প্রত্যাশা ডেস্ক: নেপালে সহিংস দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে উত্তেজনা বাড়ায় পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা ওলি। শত শত বিক্ষোভকারী তার দফতরে প্রবেশ করার পর, মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নেপালের সচিবালয় থেকে এক বিবৃতিতে এ খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ও নেপালের সংবাদমাধ্যমগুলো এ খবর জানিয়েছে।
টানা দুইদিনের বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে গেলেন তিনি কে.পি. শর্মা ওলি।
বিবিসি জানায়, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেছেন বলে তার সচিবালয় এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে। কেপি শর্মা ওলি এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, চলমান সংকটের সংবিধানসম্মত সমাধানের পথ সুগম করার জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন। এর আগে মঙ্গলবার ভোর থেকে রাজধানী কাঠমান্ডুসহ সারা নেপালে বিক্ষোভ অব্যাহত ছিল। এ সময় উত্তেজিত জনতা একাধিক প্রভাবশালী নেতার বাসভবনে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। আক্রমণের শিকার হয় ওলি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার বাসভবনও। রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যালয়ও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমি বিবিসিকে জানিয়েছেন, মঙ্গলবারের বিক্ষোভে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরো ৯০ জন। এর আগে তরুণদের আন্দোলনে নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নের পর দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ার পর সংকট নিরসনে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। পদত্যাগের আগে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ওলি জানান, বৈঠকটি সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত হবে। তবে কোথায় বৈঠক বসবে তা উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, এই সংকটের সমাধান একমাত্র আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। তিনি আরো বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে সোমবারের বিক্ষোভ ও পরবর্তী ঘটনাগুলো আমাকে দুঃখিত করেছে। কোনো ধরনের সহিংসতা দেশের স্বার্থে ভালো নয়। শান্তিপূর্ণ ও আলোচনাভিত্তিক সমাধানই এখন প্রয়োজন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সোমবার থেকে নেপালে বিক্ষোভ চলছে। কারফিউ উপেক্ষা করে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো কাঠমান্ডুর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করছেন তরুণেরা। এ সময় জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক নেপালি কংগ্রেস পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ মন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের বাড়িতে হামলা চালিয়েছেন। কয়েকটি বাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দিয়েছেন। বিক্ষোভের মুখে সরকার মঙ্গলবার ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও প্ল্যাটফর্মের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও বিক্ষোভকারীরা কারফিউর মধ্যে রাস্তায় নেমে আসেন। রাজনীতিবিদদের সন্তানদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে ‘নেপো কিড’ ক্যাম্পেইন থেকে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন জেলায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে চলে আন্দোলন। এর মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটে। পার্লামেন্ট ভবনে ঢুকে সেখানেও্র বিক্ষোভকারীরা আগুন দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। পরে বন্ধ করে দেয়া হয় বিমান চলাচলও। এমন পরিস্থিতিতে নেপালের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান জানান স্থানীয় নেতারা এবং দেশটির সেনাপ্রধান। অবশেষে চাপের মুখে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে গত সোমবার পদত্যাগ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক।
সংলাপের আহ্বান সেনাবাহিনীর: জেন-জিদের বিক্ষোভে নেপালে সহিংস পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিসহ কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করলেও বিক্ষোভ চলছে। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে অগ্নিসংযোগ ও সংঘর্ষের মধ্যে সেনাবাহিনীসহ দেশটির প্রধান নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জরুরি রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। নেপালের সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্ট এ খবর জানিয়েছে।
মঙ্গলবার এক যৌথ বিবৃতিতে নেপালি সেনা, নিরাপত্তা সংস্থার প্রধানরা, প্রধান সচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘সংলাপের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান ছাড়া শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আর কোনো পথ নেই।
এর আগে বিক্ষোভকারীরা ফেডারেল পার্লামেন্ট, সিংহ দরবার, সুপ্রিম কোর্ট, রাজনৈতিক দলের কার্যালয় এবং কয়েকজন শীর্ষ নেতার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।
এদিকে কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহ জেন-জি বিক্ষোভকারীদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। এখন আর জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করা যাবে না। সরকারি-বেসরকারি সম্পদ জনগণের যৌথ সম্পদ। শান্ত থাকুন। জাতীয় সম্পদের ক্ষতি মানে আমাদের সবার ক্ষতি। এখান থেকে আপনাদের প্রজন্মকেই দেশকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ওলির পদত্যাগ সত্ত্বেও বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। বিক্ষোভকারীরা বলছেন, বড় ধরনের রাজনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতির জবাবদিহি না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
হেলিকপ্টারে করে মন্ত্রীদের নিরাপদ স্থানে সরাচ্ছে সেনাবাহিনী: দেশজুড়ে বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ায় নেপালি সেনাবাহিনী মন্ত্রীদের হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছে। মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) কাঠমান্ডুর দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অবস্থিত ভাইসেপতির বাসভবন থেকে মন্ত্রীদের সরিয়ে নেওয়া শুরু করে সেনাবাহিনী। মন্ত্রী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনার পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নেপালের সংবাদমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট এ খবর জানিয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পৌদেল এবং প্রধানমন্ত্রী ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর, মন্ত্রীদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। এরই মধ্যে পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরের কিছু অংশ ভেঙে প্রবেশ করে বিক্ষোভকারীরা। পরে সেখানেই ‘বিজয় পতাকা’ ওড়ায় তারা। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি।এই পদক্ষেপ দেশকে নতুন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এক দশকের মধ্যে এই বিক্ষোভকে নেপালের সবচেয়ে বড় অস্থিরতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারত এবং চীনের মধ্যে অবস্থিত দরিদ্র হিমালয় কন্যা হিসেবে পরিচিত দেশটি ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে লড়াই করে আসছে।
সানা/আপ্র/০৯/০৯/২০২৫