মো. মাঈন উদ্দীন
বাংলাদেশে চব্বিশের জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব হয়েছিল সেটি পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণে তৈরি হয়েছিল বিপ্লবের পাটাতন। মূল নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ-যুবকরা। তরুণদের ডাকে সেদিন রাজপথে নেমে আসে শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। যেটি পরবর্তী সময়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। দুই মাসব্যাপী রক্তাক্ত আন্দোলনের সফলতা ফিরে আসে ৫ আগস্ট, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে। তরুণ ছাত্র-শক্তি ছিল বিপ্লবের অগ্রভাগে। তৎকালীন অরাজনৈতিক সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই বিপ্লব সংগঠিত হলেও যা অতিদ্রুত সব পেশা, শ্রেণি ও গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়।
ওই আন্দোলনের নেতারা ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যত নির্মাণে জীবন ঝুঁকি নিয়েছিল। পুলিশের নির্যাতন, ডিবি অফিসের নানা ভয়-আতঙ্ক টলাতে পারেনি নাহিদ-হাসনাত-আসিফদের। তাদের দৃঢ়চেতা নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৭ বছরের অন্ধকার ভেদ করে আলোর দেখা মিলেছে। গুলি-গ্রেনেড-হামলা-মামলার মুখে বিরোধী দলের একের পর এক আন্দোলনের ব্যর্থতায় একটা সময় দেশের মানুষ মনে করতে শুরু করে যে, এই জগদ্দল পাথরকে বাংলার জমিন থেকে সরানো যাবে না। আন্দোলন করে লাভ হবে না। সেই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছে তারুণ্য।
এখানে ২৫ বছর বয়সি আবু সাঈদের কথা না বললে আমার এ লেখা সার্থকতা ফিরে পাবে না। এ মেধাবী ছাত্র ছিলেন আন্দোলনটির অন্যতম নেতা। বিক্ষোভের সময় তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছিলেন। পুলিশ তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে। এ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দাবানলের সৃষ্টি করে, লাখ লাখ তরুণকে রাজপথে আরও সংঘবদ্ধ করে।
শুধু ছাত্ররা নয়, শিক্ষক, আইনজীবী, অভিভাবক, রিকশাওয়ালা, হকাররা পর্যন্ত রাজপথে নেমে আসে রাজপথে, তাদের দৃঢ়তা ফ্যাসিবাদী শক্তির মূল উৎপাটন করে দিয়েছে। যার ফলে মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ১৮ কোটি মানুষ।
চব্বিশের ৫ আগস্ট এদেশে গণআকাঙক্ষার বিজয় হয়েছে। দর্প চূর্ণ হয়েছে ১৭ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার। যারা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ গোটা অর্থনীতিকে। বেকার হয়ে পড়ে লাখ লাখ তরুণ।
বিপ্লবের বার্ষিকী চলে এলেও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এখনো হয়নি। এখনো সচল হয়ে ওঠেনি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো। কারণ স্বৈরাচারের দোসর ও তাদের পদায়নের লোক এখনো বহাল তবিয়তে অনেক জায়গায় ঘাঁপটি মেরে বসে আছে। যার ফলে সংস্কার, বিচার ও নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় তা এখনো দৃশ্যমান নয়।
৫ আগস্ট এদেশে গণআকাক্সক্ষার বিজয় হয়েছে ঠিক কিন্তু এ বিজয়ের সুফল ভোগ করতে প্রয়োজন সংস্কার ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। দরকার আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন। অর্থনীতিতে নানা সমস্যা সত্ত্বেও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের অর্তনীতিতে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধি প্রবণতা অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষকেও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। কারণ পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ের যে তথ্য, ডাটা তার বিশ্বাস যোগ্য তা নিয়ে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মাঝে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারার কথা বলতে গেলে বলতে গেলে তিন ভাগে সময়কে ভাগ করে নিতে হবে। স্বৈরাচারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ প্রায় ষোল বছরের অর্থনীতি, তার আগের অর্থনীতি ও ৫ আগস্ট ২০২৪ পরবর্তী অর্থনীতি। বিগত সময়ে স্বপ্ন দেখিয়ে রূপকল্প ঘোষণা করেছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার।
নানা কথামালার ফুলঝুরি আর পরিসংখ্যান জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থনীতির নানা সূচককে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়ে উন্নত রাষ্ট্রের অভীষ্ট লক্ষ্যে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করবে- এমন প্রচার-প্রপাগান্ডা ছিল তুঙ্গে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু হাসিনার সরকার অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্পে উদারহস্তে ঋণগ্রহণ করে ১০৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের ভার এ দেশের সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপিয়ে গেছে।
অন্যদিকে অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অর্থনীতির সমৃদ্ধি নিয়ে যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল ছিল না। সোনালি দিনের কথা বলে মিথ্যাচার করা হয়েছে। তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। ব্যাংক খাত দুর্দশায় নিপতিত হয়েছিল।
যখনই সংকটের মাত্রা বেড়েছে, তখনই মিথ্যাচার করে সংকটকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় বৈদেশিক ঋণ ও অর্থপাচারের ফলে বিগত হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হওয়ার দিকে যাচ্ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।দেশের ব্যাংক খাতকে ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দেশের জাতীয় পত্রিকায় উঠে আসে বিগত সরকারের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র। আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট এক এস আলম গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে দেশের সাতটি ইসলামী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটি নামে-বেনামে প্রায় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের নামে কমপক্ষে দুই লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
পত্রিকায় আরো এসেছ শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ৫০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। হাতিয়ে নেওয়া এসব অর্থের প্রায় পুরোটাই বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। শেয়ারবাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে। শুধু বন্ডের মাধ্যমে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বাজার থেকে।
গত সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ পিএমআই সূচক ছিল ৪৯ দশমিক ৭, আগস্ট মাসে যা ছিল ৪৩ দশমিক ৫। পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর নিচে থাকার অর্থ হলো, অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে এই সূচক প্রণয়ন করা হয়, অর্থনীতির মূল চারটি খাতের ভিত্তিতে—কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা। দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ কেবল উৎপাদন খাত সম্প্রসারণের ধারায় ফিরেছে। বাকি তিনটি খাত সংকোচনের ধারায় ছিল।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জুলাই ও আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনীতির নানা সমস্যা, অনিয়ম, দুর্নীতির চিত্র জনগণের নিকট পরিষ্কার হতে থাকে। ব্যাংক খাত, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মেগা প্রকল্পসহ যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও নানা রকম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মতো ঘটনাও উঠে আসে। এক কথায় অর্থনীতির প্রতিটি খাতে বৈষম্য ও লুটপাটের চিত্র উঠে আসে। বিগত ১৬ বছরে জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, বড় অংকের অর্থ পাচার করে নেয় কিছু ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা; যার ফল বর্তমান জনগনকে ভোগ করতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দীর্ঘ সময় ধরে কম বিনিয়োগ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণের লাগামহীন ধারা আর সামষ্টিক অর্থনীতিতে গুরুতর কিছু দুর্বলতা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমায় মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের পর চলমান অর্থনীতি নানাবিদ সংকটে পতিত হচ্ছে।
গত সরকার অপ্রয়োজনীয় নানা প্রকল্পে উদারহস্তে ঋণগ্রহণ করে ১০৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণের ভার এ দেশের সাধারণ জনগণের কাঁধে চাপিয়ে গেছে। তবে আশার বিষয় হলো, চলমান অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছেন যার ফলে আমাদের বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ কিছু সেক্টরে ইতিবাচক অবস্থা লক্ষণীয়। বিগত হাসিনা সরকার অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।
শেখ হাসিনার আমলে ২৩৪ বিলিয়ন অর্থ পাচার হয়েছে বলে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ অর্থের পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। আবার বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হয়েছিল, এর একটি অংশও পাচার হয়ে গেছে। অন্যদিকে আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। কিন্তু এ উত্তরণের ফলে অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, সেগুলো মোকাবিলা নিয়ে বিশ্বব্যাংক দেশের অর্থনীতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি; যা কিছতা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিস্থ খাতের চাপ- যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা। তা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কাজ করতে হবে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
সম্প্রতি ব্যাংক খাতের আমানত পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হয়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত এক বছরে আমানত ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ বেড়ে ১৯ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তিন মাস আগে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মূলত ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরতে শুরু করায় আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। তবে সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অনেকে ভালো ব্যাংকে রাখছে। এ কারণে কিছু ব্যাংকে আমানত কমার ধারা অব্যাহত আছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৪০ হাজার ১৮ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরের পর প্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি একটু করে বাড়ছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয় ৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে আরও বেড়ে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ হয়। সেখান থেকে মার্চে আরও বেড়েছে। গত মার্চ পর্যন্ত ঋণ ৮ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়ে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। তিন মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে যেখানে স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানত বাড়লেও কিছু ব্যাংকে এখনো আমানত উত্তোলনের চাপ রয়েছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ ফেরত আসছে কম। আবার নতুন করে সেভাবে আমানত পাচ্ছে না। এতে সরকারি-বেসরকারি খাতের ১১টি ব্যাংকের আমানত কমে গেছে। এ তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার সমস্যাগ্রস্ত জনতা ও বেসিক ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার এ ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে গেছে। তার পরও এ ব্যাংকের কাঠামো মজবুত হওয়ার কারণে ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
ব্যাংকটির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইসলামী ব্যাংক আমানত সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও রেমিট্যান্স আহরণ করেছে। যতটুকু পারছি, ততটুকু এলসি খুলে যাচ্ছি। গত ১০ মাসে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। বর্তমানে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা; যা ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ। এ সময় নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ২৪ লাখ ৩০ হাজার ৬০০টি। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আমানত হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ব্যাংকটি নগদ জমা সংরক্ষণ অনুপাত (সিআরআর) ঘাটতি থাকলেও এখন তা আট হাজার কোটি টাকা ইতিবাচক রয়েছে।
ওবায়েদ উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চলতি হিসাবের ঘাটতি ২ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নিয়ে এসেছি। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আমরা কোনো ধারও নিচ্ছি না। ১০ মাসে এটা অনেক বড় সফলতা। আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরো পরিবর্তন দেখা যাবে, সেভাবে পরিকল্পনা নিয়েছি। আশা করি, ২০২৬ সাল শেষে মোট আমানত ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিনিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংক সারা দেশে ৩৪ হাজার ৯০০ গ্রামে উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে যুগান্তকারী আর্থসামাজিক রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে, যে বিনিয়োগের ৯৭.৩৮ শতাংশই ফেরত এসেছে। বর্তমানে সারা দেশে এ প্রকল্পের আওতায় ৮ লাখ ৪৬ হাজার উদ্যোক্তার মধ্যে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ রয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা।
এবার জুলাই বিপ্লব ও তার পূববর্তী ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কিছু করণীয় বা পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা যাক। জুলাই বিপ্লব বার্ষিকীতে আমাদের দেখা উচিত ভঙ্গুর অর্থনীতির অগ্রগতি কতটুকু হলো ও কীভাবে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। যেমন-
১. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অর্থনৈতিক নীতি (মুদ্রা সরবরাহ কমানো, সুদের হার সামঞ্জস্য করা); বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে (রেমিট্যান্স ও রপ্তানি উৎসাহিতকরণ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ) জোরদার পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
২. রফতানি ও শিল্প খাতের পুনরুজ্জীবন: পোশাকশিল্পের পাশাপাশি নতুন রপ্তানিখাত (ডিজিটাল সেবা, ফার্মাসিউটিক্যালস) উন্নয়ন ঘটানো; শিল্প খাতে বিনিয়োগের জন্য কর প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা উচিত ।
৩. সামাজিক সুরক্ষা জোরদার: দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নগদ সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা উচিত; বেকারত্ব মোকাবিলায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে হবে।
৪. অবকাঠামো ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: জ্বালানি ও পরিবহন খাতের উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে; ৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা উচিত; বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (ঋউও) আকর্ষণের জন্য নীতি সহায়ক পরিবেশ তৈরির প্রয়োজন।
৫. সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: দুর্নীতি কমানো ও সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা নিশ্চিতকরণ; রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে নীতি সহনশীলতা প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকা।
৬. ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ: ই-কমার্স, ফিনটেক ও ডিজিটাল লেনদেনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার প্রতি মনোযোগী হওয়া।
৭. জ্বালানি নিরাপত্তা: গ্যাস ও বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প উৎস (নবায়নযোগ্য শক্তি) অনুসন্ধান।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য স্বল্পমেয়াদে স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সমন্বয় প্রয়োজন। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংহতি বজায় রাখা অপরিহার্য।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ