নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গণ-অভ্যুত্থানের সময় শহীদ প্রত্যেকের পরিবার, আহত ব্যক্তি, দেশবাসী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ এই জবানবন্দি দেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে মামলার একমাত্র রাজসাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। সকালে তাকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর দুপুরের বিরতিতে যান আদালত। এরপর বিকেলে আবারেও জবানবন্দি পেশ করেন তিনি।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আসামি হিসেবে রয়েছেন তিনি। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলায় দোষ স্বীকার করে নিয়ে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। মঙ্গলবার তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে এ মামলার ৩৬তম সাক্ষীর জবানবন্দি দিলেন।
চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমি সাড়ে ৩৬ বছর পুলিশে চাকরি করেছি। পুলিশের চাকরি খুবই ট্রিকি চাকরি। সব সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে। আমার এই চাকরিজীবনে আমার বিরুদ্ধে কখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। আমি সব সময় যথেষ্ট মানবিকতা ও সচেতনতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এত বড় গণহত্যা আমার দায়িত্বকালীন সময়ে সংঘটিত হয়েছে, তার দায় আমি স্বীকার করছি।’
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, আমি গণহত্যার শিকার প্রত্যেকের পরিবার, আহত ব্যক্তিবর্গ, দেশবাসী এবং ট্রাইব্যুনালের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘আমার এই সত্য ও পূর্ণ বর্ণনার মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হলে আল্লাহ যদি আমাকে আরো হায়াত দান করেন, বাকিটা জীবন কিছুটা হলেও অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবো।’
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খানের নির্দেশে সমন্বয়কদের আটক রেখে মানসিক নির্যাতন করে আন্দোলন প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় বলেও জানিয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরো বেড়ে যায়। প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কিছু কিছু কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তিনি বলেন, এসব কর্মকর্তা প্রায় রাতেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠকে করতেন। গোপন সেসব বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলতো। বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা হলেন-সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবি হারুনুর রশীদ, এসবির মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এএসপি কাফী, ওসি মাজহার, ফোরকান অপূর্বসহ আরো অনেকে। এর মধ্যে কারও কারও সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
রাজসাক্ষী মামুন জবানবন্দিতে আরো বলেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় চেইন অব কমান্ড মানতেন না এসব কর্মকর্তা। কিন্তু আমি চাইতাম তারা পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। মূলত পুলিশ বাহিনীতে গড়ে তোলা দুটি গ্রুপই এসব কর্মকাণ্ড চালাতো। এছাড়া দুই গ্রুপের নেতৃত্বদানকারীরা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক। জবানবন্দিতে র্যাবে থাকাকালীন টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন বা টিএফআই সেলসহ বহু বন্দিশালার বর্ণনাও দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুন।
এর আগে গত ১০ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
ওইদিন তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালে আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা সংঘটনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে-তা সত্য। এ ঘটনায় আমি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করছি। আমি রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার বিস্তারিত আদালতে তুলে ধরতে চাই। রহস্য উন্মোচনে আদালতকে সহায়তা করতে চাই।’
এ মামলায় তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৫টি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন।
জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক আসামি। গত ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনালে নিজের দায় স্বীকার করে শেখ হাসিনার এ মামলায় স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হতে চান চৌধুরী মামুন। একই সঙ্গে নিজের সব দায় স্বীকার করেন। এ মামলায় গত ৩ আগস্ট থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে গত বছরের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বীভৎস বর্ণনা উঠে এসেছে। এসবের জন্য দায়ী করে শেখ হাসিনা, কামালসহ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন শহীদ পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা।
দ্রুত বিচারে গঠন হতে পারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-৩: গুমসহ অন্য অপরাধের দ্রুত বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-৩ গঠন হতে পারে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সকালে ট্রাইব্যুনাল-২ এর মূল ভবনের সংস্কার কাজ পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন সংলগ্ন টিনশেড ভবন খালি হয়ে গেলে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-৩ করতে পারি। এটি করা গেলে গুমসহ অন্য আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারকাজ দ্রুত করা যাবে। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি আমরা। এ নিয়ে বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছেন বিচারকরাসহ আমাদের প্রসিকিউশন ও তদন্ত টিম।
আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এক হাজারেরও বেশি ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। স্থায়ী পঙ্গু করা হয়েছে হাজারও মানুষকে। ভয়াবহ এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অপরিহার্য-অনিবার্য। সেই বিচারকাজের প্রথম থেকেই আমরা অবিচল আছি। বিচারের গতি নিয়েও আমরা সন্তুষ্ট।
এদিন সকাল সাড়ে ৮টায় ট্রাইব্যুনাল-২ এর মূল ভবনের সংস্কার কাজ পরিদর্শনে আসেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং গৃহায়ন, গণপূর্ত ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলোুর রহমান খান। এসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
এসি/সানা/আপ্র/০২/০৯/২০২৫
























