ঢাকা ০৫:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রাথমিকে সংগীত শিক্ষক

বিরোধিতা নয়, শিশুর বিকাশই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার

  • আপডেট সময় : ০৬:১৮:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৪০ বার পড়া হয়েছে

সংগীতের সুরে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা যেন খুঁজে পায় শেখার আনন্দ, তাদের কণ্ঠে মিশে যায় ভবিষ্যতের স্বপ্ন। যদিও এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব সে প্রশ্ন থেকেই যায় -ছবি এআই (সৌজন্যে বিডিনিউজ)

  • আলাউল হোসেন

প্রাথমিকপর্যায়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ হতে পারে সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ার প্রথম পদক্ষেপ। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিধিমালা থেকে সংগীত শিক্ষকের পদটি বাতিল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কেননা, এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় যারা মাঠে নেমে পড়েছেন, তারা ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতাসীনদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখেন।

সংগীত শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি বাতিল হলেও মানুষের জীবন থেকে সুর সংগীতকে বিদায় করা অসম্ভব। সব দেশে, সব কালে শিশুর কথা শুরু হয় আসলে স্বরের সংগীতে। পৃথিবীর সব শিশুই প্রথমে স্পষ্ট শব্দ বা অর্থপূর্ণ বাক্য বলে না-ওরা যা বলে তা এক প্রকার ‘অবোধ্য সংগীত’, যা একইসঙ্গে হাসির মতো, কান্নার মতো, আবার মন্ত্রপাঠের মতো শোনায়। এটিই মানুষের ভাষার প্রথম ধাপ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর এই বকবকানি বা বাবলিং হলো ভাষার সার্বজনীন সুর। এটিই প্রমাণ করে, ভাষা শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি ছন্দ এবং সংগীতেরও আরেক রূপ। ভাষার জন্ম সংগীতের গর্ভে।

শিশুর বেড়ে ওঠার পথে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা
যেভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত, সংগীতও তেমনি
সেই পরিবেশকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেবল চার দেয়ালের ভেতরে
সীমাবদ্ধ পাঠ্যসূচি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত
করতে পারে না। প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা,
যেখানে গান, নাচ, নাটক, খেলাধুলা,
বিতর্কের মতো সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিশুর
চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করে।

সংগীত মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে মিশে থাকা এক অপূর্ব অনুষঙ্গ। মানুষের আবেগ, বোধ ও চিন্তাকে ছুঁয়ে যায় সংগীতের সুর। আধুনিক গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে, শিশুকে শৈশব থেকেই সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করানো হলে তার মস্তিষ্কে নতুন স্নায়বিক সংযোগ তৈরি হয়, যা তাকে করে তোলে মনোযোগী, সৃজনশীল ও আত্মবিশ্বাসী।

শিশুর বেড়ে ওঠার পথে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা যেভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত, সংগীতও তেমনি সেই পরিবেশকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেবল চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ পাঠ্যসূচি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে না। প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, যেখানে গান, নাচ, নাটক, খেলাধুলা, বিতর্কের মতো সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিশুর চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করে। শিশুকে সংগীতের জগতে প্রবেশ করানো মানে তাকে কেবল বিনোদন দেওয়া নয়, বরং তাকে শেখার নতুন পথ দেখানো।

তাই যখন আমরা স্কুলের পাঠ্যক্রমে সংগীত রাখি, তখন শিশুদের মন, শরীর আর আত্মাকে এক রেখায় টেনে আনে। এভাবেই শিশুর কৌতূহল শেখায় রূপ নেয়, শেখা আনন্দে বদলায়, আর আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী দক্ষতায় পরিণত হয়।

বাংলাদেশ এখন যে শিক্ষাবিপ্লবের দোরগোড়ায়, তার কেন্দ্রেই আছে জাতীয় শিক্ষাক্রম কাঠামো ২০২১–একটি দক্ষতাভিত্তিক কাঠামো যা মুখস্থ বিদ্যার বদলে বাস্তব অভিজ্ঞতা, প্রকল্পভিত্তিক কাজ, সহযোগী শিক্ষা আর চলমান মূল্যায়নকে সামনে নিয়ে আসে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার জন্য আলাদা সহকারী শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার–ক্লাস্টারভিত্তিক দুই পদ মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫,১৬৬। বয়সসীমা শিথিল করে নিয়োগ-নিয়মও হালনাগাদ হয়েছে।

অবশ্য পরিবর্তন মানেই বিতর্ক। ঘোষণার পরই কেউ কেউ এটিকে ‘ইসলামবিরোধী এজেন্ডা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, কেউ বলেছেন ধর্মশিক্ষার শিক্ষক আগে লাগবে। মতের অমিল, ভিন্ন ভাবনা–সবই গণতান্ত্রিক জনপরিসরের অংশ।

তাই বলে সংগীতচর্চায় শিশুদের মস্তিষ্কে গঠনগত পরিবর্তন ঘটে; শব্দ, ছন্দ, সূক্ষ্ম সময়নিয়ন্ত্রণ-এসবের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ু-নেটওয়ার্ক মজবুত হয়, এই বৈজ্ঞানিক সত্যকেও তো মনে রাখতে হবে আমাদের। মাত্র কয়েক মাসের প্রশিক্ষণেও স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় উন্নতি দেখা যায়, যা মনোযোগ, কাজের স্মৃতি, মানসিক নমনীয়তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। ১২ সপ্তাহের স্বল্পমেয়াদি সংগীত প্রশিক্ষণেও শিশুদের নির্বাহী কার্যাবলিতে উন্নতি হয়েছে– এমন প্রমাণ রয়েছে নিয়ন্ত্রিত গবেষণায়।

ভালো সংগীত শুনলে ‘ভালো লাগা’ কেবল রূপক নয়; ডোপামিন নামের এক নিউরোকেমিক্যাল বাস্তবেই নিঃসৃত হয়, যা মোটিভেশন বাড়ায়, শিক্ষাকে পুরস্কার-অভিজ্ঞতার সঙ্গে বেঁধে দেয়। উচ্চ আবেগীয় মুহূর্তে সংগীত মগজের পুরস্কার-ব্যবস্থায় ডোপামিন ছড়িয়ে দেয়-নিউরোসায়েন্স এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছে। শেখাকে আনন্দময় করতে সংগীতের এই জৈবিক ভিত্তি তাই নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষা শেখার সঙ্গে সংগীতের সেতুবন্ধনের কথা তো শুরুতেই বলেছি। ধ্বনি-ছন্দ-উচ্চারণে সংগীতচর্চা শ্রবণপ্রক্রিয়াকে সূক্ষ্মভাবে ধারালো করে; ফলে শব্দভেদ, বাকধ্বনির ওঠানামা ধরার ক্ষমতা বাড়ে। প্রাক-প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক শ্রেণির শিশুদের পিয়ানো শেখা বা সংগঠিত সংগীতচর্চা ভাষার সূক্ষ্ম ধ্বনি আলাদা করতে, শব্দধ্বনির বৈচিত্র্য চিনতে সাহায্য করে–ফলে পড়া-লেখার প্রাথমিক দক্ষতা গড়ে ওঠে সহজে।

শুধু গবেষণাগার নয়, বাস্তব শ্রেণিকক্ষ-ডেটাও একই কথা বলে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-যারা নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র শিখেছে বা কোরাসে ছিল, তারা ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানে সহপাঠীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে থেকেছে। বড় নমুনার এই সমীক্ষাটি আমাদের বলে দেয়–সংগীতকে ‘সময় নষ্ট’ করা বলে ভাবেন যে অভিভাবকরা তারা ভুল ভাবেন; বরং সংগীতে বিনিয়োগ শিক্ষার মূল সূচকে লভ্যাংশ দেয়।

বিশ্বের স্কুলগুলো কী করছে? ফিনল্যান্ড– যে দেশটিকে আমরা প্রায়ই শিক্ষায় ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বলি–তাদের জাতীয় মূল শিক্ষাক্রমে শিল্প-সংস্কৃতি সমগ্র জুড়েই বোনা; সংগীত শ্রেণিকক্ষে কেবল গান নয়, শিশুদের একসঙ্গে কাজ শেখায়, বহুসাংস্কৃতিক স্পন্দন বোঝায়, আত্মপ্রকাশের সাহস দেয়। ফিনিশ জাতীয় শিক্ষা সংস্থার নীতিপত্রে সংগীত-ভিত্তিক অভিজ্ঞতাই সুস্থ নৈতিক-সামাজিক বেড়ে ওঠার অংশ।

সিঙ্গাপুরে প্রাইমারির পুরো ছয় বছরই সবার জন্য সংগীত বাধ্যতামূলক; ২০২৩ সালের নতুন সিলেবাস ধাপে ধাপে চালু করে ২০২৪ সাল থেকেই প্রাইমারি-১ থেকে ৬ পর্যন্ত কার্যকর। লক্ষ্য– শোনা, গাওয়া, বাজানো, সৃষ্টি করা ও উপস্থাপনার সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক শিকড় ও বৈশ্বিক সুরধারা দুইয়ের সঙ্গেই পরিচয়, আর সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম–মোটর দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তা ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশ। স্কুল পর্যায়েই কাহন, ইউকুলেলে, রেকর্ডারের মতো যন্ত্র ধরে শিশুরা দলগত সংগীত করে; এই ধারাবাহিক ও সমন্বিত পাঠ–পদ্ধতি সিঙ্গাপুরকে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রাখার এক অঘোষিত গোপন শক্তি।

যুক্তরাজ্যে কী অবস্থা? ন্যাশনাল কারিকুলাম-এ কী স্টেজ ১-২ এ সংগীত বাধ্যতামূলক, আর কী স্টেজ ৩-এও তার ধারাবাহিকতা রয়েছে–সরকারের নীতিপত্রে বিষয়টি স্পষ্ট। লক্ষ্য-গান, যন্ত্র, সৃষ্টিশীল রচনা এবং সমালোচনামূলক শ্রবণ। অর্থাৎ শিল্প আলাদা কোনো ঘর নয়; পড়া–লেখা–গণিতের সমান্তরালে সংগীতও শেখার মূলধারা।
জাপান দীর্ঘদিন ধরে ‘কোর্স অব স্টাডি’ দিয়ে জাতীয় স্তরে পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে; সেখানে প্রাথমিকের তিন ধাপে সংগীতের লক্ষ্য–বিষয়বস্তুর স্পষ্ট রূপরেখা–গান, যন্ত্র, সৃজন–সবই একসঙ্গে। জাপানি শিশুদের সংগীতপাঠ কেবল নোট পড়া নয়; আবেগ-গঠন-প্রকাশ–এই তিনের সেতুবন্ধন শেখানো।

এবার ফিরে আসি বাংলাদেশে। আমাদের ন্যাশনাল কারিকুলাম ২০২১–এর দর্শনে যে অভিজ্ঞতানির্ভর–সহযোগী শেখার কথা বলা হয়েছে, সংগীত তার স্বাভাবিক বাহন। প্রাথমিক স্তরে বিষয় তালিকায় সংগীত আলাদা বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে; শিক্ষক-গাইড, কর্মপুস্তিকা–সব কিছুর মধ্যেই সংগীতকে শিশুর দৈনন্দিন শেখার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস আছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভ্যন্তরে সংগীতকে জায়গা দেওয়ার অর্থ-নীতিগত ঘোষণাকে বাস্তবে নামানো।

এই সমন্বয়ের মানবিক চিত্র আমরা দেখতে পাই রাজিয়া রিঝির গল্পে। রাজিয়া রিঝি নামের পাবনার এই তরুণী চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সংগীতের শক্তিই যেন তার সাফল্যের পেছনের চালিকাশক্তি। নার্সারিতে পড়ার সময় গান শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল তার। পরিবারের কাছ থেকেই সংগীতের প্রেরণা পেয়েছিল। পরে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় উচ্চাঙ্গ ও নজরুল সংগীতে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয় ২০২৩ সালে। তার নিজের স্বীকারোক্তি, গান তার কাছে সুস্থতার পথ্য হিসেবে কাজ করে। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি মানসিকতার ইতিবাচক উন্নয়নেও সংগীত তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।

রিঝির মতো উদাহরণ শুধু একজন নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অগণিত প্রতিভাবান শিশু। তাদের বিকাশের সঠিক সুযোগ তৈরি করে দিলে সংগীত শিক্ষা হতে পারে তাদের আলোকিত ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচনের হাতিয়ার। তাই সংগীতকে অস্বীকার করে কেবল একে অবাঞ্ছিত বিনোদন আখ্যা দেওয়া কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধিতা করা বাস্তবতা ও বিজ্ঞানের পরিপন্থী। বস্তুত মনের চাপ, সংকোচ, একাকিত্ব– সব ভেদ করে গান রিঝিকে খুঁজে দিয়েছে নিজের ভেতরের আলো। এই আলোর সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুবিদ্যার যে সেতু, তা বিজ্ঞানই বুঝিয়ে দিয়েছে– সংগীত যখন ডোপামিন ছড়িয়ে শেখাকে পুরস্কার-অনুভূতির সঙ্গে বেঁধে দেয়, তখন অনুপ্রেরণা-আত্মবিশ্বাস-অভ্যাস তিনটাই স্থায়ী হয়।

এখানেই নীতিনির্ধারণ ও শ্রেণিকক্ষের মিলমিশ। যখন সরকার সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেয়, তখন শুধু একটা পদ সৃষ্টি হয় না-শিশুর ভেতরের সৃজনশীলতাকে ধারাবাহিকভাবে জাগিয়ে রাখার জন্য জনবল নিয়োগ হয়। তবে স্কুলে সংগীতশিক্ষা কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় একসঙ্গে ভাবতে হয়। প্রথমত, শিক্ষক এবং শিক্ষকদের হাতে থাকতে হবে শিশুকে-কেন্দ্র করে শেখানোর উপকরণ: ক্ল্যাপিং গেম, কলে-রেসপন্স, সহজ পারকাশন, স্থানীয় লোকসুরে তাল-স্বর খোঁজা। দ্বিতীয়ত, হারমোনিয়াম, তবলা/খোল, বাঁশি, ছোট পারকাশন, রেকর্ডার-ইউকুলেলে–যা প্রাথমিক স্তরে সহজে শেখানো যায়। তৃতীয়ত, সময়সূচি– সপ্তাহে অন্তত দুই পিরিয়ড সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে অনুশীলন; পরীক্ষার মুখস্থভার কমিয়ে সৃজনশীল কাজকে মূল্যায়নে প্রাধান্য, যেমন– তাল ঠিক রেখে দলগত পরিবেশনা, সহজ সুরে নতুন গীত রচনা, শুনে-বুঝে পারফর্ম করা। এইসবই নতুন কারিকুলামের ‘অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক, ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।

তবে সবকিছুর আগে আসে সামাজিক ঐকমত্যের প্রশ্ন। বাংলাদেশ যে নতুন কারিকুলামের পথে হাঁটছে, সেটি কেবল সিলেবাস–বদল নয়; শেখার দর্শনের পরিবর্তন। এই নতুন দর্শনে সংগীত কোনো বিলাস নয়– অপরিহার্য। নীতি-বিজ্ঞান-বিশ্ব-অভিজ্ঞতা-সব একসঙ্গে আমাদের বলছে, শিশুর হাতে যদি আমরা সুরের হাতল দিই, তবে সে পড়ালেখার পাহাড়ও সহজে টপকাবে। সরকারের বর্তমান উদ্যোগ– সংগীত শিক্ষক নিয়োগ, দক্ষতাভিত্তিক নীতি-সবই যদি আমরা শ্রেণিকক্ষে পৌঁছে দিতে পারি, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকালগুলোতে শোনা যাবে তাল মেলানো হাততালির ঢেউ; সেই ঢেউ থেকেই জন্ম নেবে মনোযোগী চোখ, কৌতূহলী কান ও সাহসী কণ্ঠ।
লেখক: কলামিস্ট, বিশ্লেষক
সানা/আপ্র/০৯/০৯/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রাথমিকে সংগীত শিক্ষক

বিরোধিতা নয়, শিশুর বিকাশই হওয়া উচিত অগ্রাধিকার

আপডেট সময় : ০৬:১৮:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • আলাউল হোসেন

প্রাথমিকপর্যায়ে সংগীত শিক্ষক নিয়োগ হতে পারে সৃজনশীল প্রজন্ম গড়ার প্রথম পদক্ষেপ। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে প্রাথমিকে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিধিমালা থেকে সংগীত শিক্ষকের পদটি বাতিল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কেননা, এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় যারা মাঠে নেমে পড়েছেন, তারা ক্ষমতায় না থাকলেও ক্ষমতাসীনদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রাখেন।

সংগীত শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি বাতিল হলেও মানুষের জীবন থেকে সুর সংগীতকে বিদায় করা অসম্ভব। সব দেশে, সব কালে শিশুর কথা শুরু হয় আসলে স্বরের সংগীতে। পৃথিবীর সব শিশুই প্রথমে স্পষ্ট শব্দ বা অর্থপূর্ণ বাক্য বলে না-ওরা যা বলে তা এক প্রকার ‘অবোধ্য সংগীত’, যা একইসঙ্গে হাসির মতো, কান্নার মতো, আবার মন্ত্রপাঠের মতো শোনায়। এটিই মানুষের ভাষার প্রথম ধাপ। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর এই বকবকানি বা বাবলিং হলো ভাষার সার্বজনীন সুর। এটিই প্রমাণ করে, ভাষা শুধু শব্দের সমষ্টি নয়, এটি ছন্দ এবং সংগীতেরও আরেক রূপ। ভাষার জন্ম সংগীতের গর্ভে।

শিশুর বেড়ে ওঠার পথে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা
যেভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত, সংগীতও তেমনি
সেই পরিবেশকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে তোলে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেবল চার দেয়ালের ভেতরে
সীমাবদ্ধ পাঠ্যসূচি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত
করতে পারে না। প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা,
যেখানে গান, নাচ, নাটক, খেলাধুলা,
বিতর্কের মতো সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিশুর
চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করে।

সংগীত মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে মিশে থাকা এক অপূর্ব অনুষঙ্গ। মানুষের আবেগ, বোধ ও চিন্তাকে ছুঁয়ে যায় সংগীতের সুর। আধুনিক গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে, শিশুকে শৈশব থেকেই সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করানো হলে তার মস্তিষ্কে নতুন স্নায়বিক সংযোগ তৈরি হয়, যা তাকে করে তোলে মনোযোগী, সৃজনশীল ও আত্মবিশ্বাসী।

শিশুর বেড়ে ওঠার পথে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা যেভাবে নিবিড়ভাবে জড়িত, সংগীতও তেমনি সেই পরিবেশকে সুস্থ ও প্রাণবন্ত করে তোলে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কেবল চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ পাঠ্যসূচি শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশ নিশ্চিত করতে পারে না। প্রয়োজন সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা, যেখানে গান, নাচ, নাটক, খেলাধুলা, বিতর্কের মতো সৃজনশীল কর্মকাণ্ড শিশুর চিন্তাশক্তিকে প্রসারিত করে। শিশুকে সংগীতের জগতে প্রবেশ করানো মানে তাকে কেবল বিনোদন দেওয়া নয়, বরং তাকে শেখার নতুন পথ দেখানো।

তাই যখন আমরা স্কুলের পাঠ্যক্রমে সংগীত রাখি, তখন শিশুদের মন, শরীর আর আত্মাকে এক রেখায় টেনে আনে। এভাবেই শিশুর কৌতূহল শেখায় রূপ নেয়, শেখা আনন্দে বদলায়, আর আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী দক্ষতায় পরিণত হয়।

বাংলাদেশ এখন যে শিক্ষাবিপ্লবের দোরগোড়ায়, তার কেন্দ্রেই আছে জাতীয় শিক্ষাক্রম কাঠামো ২০২১–একটি দক্ষতাভিত্তিক কাঠামো যা মুখস্থ বিদ্যার বদলে বাস্তব অভিজ্ঞতা, প্রকল্পভিত্তিক কাজ, সহযোগী শিক্ষা আর চলমান মূল্যায়নকে সামনে নিয়ে আসে। এর ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষার জন্য আলাদা সহকারী শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার–ক্লাস্টারভিত্তিক দুই পদ মিলিয়ে সংখ্যাটা ৫,১৬৬। বয়সসীমা শিথিল করে নিয়োগ-নিয়মও হালনাগাদ হয়েছে।

অবশ্য পরিবর্তন মানেই বিতর্ক। ঘোষণার পরই কেউ কেউ এটিকে ‘ইসলামবিরোধী এজেন্ডা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, কেউ বলেছেন ধর্মশিক্ষার শিক্ষক আগে লাগবে। মতের অমিল, ভিন্ন ভাবনা–সবই গণতান্ত্রিক জনপরিসরের অংশ।

তাই বলে সংগীতচর্চায় শিশুদের মস্তিষ্কে গঠনগত পরিবর্তন ঘটে; শব্দ, ছন্দ, সূক্ষ্ম সময়নিয়ন্ত্রণ-এসবের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ু-নেটওয়ার্ক মজবুত হয়, এই বৈজ্ঞানিক সত্যকেও তো মনে রাখতে হবে আমাদের। মাত্র কয়েক মাসের প্রশিক্ষণেও স্নায়বিক প্রক্রিয়ায় উন্নতি দেখা যায়, যা মনোযোগ, কাজের স্মৃতি, মানসিক নমনীয়তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। ১২ সপ্তাহের স্বল্পমেয়াদি সংগীত প্রশিক্ষণেও শিশুদের নির্বাহী কার্যাবলিতে উন্নতি হয়েছে– এমন প্রমাণ রয়েছে নিয়ন্ত্রিত গবেষণায়।

ভালো সংগীত শুনলে ‘ভালো লাগা’ কেবল রূপক নয়; ডোপামিন নামের এক নিউরোকেমিক্যাল বাস্তবেই নিঃসৃত হয়, যা মোটিভেশন বাড়ায়, শিক্ষাকে পুরস্কার-অভিজ্ঞতার সঙ্গে বেঁধে দেয়। উচ্চ আবেগীয় মুহূর্তে সংগীত মগজের পুরস্কার-ব্যবস্থায় ডোপামিন ছড়িয়ে দেয়-নিউরোসায়েন্স এই বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেখিয়েছে। শেখাকে আনন্দময় করতে সংগীতের এই জৈবিক ভিত্তি তাই নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষা শেখার সঙ্গে সংগীতের সেতুবন্ধনের কথা তো শুরুতেই বলেছি। ধ্বনি-ছন্দ-উচ্চারণে সংগীতচর্চা শ্রবণপ্রক্রিয়াকে সূক্ষ্মভাবে ধারালো করে; ফলে শব্দভেদ, বাকধ্বনির ওঠানামা ধরার ক্ষমতা বাড়ে। প্রাক-প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক শ্রেণির শিশুদের পিয়ানো শেখা বা সংগঠিত সংগীতচর্চা ভাষার সূক্ষ্ম ধ্বনি আলাদা করতে, শব্দধ্বনির বৈচিত্র্য চিনতে সাহায্য করে–ফলে পড়া-লেখার প্রাথমিক দক্ষতা গড়ে ওঠে সহজে।

শুধু গবেষণাগার নয়, বাস্তব শ্রেণিকক্ষ-ডেটাও একই কথা বলে। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-যারা নিয়মিত বাদ্যযন্ত্র শিখেছে বা কোরাসে ছিল, তারা ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানে সহপাঠীদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে থেকেছে। বড় নমুনার এই সমীক্ষাটি আমাদের বলে দেয়–সংগীতকে ‘সময় নষ্ট’ করা বলে ভাবেন যে অভিভাবকরা তারা ভুল ভাবেন; বরং সংগীতে বিনিয়োগ শিক্ষার মূল সূচকে লভ্যাংশ দেয়।

বিশ্বের স্কুলগুলো কী করছে? ফিনল্যান্ড– যে দেশটিকে আমরা প্রায়ই শিক্ষায় ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ বলি–তাদের জাতীয় মূল শিক্ষাক্রমে শিল্প-সংস্কৃতি সমগ্র জুড়েই বোনা; সংগীত শ্রেণিকক্ষে কেবল গান নয়, শিশুদের একসঙ্গে কাজ শেখায়, বহুসাংস্কৃতিক স্পন্দন বোঝায়, আত্মপ্রকাশের সাহস দেয়। ফিনিশ জাতীয় শিক্ষা সংস্থার নীতিপত্রে সংগীত-ভিত্তিক অভিজ্ঞতাই সুস্থ নৈতিক-সামাজিক বেড়ে ওঠার অংশ।

সিঙ্গাপুরে প্রাইমারির পুরো ছয় বছরই সবার জন্য সংগীত বাধ্যতামূলক; ২০২৩ সালের নতুন সিলেবাস ধাপে ধাপে চালু করে ২০২৪ সাল থেকেই প্রাইমারি-১ থেকে ৬ পর্যন্ত কার্যকর। লক্ষ্য– শোনা, গাওয়া, বাজানো, সৃষ্টি করা ও উপস্থাপনার সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক শিকড় ও বৈশ্বিক সুরধারা দুইয়ের সঙ্গেই পরিচয়, আর সেই সঙ্গে সূক্ষ্ম–মোটর দক্ষতা, সৃজনশীল চিন্তা ও সামাজিক দক্ষতার বিকাশ। স্কুল পর্যায়েই কাহন, ইউকুলেলে, রেকর্ডারের মতো যন্ত্র ধরে শিশুরা দলগত সংগীত করে; এই ধারাবাহিক ও সমন্বিত পাঠ–পদ্ধতি সিঙ্গাপুরকে ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রাখার এক অঘোষিত গোপন শক্তি।

যুক্তরাজ্যে কী অবস্থা? ন্যাশনাল কারিকুলাম-এ কী স্টেজ ১-২ এ সংগীত বাধ্যতামূলক, আর কী স্টেজ ৩-এও তার ধারাবাহিকতা রয়েছে–সরকারের নীতিপত্রে বিষয়টি স্পষ্ট। লক্ষ্য-গান, যন্ত্র, সৃষ্টিশীল রচনা এবং সমালোচনামূলক শ্রবণ। অর্থাৎ শিল্প আলাদা কোনো ঘর নয়; পড়া–লেখা–গণিতের সমান্তরালে সংগীতও শেখার মূলধারা।
জাপান দীর্ঘদিন ধরে ‘কোর্স অব স্টাডি’ দিয়ে জাতীয় স্তরে পাঠ্যসূচি নির্ধারণ করে; সেখানে প্রাথমিকের তিন ধাপে সংগীতের লক্ষ্য–বিষয়বস্তুর স্পষ্ট রূপরেখা–গান, যন্ত্র, সৃজন–সবই একসঙ্গে। জাপানি শিশুদের সংগীতপাঠ কেবল নোট পড়া নয়; আবেগ-গঠন-প্রকাশ–এই তিনের সেতুবন্ধন শেখানো।

এবার ফিরে আসি বাংলাদেশে। আমাদের ন্যাশনাল কারিকুলাম ২০২১–এর দর্শনে যে অভিজ্ঞতানির্ভর–সহযোগী শেখার কথা বলা হয়েছে, সংগীত তার স্বাভাবিক বাহন। প্রাথমিক স্তরে বিষয় তালিকায় সংগীত আলাদা বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে; শিক্ষক-গাইড, কর্মপুস্তিকা–সব কিছুর মধ্যেই সংগীতকে শিশুর দৈনন্দিন শেখার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস আছে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভ্যন্তরে সংগীতকে জায়গা দেওয়ার অর্থ-নীতিগত ঘোষণাকে বাস্তবে নামানো।

এই সমন্বয়ের মানবিক চিত্র আমরা দেখতে পাই রাজিয়া রিঝির গল্পে। রাজিয়া রিঝি নামের পাবনার এই তরুণী চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, সংগীতের শক্তিই যেন তার সাফল্যের পেছনের চালিকাশক্তি। নার্সারিতে পড়ার সময় গান শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল তার। পরিবারের কাছ থেকেই সংগীতের প্রেরণা পেয়েছিল। পরে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতায় উচ্চাঙ্গ ও নজরুল সংগীতে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয় ২০২৩ সালে। তার নিজের স্বীকারোক্তি, গান তার কাছে সুস্থতার পথ্য হিসেবে কাজ করে। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি মানসিকতার ইতিবাচক উন্নয়নেও সংগীত তাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।

রিঝির মতো উদাহরণ শুধু একজন নয়, দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে অগণিত প্রতিভাবান শিশু। তাদের বিকাশের সঠিক সুযোগ তৈরি করে দিলে সংগীত শিক্ষা হতে পারে তাদের আলোকিত ভবিষ্যতের দ্বার উন্মোচনের হাতিয়ার। তাই সংগীতকে অস্বীকার করে কেবল একে অবাঞ্ছিত বিনোদন আখ্যা দেওয়া কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধিতা করা বাস্তবতা ও বিজ্ঞানের পরিপন্থী। বস্তুত মনের চাপ, সংকোচ, একাকিত্ব– সব ভেদ করে গান রিঝিকে খুঁজে দিয়েছে নিজের ভেতরের আলো। এই আলোর সঙ্গে মস্তিষ্কের স্নায়ুবিদ্যার যে সেতু, তা বিজ্ঞানই বুঝিয়ে দিয়েছে– সংগীত যখন ডোপামিন ছড়িয়ে শেখাকে পুরস্কার-অনুভূতির সঙ্গে বেঁধে দেয়, তখন অনুপ্রেরণা-আত্মবিশ্বাস-অভ্যাস তিনটাই স্থায়ী হয়।

এখানেই নীতিনির্ধারণ ও শ্রেণিকক্ষের মিলমিশ। যখন সরকার সংগীত শিক্ষক নিয়োগ দেয়, তখন শুধু একটা পদ সৃষ্টি হয় না-শিশুর ভেতরের সৃজনশীলতাকে ধারাবাহিকভাবে জাগিয়ে রাখার জন্য জনবল নিয়োগ হয়। তবে স্কুলে সংগীতশিক্ষা কার্যকর করতে হলে কয়েকটি বিষয় একসঙ্গে ভাবতে হয়। প্রথমত, শিক্ষক এবং শিক্ষকদের হাতে থাকতে হবে শিশুকে-কেন্দ্র করে শেখানোর উপকরণ: ক্ল্যাপিং গেম, কলে-রেসপন্স, সহজ পারকাশন, স্থানীয় লোকসুরে তাল-স্বর খোঁজা। দ্বিতীয়ত, হারমোনিয়াম, তবলা/খোল, বাঁশি, ছোট পারকাশন, রেকর্ডার-ইউকুলেলে–যা প্রাথমিক স্তরে সহজে শেখানো যায়। তৃতীয়ত, সময়সূচি– সপ্তাহে অন্তত দুই পিরিয়ড সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে অনুশীলন; পরীক্ষার মুখস্থভার কমিয়ে সৃজনশীল কাজকে মূল্যায়নে প্রাধান্য, যেমন– তাল ঠিক রেখে দলগত পরিবেশনা, সহজ সুরে নতুন গীত রচনা, শুনে-বুঝে পারফর্ম করা। এইসবই নতুন কারিকুলামের ‘অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক, ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।

তবে সবকিছুর আগে আসে সামাজিক ঐকমত্যের প্রশ্ন। বাংলাদেশ যে নতুন কারিকুলামের পথে হাঁটছে, সেটি কেবল সিলেবাস–বদল নয়; শেখার দর্শনের পরিবর্তন। এই নতুন দর্শনে সংগীত কোনো বিলাস নয়– অপরিহার্য। নীতি-বিজ্ঞান-বিশ্ব-অভিজ্ঞতা-সব একসঙ্গে আমাদের বলছে, শিশুর হাতে যদি আমরা সুরের হাতল দিই, তবে সে পড়ালেখার পাহাড়ও সহজে টপকাবে। সরকারের বর্তমান উদ্যোগ– সংগীত শিক্ষক নিয়োগ, দক্ষতাভিত্তিক নীতি-সবই যদি আমরা শ্রেণিকক্ষে পৌঁছে দিতে পারি, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকালগুলোতে শোনা যাবে তাল মেলানো হাততালির ঢেউ; সেই ঢেউ থেকেই জন্ম নেবে মনোযোগী চোখ, কৌতূহলী কান ও সাহসী কণ্ঠ।
লেখক: কলামিস্ট, বিশ্লেষক
সানা/আপ্র/০৯/০৯/২০২৫