মীর আব্দুল আলীম
২১ জুলাই ২০২৫। দুপুরটা ছিল এমনই- যেখানে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে শুধু কোমল শিশুর দেহ নয়; ভস্মীভূত হয়েছে আমাদের চেতনা, আমাদের শৈশব, আমাদের বিশ্বাস। উত্তরার দিয়াবাড়ির আকাশে হঠাৎ একটা গর্জন। মুহূর্তেই বদলে গেল দৃশ্যপট। চীনা ট্রেনিং যুদ্ধবিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঢুকে পড়ল রাজধানীর এক বেসরকারি স্কুল ‘মাইলস্টোন’-এর ওপর। মুহূর্তেই স্কুল পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। পুড়ে ছাই হয়ে গেল শিক্ষার্থীদের দেহ, তাদের স্বপ্ন, বহু ভবিষ্যৎ। উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলে একটি যুদ্ধবিমানের ধাক্কায় নিঃশেষ হয়ে গেল ৩১টি প্রাণ (২৩ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত), শতাধিক শিশু আহত, আর আমরা-নির্বাক। এই কলাম সেই শিশুদের জন্য লেখা, যারা খেলতে গিয়েছিল, কিন্তু ফিরল না আর। এই কলাম সেই মায়েদের জন্য লেখা, যারা সন্তানের নিথর দেহ বুকে জড়িয়ে ধরেছে। এ লেখা শুধুই কাগজে ছাপা কিছু শব্দ নয়-এ এক জাতিগত হাহাকার!
চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচের দিকে ধেয়ে এলো। কোনো যুদ্ধে নয়, কোনো যুদ্ধাভিযানেও নয়-এটি এসেছিল মাইলস্টোন স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর। শিশুরা তখন ক্লাসে, কেউ বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিচ্ছিল, কেউ মাঠে খেলছিল, কেউ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গুণছিল আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ। মুহূর্তেই সবকিছু থেমে গেল। শুধু আগুনের হলকা, কান ফাটানো বিস্ফোরণ আর অসহায় চিৎকার। এটি নিছক দুর্ঘটনা ছিল না-এটি ছিল দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা এবং প্রশ্নহীন ক্ষমতার ফলাফল।
স্কুল নিরাপত্তার শূন্যতা: আর কত প্রাণ গেলে টনক নড়বে? মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি প্রমাণ করে, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা অনিরাপদ! একটি স্কুলের ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়া, ট্রেনের শব্দে কাঁপা দেয়াল, কিংবা গ্যাস লিকেজে আগুন-সবই সম্ভব। কারণ স্কুল ভবন, আশপাশ, জরুরি বাহিনী-কোনো কিছুই শিশুদের নিরাপত্তার উপযোগী নয়। না আছে আগুননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, না আছে রুটিন মহড়া। শিশুদের হাতে পেন্সিল আছে। কিন্তু দেয়ালের ওপারে ওঁত পেতে আছে মৃত্যু। অভিভাবকরা সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। অথচ এই নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের তৎপরতা নেই। শিক্ষা শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ নয়-নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাও তার অপরিহার্য অংশ। এখনই না ভাবলে, পরবর্তী ট্র্যাজেডি শুধু সময়ের অপেক্ষা।
জাতীয় শোক নয়, জাতীয় জবাবদিহিতা চাই: কিছু ঘটলেই শোক দিবস পালন করা হয়। শোক দিবস ঘোষণা যথেষ্ট নয়, শিশুদের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা হলে তার জবাবদিহিও রাষ্ট্রীয়ভাবে হতে হবে। আমাদের দরকার একটি সিস্টেম-যেখানে প্রতিটি স্কুল, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান নিরাপদ; যেখানে অভিযোগের ব্যবস্থা আছে, তদারকি আছে, জরুরি ব্যবস্থা আছে। শোক যথার্থ হয় তখনই, যখন তা থেকে পরিবর্তন আসে। এখন যদি আমরা শুধু কান্না করি, দাবি না তুলি-তাহলে এই মৃত্যু শুধু আবেগ হয়ে থেকে যাবে। আমাদের দরকার আন্দোলন, পরিবর্তনের ডাক। কারণ শিশুরা মরে না, তাদের হত্যা করা হয়-ব্যবস্থাগত অবহেলায়, রাষ্ট্রীয় গাফিলতিতে।
শিশুদের কথা কে বলবে: শিশুরা তো ভোট দেয় না। তাই তাদের নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারো। কিন্তু তাদের কণ্ঠ, তাদের চাহিদা, তাদের নিরাপত্তা-সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক শিশুর মৃত্যুও একটি জাতির ব্যর্থতা। আজ যারা নিথর হয়ে গেল, তারা তো কিছু চাইতে পারেনি-তাদের হয়ে কথা বলার দায়িত্ব আমাদের। এখন যদি আমরা না বলি, তাহলে আগামী প্রজন্মও বিশ্বাস হারাবে এই রাষ্ট্র, এই সমাজ, এমনকি আমাদের ওপরও। শিশুদের কথা বলুন, তাদের পক্ষ নিন। কারণ তারা কথা বলার সুযোগ না পেয়েই চলে যাচ্ছে। এভাবে আর চলে যেতে দেওয়া যাবে না। রাষ্ট্র তার শিশুদের স্কুলেও নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাহলে সে রাষ্ট্র কাদের জন্য? একটি যুদ্ধবিমান, একটি প্রশিক্ষণ প্লেন। অথচ বিধ্বস্ত হলো একটি স্কুলের ওপর! শিশুদের চিৎকার, পোড়া গন্ধ, বইয়ের পাশে রক্ত… এ কেমন অব্যবস্থা? কেমন ‘প্রশিক্ষণ’? স্কুল আছে; কিন্তু নিরাপত্তা নেই। জীবন আছে; কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে তার দাম নেই। রাষ্ট্র তাদের বাঁচতে দেয়নি। রাষ্ট্র তাদের নাম রাখবে না কোনো স্মারকে। কারণ তারা ক্ষমতাধর কারো ছিল না। তারা ছিল কেবল নাম না জানা একটা ভবিষ্যৎ। ধিক রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতাকে! ধিক এই পরিকল্পনাহীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অমানবিক প্রশিক্ষণ-নীতি! আমরা আর চুপ থাকব না। আমরা শুধু শোক প্রকাশ করব না- প্রতিবাদ করব। এই রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। শিশুরা আকাশ চেয়েছিল, আগুনে পুড়ল! প্রশ্ন থাকবেই, কেন নিরাপত্তাহীন আকাশে উড়ছিল যুদ্ধবিমান, আর কেন তার ধাক্কা খেল একদল নিষ্পাপ শিশু?
যাদের ঘরে নিথর শিশু, তাদের শোক কে বোঝে: সেই সব মায়েরা আজ আর কিছুতেই ঘুমাতে পারেন না। চোখ বন্ধ করলেই সন্তানের পোড়া মুখ, বিকৃত শরীর, দগ্ধ মুখের চিৎকার—সব দৃশ্য ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের মতো। এক মা বারবার একই কথা বলেন, ও সকালে শুধু বলেছিল- “মা, একটু লেট হলে রাগ করো না’। ও যে আর ফিরবে না, আমি জানতাম না।” সেই মা এখন নির্বাক, চোখের ভাষায় আর্তি- এত নিষ্ঠুর হতে পারে কি এই পৃথিবী? যাদের ঘরে নিথর শিশু পড়ে আছে, তাদের ব্যথা বুঝে না সমাজ, না রাষ্ট্র। একদিন পত্রিকার হেডলাইন ছিল, পরদিনই আমরা চলে গেছি অন্য শিরোনামে। কিন্তু এই মা-বাবাদের জন্য জীবন থেমে গেছে সেই মুহূর্তেই। এই শোক কখনো মুছে যাবে না, কারণ হারানোর বেদনা চিরস্থায়ী। আমরা যদি না শুনি তাদের কান্না, না বুঝি তাদের নিঃশব্দ আর্তি—তাহলে আমরা আসলে আর মানুষ নই।
শিক্ষক আছে এখনো- যিনি আগুনে বুক দিয়ে বাঁচাতে চাইলেন: ঘটনার বীর দুই শিক্ষক। একজন নিজে পুড়ে সন্তানতুল্য শিশুদের রক্ষা করে প্রমাণ দিলেন তিনি শিক্ষক। আরেকজন নিজের জীবন বাজি রেখে শিশুদের বাঁচাতে এগিয়ে যান। তার শরীর এখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তবুও কেউ মনে রাখবে না তার নাম। এই সমাজে নায়করা পুড়ে যায়, অথচ যারা দায়ী তাদের নাম চিরকাল ধুয়ে যায় রাজনীতি আর ক্ষমতার নদীতে। আগুনের মাঝে যিনি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন “তোমরা দৌড়াও”—সেই কণ্ঠ আজ নেই, সেই হাত আর বাড়ানো হবে না। তার আত্মত্যাগ যেন কেবল খবরে ঠাঁই পায়, অথচ নীতিনির্ধারকের টেবিলে তার সাহস ঠাঁই পায় না। একজন শিক্ষক, যিনি ছিলেন আশ্রয়, যিনি নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করলেন নির্দোষ শিশুদের-তার বীরত্ব আমরা ভুলে যাব একদিন? ইতিহাস তাকে মনে রাখবে, কিন্তু বর্তমান তাকে কি দিলো? এক মিনিট নীরবতা নয়, তার জন্য একটি রাষ্ট্রীয় সম্মান হোক-এই তো প্রাপ্য।
মিডিয়ার ট্র্যাজেডি-ফ্ল্যাশ: কাঁদিয়ে তোলে, ভুলিয়ে দেয় দ্রুত, প্রথম দিন সব মিডিয়ায় মুখর ছিল মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি। ছবিতে দেখানো হলো নিথর শিশুদের মুখ, পোড়া ক্লাসরুম, চিৎকাররত মায়েরা। কিন্তু পরদিনই অন্য ইস্যু, অন্য ‘ট্রেন্ড’। মিডিয়া আমাদের চোখে জল এনে দেয় আবার দ্রুত সেই চোখ শুকিয়ে দেয়। এটাই আজকের ট্র্যাজেডি কালচার-শোকও এখন রেটিংয়ের পণ্য। এই অস্থায়ী সংবেদনশীলতা আমাদের মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা কাঁদি। কিন্তু ভুলে যাই। আমরা মোমবাতি জ্বালাই, কিন্তু দাবি তুলি না। মিডিয়া কি পারে না একটি শিশুমৃত্যুর বিচার নিশ্চিত করতে বারবার প্রশ্ন তুলতে? না কি তারও সীমা ক্ষমতার গণ্ডিতে আটকে থাকে?
বিচারহীনতার সংস্কৃতি: ট্র্যাজেডির পেছনে দায়হীনতা, বাংলাদেশে ট্র্যাজেডির ইতিহাস দীর্ঘ। তাজরীন থেকে চকবাজার, নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইলস্টোন। কিন্তু কয়টায় বিচার হয়েছে? কয়টি পরিবার পেয়েছে ন্যায়বিচার? বিচারহীনতা যেন এই দেশের নতুন নিয়ম। এ সংস্কৃতিই বারবার অপরাধীদের সাহসী করে তোলে। শিশুদের মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না- না ভবনের মালিক, না প্রশাসন, না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদি এবারও বিচার না হয়, তাহলে নিশ্চিত জানবেন- আগামী মৃত্যুর জন্যও আমরা প্রস্তুত করছি মঞ্চ। বিচার চাইলে যারা বলে ‘ঘোলা পানিতে মাছ ধরছো’, তাদেরই চোখের সামনে তৈরি হয় নতুন শবদেহ।
নীতিনির্ধারকদের নৈঃশব্দ্য: নাকি এটাই অভ্যস্ত রাষ্ট্র? এত বড় শিশুমৃত্যুর ঘটনা, অথচ কেউ পদত্যাগ করলো না! কেউ দায়িত্ব নিলো না! বরং ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত অনেকেই। আমাদের দেশে কীভাবে যেন প্রতিটি ঘটনা চাপা পড়ে যায় ‘তদন্ত চলছে’-এর আড়ালে। প্রশ্ন হলো, এত মৃত্যু দেখেও যারা দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না—তারা কীভাবে নীতিনির্ধারক হন? একজন শিক্ষামন্ত্রী, একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টা, একজন সিটি কর্পোরেশনের প্রধান—তারা কীভাবে ঘুমান? এই নৈঃশব্দ্য যেন এক নিষ্ঠুর অভ্যস্ততা, যেখানে রাষ্ট্র শুধু দেখেও না দেখার ভান করে।
নিরাপত্তাহীন নগরায়ন: শিশুদের জন্য মৃত্যুফাঁদ—ঢাকা ও আশপাশের এলাকা এতই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে, যেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই একেকটি মৃত্যুফাঁদ। গ্যাসলাইন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ সংযোগ, পুরোনো ভবন থেকে ট্রাফিক-সবই বিপদের উৎস। আমরা পরিকল্পনাহীনভাবে এক শহর গড়েছি- যেখানে শিশুদের স্বপ্নের জায়গা নেই। স্কুলগুলো যেন কারখানা, যেখানে শুধু পাঠ্যপুস্তক ঢুকিয়ে সার্টিফিকেট বের হয়। তাদের নিরাপত্তা, আবেগ, আনন্দ- সব উপেক্ষিত। এই নগর পরিকল্পনা, এই মনোভাব বদলাতে না পারলে, আমরা প্রতিনিয়ত নির্মাণ করবো মৃত্যু।
উপসংহার: তারা বই হাতে স্কুলে এসেছিল, ক্লাসে বসতে, খেলতে, ভবিষ্যতের গল্প শুনতে। কেউ ডাক্তার হতে চেয়েছিল, কেউ শিক্ষক, কেউ হয়তো কেবল খেলার ছলে বড় হতে চেয়েছিল। কিন্তু ফিরে গেল না আর। কাঁধে বই নয়, উঠলো কফিন। টিফিন বক্সে রাখা খাবার শুকিয়ে গেল- খুলে দেখারও সময় হলো না। মা টিফিনে আদর রেখেছিল; সেই আদরও অভিশাপে রূপ নিলো।
এই কলাম লিখতে লিখতে কাঁপছে আঙুল, ঝাপসা হয়ে আসছে পর্দা। কারণ ওরা তো আমার-আপনার ঘরের শিশুই। আপন ঘরের হাসি, স্বপ্ন, অবুঝ জেদ। যারা চিৎকার করতে পারেনি, যারা জানতে পারেনি কেমন মৃত্যু তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল—তাদের হত্যাকারী আসলে আমাদের নিষ্ক্রিয়তা, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘুম। শুধু প্রশ্ন রেখে যেতে চাই রাষ্ট্রের দরজায়- এই মৃত্যুর ভার কে নেবে? আর কতটা নিস্তরঙ্গ শিরোনাম হলে কানে পৌঁছবে শাসকের? আর কত শিশুর প্রাণ গেলে আপনার ঘুম ভাঙবে? না হয় ধরে নেব, আমরা এক নিষ্প্রাণ প্রজাতি- যাদের চোখে জল আছে, কিন্তু হৃদয়ে দাহ নেই।
লেখক: মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ