডিং করতে থাকেন। ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। তাঁর সেই সংসারে রয়েছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে; জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি।

লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। লালনশিল্পী হিসেবেই সুপরিচিত হলেও তাঁর কণ্ঠে বেশ কটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ ইত্যাদি।
লালনের গান গেয়ে ফরিদা কেবল নিজেই জনপ্রিয় হননি, এই সংগীতকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্বদরবারেও তিনি লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে নিয়েজিত ছিলেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরো বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন।

সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে পেয়েছেন একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। লালনসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান তিনি।

সানা/আপ্র/১৪/০৯/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ভক্তদের সাথে ‘কাঁদল’ আকাশ

শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় ফরিদা পারভীনের অনন্তে যাত্রা

আপডেট সময় : ০৯:৩৭:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: ঢাকায় তখন মুষলধারে বৃষ্টি। বর্ষণ উপেক্ষা করেই অনেকে এলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। লালনের গানের ভক্ত রইস উদ্দীন বললেন, ‘গানের পাখি’ ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে ‘আকাশও যেন কাঁদছে’। ফরিদা পারভীনের বিদায়ের দিনের আকাশও যেন সত্যি সত্যি কেঁদেছে দিনভর!

‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়’ গানের বাণীর মতোই পাখিশূন্য হলেন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। যার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষকে ছুঁয়ে চলেছে পাঁচ দশক ধরে, যার নাম হয়েছে লালনের গানের সমার্থক, সেই সংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন জাগতিক সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ঢাকার মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয় বলে সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশীষ কুমার চক্রবর্তী। মৃত্যুকালে শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন তিনি।

এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ফরিদা পারভীনকে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় হাসপাতালে নেওয়ার পরই নেওয়া হয় আইসিইউতে। পরে তাঁকে লাইফ সাপোর্টেও নেওয়া হয়; সেখান থেকে আর ফেরানো গেল না শিল্পীকে।
দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন ফরিদা পারভীন। কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছিল, সপ্তাহে দুই দিন তাঁকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়। নিয়মিত ডায়ালাইসিসের অংশ হিসেবে ২ সেপ্টেম্বর ওই হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু ডায়ালাইসিসের পর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসক শিল্পীকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বুধবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে যান পরপারে।

প্রধান উপদেষ্টার শোক: লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এক শোক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক নানা ধরনের গান করলেও শ্রোতাদের কাছে ফরিদা পারভীনের পরিচিতি ‘লালনকন্যা’ হিসেবে। এতে বলা হয়, পাঁচ দশক ধরে তার কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। তার গান আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্লীন দর্শন ও জীবনবোধকেও নতুন মাত্রায় তুলে ধরেছিল। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও গান থেকে দূরে থাকেননি ফরিদা পারভীন। সঙ্গীতের প্রতি তার এই অনুরাগ প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই গুণী শিল্পী বাংলাদেশের সংগীত জগতে যে অবদান রেখেছেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিত্যনতুন চিন্তা ও সৃষ্টির খোরাক জোগাবে। প্রধান উপদেষ্টা লোকসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীনের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন: কথা ছিল, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আয়োজন শুরু হবে রোববার (১৪ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায়। তবে তেজকুনি পাড়ার বাড়ি থেকে ফ্রিজিং গাড়িতে করে কফিন পৌঁছাতে বেলা সোয়া ১১টা বেজে যায়। ততক্ষণে শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা সেখানে জড়ো হয়েছেন। ফরিদা পারভীনের গানের ভক্তরাও অনেকে এসেছেন শহরের নানা প্রান্ত থেকে।
পরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় শুরু হয় শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব। জাতীয় কবিতা পরিষদ, সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক দল- জাসাস, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় শিল্পীর কফিনে।
এই শিল্পীর কথা স্মরণ করতে গিয়ে ভক্তদের অনেকের চোখ ভিজে এলো, কণ্ঠে ভর করলো আবেগ। কেরানীগঞ্জ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসেছিলেন ‘তৌহিদের পাঠশালা’ নামে একটি ভাববাদী প্রতিষ্ঠানের প্রধান খাদেম আলী আরিফ আকবর। ভাবতত্ত্বের এই অনুরাগী বলছিলেন, বাংলার সহজীয়া যে ভাববাদের চর্চা, তাকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়েছেন ফরিদা পারভীন। গুরুবাদী শিক্ষা, মুর্শিদ ভজনের শিক্ষার প্রচার করেছেন আজন্ম। এজন্যই তিনি ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন।

আখড়াবাড়ি থেকে মধ্যবিত্তের ঘরে ফরিদা পারভীন: শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ফরিদা পারভীন দুইটা ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় শিল্পী। সংগীতজীবনের প্রথম দিকে তিনি আধুনিক গানের চর্চা করেছেন। পরে তিনি লালন সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করেন। লালনের গান পরিবেশনায় উনার যে গায়কী, তাতে একটা ‘মধ্যবিত্ত ভাব’ আছে। এই ভাব দিয়েই তিনি মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গিয়েছেন। লালনসংগীতশিল্পী হিসেবে তিনি মধ্যবিত্তের কাছে এমন উচ্চতায় গিয়েছিলেন, তার কোনো তুলনা আসলে হয় না। শেষের দিকে তিনি আসলে লালন সাধক হিসেবেই জীবনযাপন করেছেন। তিনি বলেন, আরেকটা বিশেষ দিক বলা যায়, একজন শিল্পীই যে সংস্কৃতির একটা ভিন্ন মাত্রা তৈরি করতে পারেন, তার উদাহরণ কিন্তু খুব বেশি নেই। ফরিদা পারভীন আমাদের সেরকম উদাহারণ, তিনি একাই ঘরানা তৈরি করতে পেরেছেন।
লালনের গান আখড়াবাড়ি থেকে তুলে এনে ফরিদা পারভীন প্রতিটি বাঙালীর ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন গবেষক তপন বাগচী। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের ফাঁকে তিনি বলেন, আখড়ার শিল্পীদের আপত্তিকেও ফরিদা পারভীন কখনো কখনো তোয়াক্কা করেননি। তার গায়কি আখড়ার ঘরানা থেকে কিছুটা আলাদা হলেও সাধারণ মানুষ গ্রহণ করার মতো উপকরণ তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন।

লালনের গান গাওয়ার পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় হারিয়ে গেছে মন্তব্য করে তপন বাগচী বলেন, আমরা তাকে চিনতাম আধুনিক গানের অনেক বড় একজন শিল্পী হিসেবে। ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’ গানটি তার কণ্ঠে ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। এই গানটির গীতিকার আবু জাফর তার প্রথম স্বামী। তাকেও আজকের দিনে স্মরণ করি। কারণ গীতিকার জাফরের লেখা গানেই রাজশাহী বেতারের মাধ্যমে তিনি সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন।

২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান ফরিদা পারভীন। তপন বাগচী বলেন, এই পুরস্কার দেওয়ার সময় ফরিদা পারভীনের কণ্ঠ বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটি টুলস ব্যবহার করে ওই পুরস্কার কর্তৃপক্ষ দেখিয়েছিলেন যে- বিশ্বের সেরা সংগীতশিল্পীদের কাতারেই উনি। ফরিদা পারভীন সংগীতের একটি বড় ধারার সাধক। তিনি শুধু গান গাওয়া নয়, গানের স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি লালনের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনা এখন কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা জানি না। তার মতো একজন গুণি মানুষকে শ্রদ্ধা জানাই।

শ্রদ্ধা জানাতে এসে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক চিত্রনায়ক উজ্জ্বল বলেন, কিংবদন্তি একজন সংগীতশিল্পীকে হারালাম আমরা। এই শূন্যতাকে পূরণ করার জন্য আমাদেরকে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে। উনার কোনো রিপ্লেসমেন্ট হবে না। কিন্তু এমন গুণি শিল্পী যেন আমরা আরো পেতে পারি, তার জন্য সবাইকে নিয়ে পরিবেশ গড়তে হবে। শহীদ জিয়াউর রহমান নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিশুদের প্রতিভাকে সামনে আনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার নতুন কুঁড়ি আবার শুরু করেছে। শিশুদের নিয়ে আমাদের এরকম আরো কাজ করতে হবে।

চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন বলেন, শিল্পচর্চা যে সাধনার বিষয়, এই ব্যাপারটা আমরা ভুলেই গেছি। ফরিদা পারভীন এমন একজন মানুষ, যিনি জীবনটা সাধনার মধ্যেই কাটিয়েছেন। ফরিদা পারভীন আজকে যে অবস্থানে এসেছেন, তা হওয়ার জন্য অন্তত ৫০ বছর পার করতে হয়েছে। আমি এখানে এসে এটাই কেবল ভাবছিলাম, যে আমাদের মহান মানুষগুলো আমাদের ছেড়ে একে একে চলে চলে যাচ্ছেন। আমাদের প্রজন্মের কেউ কি এমন উচ্চতায় কখনো যেতে পারব? এমন সাধনায় নিমগ্ন থাকা কি আমাদের মধ্যে আছে? ফরিদা পারভীনের কাজগুলো নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত এবং তার ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানানোত জন্য তার কাজগুলো সংরক্ষণের উদ্যেগ নেওয়া উচিত।

বৃষ্টি উপেক্ষা করেও ফরিদা পারভীনকে শ্রদ্ধা জানাতে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বক্তব্য দেন ফরিদা পারভীনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আবদুল হাকিম। তিনি জানান শহীদ মিনার থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে বাদ জোহর জানাজার পর কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়া হবে কফিন। সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ফরিদা পারভীন।

লালনের গানে এক জীবন: ১৯৫৪ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া ফরিদা বেড়ে ওঠেন কুষ্টিয়ায়। বাবা ছিলেন চিকিৎসক, মা গৃহিনী। সাংস্কৃতিক আবহে বড় হওয়া ফরিদার গানে হাতেখড়ি পাঁচ বছর বয়সে। বাবা-মায়ের উৎসাহে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেওয়া ফরিদার ইচ্ছা ছিল নজরুলসংগীতের শিল্পী হওয়ার। এগোচ্ছিলেনও সেই পথেই।
রাজশাহী বেতারে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৮ সালে। গেয়েছেন আধুনিক ও দেশের গানও। তরুণ বয়সে লালনের গান একরকম ‘উপেক্ষিতই’ ছিল তার কাছে। তবে সংগীতের অন্য সব ধারাকে পাশে সরিয়ে কীভাবে, কোন তাড়নায় তিনি লালনের গানে নিজেকে বিলিয়ে দিলেন সেই গল্প ফরিদা শুনিয়েছিলেন এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। ফরিদা বলেছিলেন, স্বাধীনতার বছরখানের পর কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে গুরু মোকছেদ আলী তাকে অনুরোধ করেছিলেন লালনের গান গাইতে।
তার ভাষ্য ছিল, তখন আমি খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললাম ঠিক আছে আমাকে একটা গান শিখিয়ে দেন। এরপর ‘বড় অনিচ্ছায় কেবল গুরুর মান রাখতে’ লালনের ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান ফরিদা করেছিলেন।

ওই গানই তার শিল্পী জীবনের বাঁক বদলে দেয় ফরিদার। নিজের ভেতরে এক ধরনের ‘অনুরণন’ অনুভব করেন বলে ভাষ্য ছিল তার। ফরিদা বলেছিলেন, যেটা ঐশ্বরিক অনুরণন। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। আমার মনে হলো আমাকে এই গান আরো করতে হবে, এই গান শিখতে হবে। এরপর গুরু আমাকে একটা একটা করে গান শেখাতে লাগলেন। আর এভাবেই লালন গানের শুরু। এখন এই লালন ফকিরই আমাকে সবার প্রাণের মধ্যে উপস্থাপন করেছে। এই গান দিয়ে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন বলেই সেদিন ‘সত্য বল সুপথে চল’ গানটি আমাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। অনেকে তাকে লালনের গানের ‘রানি বা সম্রাজ্ঞী’ বললেও, এ ধরনের উপাধি পছন্দ করতেন না ফরিদা। তার কথায়, এসব আমি একদমই পছন্দ করি না। কেউ যদি লালনের বাণীগুলো অন্তর থেকে আত্মস্থ করতে পারে সে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। এসব নাম দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। ফরিদা পারভীনের আক্ষেপ ছিল, নতুন প্রজন্ম ‘শুদ্ধভাবে লালন চর্চা করছে না’। লালনের গান উপস্থাপনার হালের প্রবণতাও ‘সঠিক নয়’ বলে তার ভাষ্য। তার মতে, হৃদয়ের গভীর উপলব্ধি থেকে লালন চর্চার কোনো বিকল্প হতে পারে না।

লালনের গান ছাড়াও ফরিদা পারভীনের গাওয়া বেশ কয়েকটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আছে ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকা দির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’। বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন এই শিল্পী। নানা রোগ সয়েও লালন চর্চায় নিবেদিত ছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লালন চর্চা ছড়িয়ে দিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ঢাকার তেজকুনি পাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা ‘অচিন পাখি সংগীত একাডেমি। কিন্তু ফরিদা পারভীনের শারীরিক অসুস্থতা, প্রতিষ্ঠানের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়া এবং নিজস্ব ভবন না থাকায় এ প্রতিষ্ঠানটিও ধুকছে টিকে থাকার লড়াইয়ে।

জন্ম ও সংগীত জীবন: ১৯৫৪ সালে ৩১ ডিসেম্বর নাটোরের সিংড়া থানায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। ১৪ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে ফরিদা পারভীনের পেশাদার সংগীতজীবন শুরু হয়। এরপর পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। পারিবারিক সূত্রেই গানের ভুবনে আসা। গানের প্রতি বাবার টান ছিল বেশি। দাদিও গান করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় যেতে হয়েছে তাঁকে। শৈশবে যখন মাগুরায় ছিলেন, তখন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তালিম থেকে দূরে থাকেননি। নানা ধরনের গান করলেও শিল্পীজীবনে পরিচিতি, জনপ্রিয়তা, অগণিত মানুষের ভালোবাসা মূলত লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। যখন থেকে লালনের গান গাওয়া শুরু হয়েছিল, তারপর আর থেমে থাকেননি।

শুরুতে নজরুলসংগীত, পরে আধুনিক গান দিয়ে ফরিদা পারভীনের যাত্রা শুরু হলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে লালন সাঁইয়ের গান গেয়ে। এ প্রসঙ্গে ফরিদা পারভীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে এটা ঘটে। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় এক হোমিও চিকিৎসক আমার গানের বেশ মুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন। কিন্তু কেন জানি, তিনি আমার কণ্ঠে লালনগীতি শুনতে চাইতেন। তাঁর মনে হতো, লালনের গান আমার কণ্ঠে বেশি ভালো লাগবে। তাই হঠাৎ করেই আমাকে একদিন লালন ফকিরের গান শেখার পরামর্শ দেন। কিন্তু শুরুতে লালনের গান গাইতে চাইনি। আমার এই অনীহা দেখে বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়ে গান শেখার জন্য রাজি করান। বলেন, ‘ভালো না লাগলে গাইবি না।’ এই শর্তে রাজি হই এবং লালনসংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে তালিম নেওয়া শুরু করি।
‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন’, লালনের বিখ্যাত গানটি শিখি। একই বছর দোলপূর্ণিমা উৎসবে গানটি গাইলে শ্রোতারা আমাকে লালনের আরো একটি গান গাইতে অনুরোধ করেন। তখন আমি গান গাইতে অসম্মতি জানাই। শ্রোতাদের বলি, ‘আমি একটি গান গাইতে শিখেছি। এটাই ভালোভাবে গাইতে চাই।’ এ গানই আমার নতুন পথের দিশা হয়েছিল। এরপর ধীরে ধীরে বুঝতে শিখি, কী আছে লালনের গানে। তাঁর গানে মিশে থাকা আধ্যাত্মিক কথা ও দর্শন আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এক পর্যায়ে অনুভব করি, লালন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অনবদ্য এক স্রষ্টা হয়ে উঠেছেন। এটা বোঝার পর লালনের গান ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না।’
বিশেষ স্মরণীয় ঘটনা: ৫৫ বছরের সংগীতজীবনে ফরিদা পারভীনের অনেক স্মরণীয় স্মৃতি আছে। সে রকম একটি ঘটনার কথা এভাবেই বলেছিলেন, ‘১৯৭৩ সাল। বিভিন্ন আখড়া থেকে বাউলশিল্পীদের ঢাকায় এনে লালনের গান রেকর্ডের পরিকল্পনা করেন ওস্তাদ মকছেদ আলী সাঁই। তিনি তৎকালীন রেডিওর ট্রান্সক্রিপশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় রেডিওতে আসি। এ সময় স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, কমল দাশগুপ্ত, সমর দাস, কাদের জমিলির মতো বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞেরা। খুব ভয় হয়েছিল। তাঁদের সামনে আমাকে গাইতে হলো। ১৫ মিনিটের একক সংগীতানুষ্ঠান করে তাঁদের প্রশংসা পেয়েছিলাম। এটিই আমার অন্যতম স্মরণীয় স্মৃতি।’

চঞ্চল কিশোরী থেকে লালনসম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীন: ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন কুষ্টিয়া শহরে বসে লালনসংগীতের চর্চা করেছেন। নাটোরের সিংড়ায় জন্ম নেওয়া ফরিদা পারভীন ছোটবেলায় ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। প্রায় সারাক্ষণ তিনি দৌড়ঝাঁপ আর খেলাধুলা করে বেড়াতেন। তাঁর দাদা ও নানার বাড়ির মাঝখানে ছিল একটি নদ। আত্রাইয়ের সেই শাখানদের নাম ছিল গুর। ওই নদ পার হয়ে অধিকাংশ দিন তরুণী ফরিদা দাদার বাড়ি থেকে নানার বাড়ি যেতেন। নানার বাড়ির পাশে ছিল বিরাট একটা বিল। ছোটবেলায় খেলার সঙ্গী মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মিলে শাপলা তুলতে যেতেন সেই বিলে।

ছোটবেলা থেকেই ফরিদা পারভীনের ভালো লাগত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। তখন তিনি বুঝতেনও না যে তিনিই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কিন্তু রেডিও ছেড়ে দিয়ে তাঁর গান শুনতেন। ফরিদা পারভীনের বেড়ে ওঠাটা একেবারে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামে নয়। কারণ, তাঁর বাবা মেডিকেলে চাকরি করতেন আর তাঁর চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন সময়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ফরিদাকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। এ কারণে ফরিদার বেড়ে ওঠায় বিভিন্ন জায়গার ছাপ পড়েছে। ফরিদা পারভীনের স্কুলজীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে। তবে তাঁর স্কুলজীবনের শুরুটা মাগুরায়। একাধিক স্কুলে পড়াশোনা শেষে তিনি কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন।

ফরিদা পারভীনের গানের হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। সেটা ১৯৫৭-৫৮ সালের কথা, তখন তিনি মাত্র চার-পাঁচ বছরের মেয়ে। সে সময় মাগুরায় তাঁকে গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। এরপর যেখানেই তিনি থেকেছেন, সেখানেই বিভিন্নজনের কাছে গানের তালিম নিয়েছেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুলসংগীতশিল্পী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর লালন সাঁইজির গানের সঙ্গে ফরিদার পারভীনের যোগাযোগ, তখন তিনি কুষ্টিয়াতে থাকতেন। সেখানে তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন মোকছেদ আলী সাঁই। ১৯৭৩ সালে ফরিদা পারভীন তাঁর কাছেই ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছে লালনসংগীতের তালিম নেন।

স্বাধীনতার পর ফরিদা পারভীন ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর গাওয়া গান দিয়ে ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিস শুরু হলো। মোকছেদ আলী সাঁই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন। তিনি ফরিদা পারভীনকে ঢাকায় কিছু লালনের গান গাইতে বলেন। তাঁর অনুরোধে তিনি তখন ‘খাঁচার ভিতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ গানগুলো গাইলেন। তখন তিনি কুষ্টিয়া থেকে এসে মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শিখে ট্রান্সক্রিপশনে রেকর্ডিং করতে থাকেন। ফরিদা পারভীনের প্রথম স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। তাঁর সেই সংসারে রয়েছে তিন ছেলে ও এক মেয়ে; জিহান ফারিয়া, ইমাম নিমেরি উপল, ইমাম নাহিল সুমন ও ইমাম নোমানি রাব্বি।

লালন সাঁইজির গানের বাণী ও সুরকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের অবদান সর্বজনস্বীকৃত। লালনশিল্পী হিসেবেই সুপরিচিত হলেও তাঁর কণ্ঠে বেশ কটি আধুনিক ও দেশের গান জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘তোমরা ভুলে গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ ইত্যাদি।
লালনের গান গেয়ে ফরিদা কেবল নিজেই জনপ্রিয় হননি, এই সংগীতকে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও পৌঁছে দিয়েছেন। বিশ্বদরবারেও তিনি লালন সাঁইয়ের বাণী ও সুরকে প্রচারের কাজে নিয়েজিত ছিলেন। জাপান, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরো বহু দেশে লালনসংগীত পরিবেশন করেছেন।

সংগীতের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে পেয়েছেন একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। লালনসংগীতে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক পান ফরিদা পারভীন। এর বাইরে ১৯৯৩ সালে ‘অন্ধ প্রেম’ চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত ‘নিন্দার কাঁটা’ গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ সংগীতশিল্পী (নারী) হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ সালে জাপান সরকারের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার পান তিনি।

সানা/আপ্র/১৪/০৯/২০২৫