মনজুরুল আলম মুকুল
রাস্তায় গুলি, ট্যাংক, আকাশ থেকে হামলা, মানুষের মধ্যে শুধু মৃত্যু আতঙ্ক। মৃত্যুর মিছিল যেন বেড়েই চলেছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে জানাজার নামাজে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। দেখা দিয়েছে কবরস্থানের সংকট। পুরনো কবর খনন করে নতুন দাফনের জায়গা তৈরি হচ্ছে। অনেক সময় একাধিক মৃতদেহ একসাথে বা দ্রুত সমাধিস্থ করা হচ্ছে। গাজায় নিহত বেশির ভাগ শিশু ও নারী। অথচ এই শিশুরা বোঝে না মুসলমান আর ইহুদির পার্থক্য। হামলা হচ্ছে হচ্ছে স্কুল, হাসপাতাল, শিশুদের আশ্রয়কেন্দ্রসহ, সর্বত্র।
পৃথিবীর অনেকে বন্দুক দিয়ে মানুষ হত্যা শুনেছে, পড়েছে। কিন্তু চোখে দেখিনি। ইসরায়েলের বাহিনী প্রকাশ্যে এই কাজ প্রতিদিন করে যাচ্ছে। নির্মম বুলেট ক্রমাগত বিদ্ধ করে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। বিবেকবান মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এভাবে মানুষ পাখিদেরকেও মারতে পারে! ইসরায়েলের বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের গণমাধ্যমে ভিডিও ও ছবি দেখে মানুষ বাকরুদ্ধ, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ পৌঁছেছে (ইসরায়েলের পত্রিকা হারেৎজ এর খবর অনুযায়ী)। আহত বা পঙ্গু হয়েছে প্রায় দুই লাখ মানুষ। গাজায় ছোট-বড় কোনো বাড়ি, দোকানপাট ও অবকাঠামো আর অবশিষ্ট নেই। ইসরায়েলি বিমান আর ট্যাংকের গোলায় সবই বিধ্বস্ত, মাটির সাথে মিশে গেছে। শুধু ধ্বংস নয়, গাজার অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়েছে, সেখান হবে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন ও অবকাশ যাপন কেন্দ্র।
ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্না, মায়েদের অসহায়ত্ব, বয়স্কদের নিস্তব্ধতা যেন গাজার বাস্তবতা। অনাহার, অর্ধাহার যেন গাজা উপত্যকার মানুষদের নিত্যসঙ্গী। ক্রমাগত হামালায় জমিতে চাষাবাদ বন্ধ। দীর্ঘকাল থেকে গাজা উপত্যকা কঠোর ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে রয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিছু পাঠাতে চাইলেও অবরোধ ও নিরাপত্তার অজুহাতে অনেক সময় এই সাহায্য আটকে থাকে। কিছতা সাহায্য ঢুকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য।
বাজারে দ্রব্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। কিছু পাওয়া গেলেও চড়া দামের কারণে মানুষের নাগালের বাইরে। খাদ্য সংকট এতাই তীব্র যে অনেক পরিবার গাছের পাতা, পশুর খাদ্য, এমনকি ঘাস সিদ্ধ করে খাওয়ার খবর গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। অনেক শিশু দিন কাটায় শুধু পানি বা এক টুকরো শুকনো রুটি খেয়ে। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী ফিলিস্তিনি শিশুদের সবচেয়ে বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে। গাজাবাসীর খাবার পাওয়ার একমাত্র উৎস হলো ত্রাণকেন্দ্রগুলো। খাবার না পাওয়ার অর্থ হলো ফিলিস্তিনি শিশুদের অনাহারে থাকা। অথচ এই সামান্য ত্রাণের বিনিময়ে তাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলেট। ত্রাণকেন্দ্রগুলো যেন ‘কিলিং ফিল্ড’ বা বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের শিশু শৈশব এখন বিপন্ন। প্রতিদিনের গোলাবর্ষণ, বিমান হামলা বা সামরিক অভিযানের মধ্যে বড় হয় ফিলিস্তিনের শিশুরা। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের শিশুরা খেলাধুলা, শিক্ষা ও নির্ভয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পায়; সেখানে ফিলিস্তিনের শিশুরা বেঁচে থাকার সংগ্রামেই দিন কাটায়। তারা চোখের সামনে হারায় মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু কিংবা নিজের ঘরবাড়ি। অনেক শিশুই বোমার আঘাতে পঙ্গু হয়ে যায় বা চিরতরে হারায় দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি কিংবা কথা বলার সামর্থ্য।
স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে, শিক্ষার পরিবেশ নেই; নেই শিক্ষক বা বই-খাতা। আবার অনেক শিশু প্রিয়জন-বিচ্ছিন্নতার টানাপড়েন, মৃত্যু, শোক, ধ্বংস, ভয়, উদ্বেগ ও হতাশা থেকে নানা মানসিক সমস্যায় পড়ছে। আবার ইসরায়েলের সেনা দ্বারা ধর্ষিতও হয় শিশু ও নারীরা- যাদের আজীবন বয়ে চলতে হয় এই ক্ষত। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের এই অমানবিকতা যেন পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুসারে নাইল (মিসর) নদী থেকে ইউফ্রেটিস (ইরাক) নদী পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড নিয়ে গ্রেটার ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের শত বছরের পরিকল্পনা নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে।
১৯৯৩ সালে শান্তি চুক্তি ও ১৯৯৮ সালে ভূমির বিনিময়ে শান্তি চুক্তি হলেও সেগুলো লঙ্ঘন করে বার বার আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ইসরায়েল কোন আন্তর্জাতিক আইন, মানবতা কিছুই মানে না। খোড়া যুক্তি বা অজুহাত দেখায়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর একের পর এক নিপীড়নের খড়গ চালিয়ে আসছে।
জাতিসংঘের ব্যানারে পরাশক্তিগুলোর তত্বাবধানে ১৯৪৭/৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের আবাসভূমি দখল করে কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরায়েল সৃষ্টি হয়। সেই সময় পাশে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল কিন্তু সেটা কাগজে-কলমেই থেকে যায়। কয়েক প্রজন্ম ধরে ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ কাম্পে বসবাস করে যাচ্ছে, সেটাও এখন সম্ভব হচ্ছেনা।
সূচনাটা অনেক আগে থেকে শুরু হয় যখন ১৮৯৭ ইহুদি কংগ্রেসে তাদের নেতা থিওডর হার্জেল ফিলিস্তিনিদের এলাকায় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। একই সালে ফ্রান্স, ব্রিটেন, রাশিয়া ও আমিরিকা এই ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। শুরু হয় ইহুদি বসতি স্থাপন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন আরবীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ১৯১৯ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর ইহুদি আগমন ব্যাপকহারে শুরু হয়। ১৯২১ সালে আরব-ইহুদি দাঙ্গায় প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি মারা যায়।১৯২২ সালে লীগ অব নেশনস ইহুদিদের বসতি স্থাপনের বৈধতা দিয়ে দেয়।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে, অনেক সমাজ বা সভ্যতায় কিছু নির্দিষ্ট জাতি, সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী নিষ্ঠুর অত্যাচার ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এমনকি অনেককে পূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এক সময় কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসাবে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হতো না। ১৬০০ থেকে ১৯০০ শতক পর্যন্ত আফ্রিকা থেকে লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে জোর করে ধরে এনে ইউরোপ, আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাস হিসেবে বিক্রি করা হত। তবে এর পূর্বেও পৃথিবীতে দাস প্রথা বিদ্যমান ছিল। তাদের জীবনের কোনো মূল্য ছিল না, মালিকের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হত।
আমেরিকার সংবিধান রচনার সময় ১৭৮৭ সালে একটি আইন পাস হয় যেখানে বলা হয়, ৫ জন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ থাকলে তিন জন মানুষ বা ভোটার হিসেবে বিবেচিত হবে। যদিও এক সময় এই আইন বাতিল হয়ে ছিল। এক সময় এমন ধারণা ছিল- কৃষ্ণাঙ্গরা ক্ষুধা, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা অনুভব করে না। শারীরিক পরিশ্রমে ক্লান্ত হয় না, তাই তাদেরকে দিয়ে কষ্টের ও আমানবিক কাজ করা হত। এই ভুল ধারণাটি চিকিৎসাশাস্ত্রেও ছিল। যে কারণে কৃষ্ণাঙ্গ রোগীদের ব্যথানাশক দেওয়া হত না। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহারের ইতিহাসও আছে। কৃষ্ণাঙ্গ নারী দাসদের ওপর যন্ত্রণাদায়ক অস্ত্রোপচার চালানো হয়েছে কোনো ধরনের অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই। অথচ শ্বেতাঙ্গ নারীদের অস্ত্রোপচার করা হতো যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে এবং অবশ্যই অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা হতো।
ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকরা স্থানীয় আদিবাসীদের (নেটিভ আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান আবোরিজিনাল, ইত্যাদি) মানুষ হিসেবে না দেখে ‘বনের মানুষ’ হিসেবে অপমান করার কথা জানা যায়। আজ যারা নিজেদের কে সভ্য মনে করে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে তারা ১৯২০ সালের আগে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি; এমনকি আফ্রিকা ও এশিয়ানদেরও এক প্রকার অবজ্ঞা ও বর্ণবাদী মনোভাবের চোখে দেখত।
বর্তমানে আইনি ও সামাজিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ ও অন্যান্যদের মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা দেওয়া হলেও, অনেক মানুষ এখনো বর্ণবাদী মনোভাব বা ব্যবস্থাগত বৈষম্য থেকে ফিরে আসতে পারেনি। ইতিহাসের এমন জাতি, সম্প্রদায় বা ধর্মের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও বৈষম্যের শিকার ফিলিস্তিনি জনগণ। সবচেয়ে বড় পরিতাপের বিষয় পৃথিবীর কথিত সভ্য সমাজ, নিয়ন্ত্রক ও ক্ষমতাধরদের কাছে ফিলিস্তিনিরা যেন এখনো মানুষ হতে পারিনি।
ফিলিস্তিনিরাও মানুষের মতো ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, আপনজন হারানোর বেদনা উপলব্ধি করে, ভালোবাসে, স্বপ্ন দেখে, ক্ষুধার্ত হয়। পৃথিবীর অনেকে এখন বিষয়গুলো ভুলে যেতে বসেছে। ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার নামে ইসরায়েল যেন ফিলিস্তিনিদের নির্ধনে নেমেছে। এক ইহুদি এনজিও প্রধান দাম্ভিকতার সাথে বলেছিলেন তিনি যদি মার্কিন সিনেটে একটি সাদা রুমাল পাঠান, তাহলে এতে অন্তত ৭০ জন সিনেটর স্বাক্ষর করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ ইহুদি সম্প্রদায়ের অথচ তারা সে দেশের মোট সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের মালিক। তেমনি বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২ শতাংশ ইহুদি তবে তারা বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশের মালিক। বিশ্বের শীর্ষ ১০ জন ধনী ব্যক্তির মধ্যে কয়েকজন ইহুদি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ব্যবস্থা, গণমাধ্যম, হলিউড, ধর্মসহ অনেক কিছু ইহুদি লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, পৃথিবীর আরো কয়েকটি প্রভাবশালী দেশও ইহুদি-ইসরায়েল লবি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তারা সব সময় ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার কাজ করে চলেছে। এসব কারণে ইসরায়েল বর্তমানে সারা বিশ্বে ধরা কে সরাজ্ঞান করতে চায়। বারবার অপরাধ করার পরও তারা সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এমন কথাও প্রচলিত আছে, ইসরায়েল বা ইহুদিদের স্বার্থ না দেখলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জয়লাভ করা বা টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ পর্যন্ত আরব-ইসরায়েল ৪টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে। কতিপয় পরাশক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রতিা যুদ্ধে তারা জয় পায় ইসরায়েল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ স্থায়ী হয়ে ছিল মাত্র ছয় দিন। এই যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েল প্রতিবেশী মিসরের সিনাই ও গাজা উপত্যকা, জর্ডানের পশ্চিম তীর ও জেরুসালেম ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
১৯৮২ সালে ইসরায়েল লেবাননে আগ্রাসন চালায় এবং সেখানে নির্বিচার হাজার হাজার নাগরিক হত্যা করে। ১৯৮৬ ও ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত লিবিয়ায় হামলা হয়। ২০০৩ সালে তথাকথিত ‘ঐচ্ছিক জোট’ পরিচালিত যুদ্ধ ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। নারী, শিশুসহ লাখ লাখ ইরাকি প্রাণ হারায়। তাদের দাবি ছিল, ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, যদিও শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আর এসব কাজে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল ইসরায়েল।
১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরায়েল বিমান হামলা করে ধ্বংস করে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল-তুয়াতিয়াহতে নির্মাণাধীন ওসিরাক পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রের গোলাকার গম্বুজ। অপারেশন ব্যাবিলনের ২৬ বছর পর ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইসরায়েল একই রকম হামলা চালিয়ে সিরিয়ার কথিত আণবিক কর্মসূচি স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। তবে সিরিয়ার সরকার কখনোই স্বীকার করেনি যে, কোনো ধরনের পারমাণবিক কর্মসূচি তারা নিয়েছিল; এমনকি পাকিস্তানের কাহুতায় অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার পরিকল্পনাও করেছিল।
১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর থেকে ইসরায়েল ধ্বংসের হুমকি দিয়ে আসছে। ১৯৯২ সাল থেকেই তারা দাবি করে আসছে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বার প্রান্তে। গত ১৩ জুন কোনোরকম বিনা উসকানিতে ও কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই গভীর রাতে ইসরায়েল স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ ইরানের ওপর ২০০ জঙ্গি বিমান নিয়ে হামলা শুরু করে। ১২ দিনের এই হামলায় ইরানে অন্তত ১০০০ জন নিহত এবং ৬০০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। এক ডজনের ও বেশি শীর্ষ সামরিক ও পরমাণু বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক অবকাঠামোসহ তিনটি মূল পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা চালিয়েছে।
ইসরায়েল সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছেই। ২০২৩ সালে ১৭ বিলিয়ন ডলার, ২০২৪ সালে ২৮ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালে (প্রাক্কলন) ৩৪ বিলিয়ন ডলার। আসল উদ্বেগের জায়গা হলো, একটি দ্বিমুখী নীতিমালা বলবৎ রাখা হয়েছে যেন ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে, অন্য কেউ নয়। বিশেষ করে এই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলটিকে যেকোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব। ইসরায়েল যেন পশ্চিমাদের একটি ঘাঁটি, কোন দেশ নয়।
ইসরায়েল অনেক আগেই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে অথচ পশ্চিমা বিশ্ব, জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের ‘আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা’ (আইএইএ) সবকিছু দেখে না দেখার ভান করেছে। বর্তমান বিশ্বে শক্তি বা বল প্রয়োগের নীতি এখন শান্তির মানদণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদার ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শান্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে; যার কাছে পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য মারণাস্ত্র, অত্যাধুনিক ফাইটার জেট, ক্ষেপণাস্ত্র, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাবমেরিন, শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে সেই শান্তিপ্রিয়। আর যাদের এসব কিছু নেই তারাই অশান্তিপ্রিয়, সন্ত্রাসবাদী ও বিশ্ব নিরপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যারা যুদ্ধ বাঁধায়, অস্ত্র সরবরাহ করে, মানুষ হত্যা করে, মানুষের আবাসস্থল গুঁড়িয়ে দেয় তারাই আবার নোবেল শান্তি পুরষ্কারের দাবি তোলে।
বিশ্বের অনেকে ইসরায়েলের অব্যাহত গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছেন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে একটি মামলা চলছে; যা দক্ষিণ আফ্রিকা দায়ের করেছে। ইতালির আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী ফ্রানচেস্কা আলবানিজ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে এই বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। এতকিছুর পরও ইসরায়েলের গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দাম্ভিকতা অব্যাহত আছে। কারণ ইসরায়েল জানে প্রবাবশালী বিশ্ব মোড়ালরা তার পকেটে।
ইসরায়েলকে থামানোর জন্য এক্ষণই পদক্ষেপের প্রয়োজন। তা না হলে বিশ্ব বিবেককে যে একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় উঠতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ