নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে এখন নির্বাচন আয়োজন করার মতো ‘পরিস্থিতি নেই’ দাবি করে লেখক ও কলামনিস্ট ফরহাদ মজহার বলেছেন, নির্বাচন করলে সেনাবাহিনীকে আরো ‘বিপদের’ দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি সামনে বাংলাদেশে অনেক বিপদ চিহ্ন দেখছি। সেদিক থেকে আমাদের অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। যদি বাংলাদেশে আমরা সকলে একমত হয়ে নির্বাচন না করি তাহলে এটা বিপদের দিকে আমরা বাংলাদেশকে ঠেলে দেব।
সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি তোলে বিএনপিসহ কয়েকটি দল। এ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে মতভিন্নতা দেখা গেছে। তবে নির্বাচনের দাবিতে সরকারের ওপর বিএনপির চাপও দেখা যায়। এর ধারাবাহিকতায় লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠক করেন।
সে বৈঠক থেকে আসা যৌথ ঘোষণায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের আভাস দেওয়া হয়। গেল ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন। পরদিন নির্বাচন কমিশনকেও ভোটের প্রস্তুতি নিতে চিঠি দেওয়া হয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে।
নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান বিপক্ষে মত দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, আমরা নির্বাচনবিরোধী। কারণ নির্বাচন করে আমরা লুটেরা মাফিয়া-শ্রেণিকে, যারা বিভিন্নভাবে টাকা লুট করে নিয়ে গেছে, তাদেরকে আপনারা আবার বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসাতে চান। নির্বাচন করতে হলে ১০-২০ কোটি টাকা লাগে, সাধারণ কর্মী এই নির্বাচন করতে পারবে না। আপনারা আরেক সংসদ বানাতে চান, এখানে লুটেরা মাফিয়া শ্রেণি থাকবে। এটা আমরা প্রত্যাখান করি।
হুশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, একদিকে আপনারা আমাদের সাংবিধানিক পরিবর্তন, সেটা করতে দেননি, অন্যদিকে আপনারা রাষ্ট্র গঠন করতে দেন নাই। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম রেখেছেন। ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম রেখে আপনারা লুটেরা শ্রেণিকে আবার ক্ষমতায় বসাতে চান, এটা আমরা বরদাশত করব না।
নির্বাচনের পরিবেশ নাই: তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি সেখানে নির্বাচনের কোনো পরিস্থিতি নাই। নির্বাচন করা মানে আপনি সেনাবাহিনীকে আরো বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া। আমরা চর্তুদিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে আছি। মিয়ানমারৃ আরাকান থেকে এই রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে, তারা বাংলাদেশে বসে আছে টাইম বোমার ওপরে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান এই সরকার করতে পারে নাই।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে হলে সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে মন্তব্য করে এই কলামনিস্ট বলেন, আপনি (সরকার) সেনাবাহিনীকে অতিক্রম করে করিডোরের কথা বলেনৃ করিডোর দিতে চান কী জন্যে? সেনাপ্রধানের সাথে কথা বলেছেন কি? আপনি কথা বলেন নাই।
ফরহাদ মজহার বলেন, আপনি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দিতে চান, এটা তো নিরাপত্তার বিষয়, সেনা তো, সামরিক বাহিনীর বিষয়। আপনি কী তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ওইখানে বিলোনিয়া বলেন, ওইদিকে চিকেন নেকৃ কাজে সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা করে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আপনারা সেসব অবস্থান নেন বিভিন্নভাবে, এটা তো ঠিক না।
জাতীয় প্রেসক্লাবে মাওলানা আকরাম খাঁ হলে ‘গণশক্তি সভা’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে বঞ্চনা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়। সেখানে প্রশ্ন রেখে ফরহাদ মজহার বলেন, “বিএনপি বলে অবিলম্বে নির্বাচন চাই। আপনারা ৩১ দফায় সংস্কারের কথা বলেছেন। আপনি এতো বড় একটা রাজনৈতিক দল, আপনি সংস্কারের একটা প্রস্তাব দিতে পারেন না, আপনি নতুন গঠনতন্ত্রের প্রস্তাব দিতে পারেন না যে, গণঅভ্যুত্থান থেকে আমি বুঝতে পেরেছি জনগণের এই অভিপ্রায়ৃ এটা আমি কায়েম করবৃ আপনি একমত হচ্ছেন। তাহলে আপনার নির্বাচন দরকারটা কী? আপনাকে তো জনগণই ক্ষমতায় বসাবে।
আমরা চারদিন স্বাধীন ছিলাম: গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়। মাঝের দিনগুলোতে সরকার না থাকার বিষয়টি তুলে ধরে ফরহাদ মজহার বলেন, ৫ তারিখ থেকে ৮ তারিখ আমরা স্বাধীন ছিলাম। শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে ছিলাম না।
স্বাধীন থাকার এই ক্ষমতা জনগণ দিয়েছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, সেই রক্ত দিয়ে অর্জন করা, সেই যে ক্ষমতা এটাকে আমরা আবার শেখ হাসিনার ক্ষমতার অধীনে কী করেছি? সমপর্ণ করেছি.. এটাকে তার হাতে আবার তুলে দিয়েছি। তিনি (শেখ হাসিনা) বসে আছেন দিল্লিতে..।
আমরা আপনার মিত্র: মুহাম্মদ ইউনুসের উদ্দেশে এই লেখক বলেন, তাকে আমরা শেষ যে বার্তাটা পাঠাতে চাই যে, আমরা আপনার মিত্র। আপনি ভাববেন না, আমরা এই যে কথা বলছি, তাতে আমরা আপনার শত্রুতা করছি, আমরা বিরোধিতা করতে চাই। আমরা কী চাই? আপনি পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করুন। কিন্তু সংবিধান বাদ দিন, নির্বাচন বাদ দিন। আসেন, আমরা নতুন গঠনতন্ত্র প্রক্রিয়ায় ঢুকি।
আপনি আসুন, আপনার সাথে রাজনীতি করব: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনি শুধুমাত্র জিয়াউর রহমানের পারিবারিকভাবে যুক্ত বলেই, তারেক আপনি নেতা হতে পারবেন না.. এটা ঠিক নয়। আপনি দেশে ফিরে আসুন। আমরা আপনার সাথে রাজনীতি করব, এক সাথে রাজনীতি করব।
তরুণদের বিভ্রান্ত করবেন না, তারেকের প্রতি এমন আহ্বান জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, প্রথম দিন থেকে আমরা বলেছি যে, তরুণরা গণঅভ্যুত্থান করেছে, তারা জিয়াউর রহমানকে পছন্দ করে। আপনি খেয়াল করেছেন যে, তারা (ছাত্ররা) গিয়ে প্রথম কাকে উদ্ধার করেছে? খালেদা জিয়াকেৃ তাকে সন্মানের সঙ্গে পূনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। কারণ তিনি সন্মান পাওয়ার যোগ্য। প্রথমে এই তরুণেরা আপনার যে সব মামলা ছিল, সেই মামলা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। আপনি কৃতজ্ঞ থাকুন।
একই সঙ্গে তরুণদের বিরুদ্ধে দলকে (বিএনপি) ‘লেলিয়ে’ দেওয়ার অভিযোগও করেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, “আপনি দেশে ফিরতে পারতেন নাৃ এই তরুণরা এটা করেছে। আপনি আপনার দলকে লেলিয়ে দিচ্ছেন তরুণদের বিরুদ্ধেৃ ঠিক নয়, এটা খুবই অন্যায় কথা। আপনি তরুণদের সাথে বসে একটা আপস করুন। তাদের নিয়ে বসে দেশটাকে নতুনভাবে গঠন করুন। অবশ্যই দেশের লোক আপনাকে ভালোবাসে, তরুণরা আপনাকে ভালোবাসে।
ভুল রাজনীতি করলে শেখ হাসিনার মতো তারেক রহমানও দেশ থেকে পরিত্যাজ্য হবেন, এমন হুঁশিয়ারি দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, আমরা ৫ আগস্ট করে এসেছিৃ ৫ আগস্টের পরে আপনি আমাদের এটা বলবেন না, যে নির্বাচন দাও, নির্বাচন দাও। কিসের নির্বাচনের চাওয়া হচ্ছে? আপনি দেশ গঠনে ভূমিকা রাখুন। প্রথম কথা হচ্ছে যে, আমরা একটা গঠনপ্রণালী তৈরি করতে পারি সেজন্য প্রথম কাজ হচ্ছে গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব।
সেনা প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে: দেশ গঠন ও দেশের প্রতিরক্ষায় সেনা প্রতিষ্ঠানের যে গুরত্ব রয়েছে তা স্বীকার করে তাকে সেই গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ফরহাদ মজহার। তিন বলেন, সেনা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ষড়যন্ত্র আমরা আর সহ্য করব না। কোনো ব্যক্তিকে ছোট করা, অযথা তার মর্যাদাহানি করাৃতাকে পছন্দ না হলে সেনাবাহিনীর নিজস্ব আইন আছে, সেনা আইনে যদি না হয় আমাদের বহু পদ্ধতি আছে সেই পদ্ধতিতে করতে পারি, কিন্তু সেনা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করবেন না।
জনশক্তি সভার সভাপতি সাদেক খানের সভাপতিত্বে ও দেওয়ান সাজ্জাদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এ টি এম জিয়াউল হাসান, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হাসিনুর রহমান, লেখক ইমরান চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর রেজাউল হান্নান শাহীন।