শায়রুল কবির খান
২০২৪ সালের ১ জুলাই একটি আপাতদৃষ্টিতে শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে। কিন্তু কেউ কি জানত, এ সাধারণ দাবিই মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে রূপ নেবে এক রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে? এর পরিণতিতে বদলে যাবে দেশের ক্ষমতার চিত্রপট, আর দীর্ঘ ১৬ বছরের একক শাসককে বাধ্য করবে দেশ ছেড়ে পালাতে? হ্যাঁ, ১৫ জুলাই থেকে সেই আন্দোলনে নামল গুলি, ছিটল রক্ত, আর ঢাক-ঢোল ভেঙে উঠল জনতার স্বর: ‘গণতন্ত্র চাই!’ শেষ পর্যন্ত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের এক নজিরবিহীন, অনিবার্য পতন।
রক্তাক্ত রাজপথের সেøাগান ও শহীদের আত্মত্যাগ: ওই ৩৬ দিন রাজপথ জুড়ে উচ্চারিত হচ্ছিল এমন সব স্লোগান, যা কেবল রাজনীতি নয়, জাতির আত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। রাজপথ যে সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত ছিলো: ‘জাস্টিস জাস্টিস ইউ ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’; ‘আমার খায় আমার পরে আমার বুকে গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দে’; ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছেড়ে দে’; ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাল্গুনেই হবে দ্বিগুণ’; ‘আমি কে, তুমি কে- রাজাকার, রাজাকার’; কে বলেছে, কে বলেছে- স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’।
জুলাই ও আগস্টের সেই ৩৬ দিন কোনো সাধারণ রাজনৈতিক মোড় ছিল না। এটা ছিল এক যুগান্তকারী গণআন্দোলনের বিস্ফোরণ। শহরের অলিগলি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, গ্রামীণ হাট থেকে দেশের প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত প্রতিটি জায়গা রূপ নিয়েছিল সংগ্রামের মঞ্চে। নির্মম সত্য হলো- এই বিপ্লব শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে প্রতিদিন গণমাধ্যমে শহীদদের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতাল থেকে বিএনপির উদ্যোগে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারও শহীদদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৭ মে পর্যন্ত খসড়া তালিকা অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৮৩৪।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ জন পর্যন্ত হতে পারে। এর মধ্যে কত শত মা-বাবা তাদের সন্তানের লাশ কোলেপিঠে করে বাড়ি ফিরেছেন, কত পরিবার আজও শোকে কুঁকড়ে আছে- এর কোনো পরিসংখ্যান নেই।
শুধু সংখ্যাই নয়, বরং প্রতিটি নামের পেছনে আছে এক করুণ গল্প। এই গণআন্দোলন জাতীয় গণমাধ্যমের অসংখ্য শিরোনাম বিশ্ববাসীকে স্পর্শ করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি শিরোনাম ছিল- ‘যা বাবা ভালো থাকিস বলে গুলিতে শহীদ সাঈদকে চিরবিদায় মায়ের’; ‘মুগ্ধের আন্দোলন তো এখনো শেষ হয়নি’; ‘অটোরিকশায় বসে কোলে করে ছেলের লাশ বাসায় আনি’; ‘কোটা আন্দোলনে শহীদ ফারহান এমন জীবন গড়ো যাতে মৃত্যুর পর মানুষ মনে রাখে’; ‘আমার ডাক্তার ছেলেকে তারা গুলি করে মারবে কেন?’; ‘মেয়ের জন্য চিপস কিনে বাসায় ফিরতে পারলেন না মোবারক হোসেন’; ‘যাত্রাবাড়িতে সংঘর্ষ রোহান আর মাহাদীর স্বপ্ন থেমে গেল গুলিতে’; ‘আমার নিরীহ ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে ওরা’। এসব শিরোনাম শুধু সংবাদ নয়, এগুলো একেকটি ফেটে পড়া হৃদয়ের আর্তনাদ।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসনের আকাক্সক্ষা: এই অসংখ্য শহীদ, আহত ও ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত লাশের ওপর দাঁড়িয়েই জুলাই গণঅভ্যুত্থান অর্জিত হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা একটাই – ‘গণতন্ত্র’; যার সাথে পুরোপুরিভাবে জড়িত ভোটাধিকার, মানবাধিকার ও সুশাসন। এর কোনো বিকল্প নেই, কোনো যুক্তিও নেই।
ওই অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব নিয়ে অনেকেই নানা দাবি করছেন। তবে প্রকৃত সত্য হলো, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামই এই গণঅভ্যুত্থানের পথ তৈরি করেছে। ধাপে ধাপে কোটা বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এটি চূড়ান্ত এক দফায় রূপ নেয়; যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন।
৩ আগস্ট কারাগারে আটক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর সহধর্মিণীকে দেখতে গিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আত্মবিশ্বাসের সাথে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ছাত্র-শ্রমিক-জনতার এই আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সফল হবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। শুধু বিএনপি নয়; অনেক বামপন্থি, মধ্যপন্থি দল, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ কৃষক-মেহনতি মানুষ- সবার এক দাবিতে মিলেছিল কণ্ঠস্বর: ‘শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের অবসান চাই।’
দমনের চেষ্টা ও জনগণের জাগরণ: ১৮ জুলাই সারা দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিকল হয়ে পড়ায় তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার একতরফা ভাষ্য প্রচার করে যায়। সরকারের কথা শুনে মনে হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সব দাবি পূরণ হয়ে গেছে। ছাত্রদের হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে; যেন ক্ষোভ যা চলছে, তা কেবলই বিএনপিসহ বিরোধী গোষ্ঠীর তৎপরতা।
মূলত উচ্চ আদালতের যুক্তিসংগত রায়ের মাধ্যমে ছাত্রসমাজের কোটা সংস্কার দাবিটি পূরণ হয়েছিল বলা যায়। তবে এ দাবি পূরণের পথ তাদের সহযোদ্ধা ও সহপাঠীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বহু ছাত্রসহ ১৫ দিনে শতাধিক মানুষ জীবন হারিয়েছেন। আরও অনেক বেশি মানুষ গুলিবিদ্ধ ও আহত হয়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে আহত মানুষ পুনরায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছাত্রসহ তাদের সমর্থকদের ওপর এই নির্বিচার আক্রমণ করেছে সরকারি দলের সংগঠন ও সরকারের বাহিনীগুলো। এসব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে সরকারি দলের নেতাদের নির্দেশ বা উসকানিতে- এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ গণমাধ্যমে ছিল।
সরকারি স্থাপনায় নাশকতার জন্য তদন্তের আগেই ঢালাওভাবে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাদের দায়ী করে গ্রেফতার করে দাম্ভিকতা দেখানো হয়েছিল। এই দাম্ভিকতা তৈরি হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি করে সমাবেশ পণ্ড করার মধ্য দিয়ে।
শত শত ছাত্র এবং হাজারো মানুষের রক্তে রঞ্জিত এই আন্দোলন আপামর জনগণের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ কি না; এতে দ্রব্যমূল্য, দুর্নীতি, নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষের ক্ষোভ যুক্ত হয়েছে কি না; সরকার তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ না করে রাজনৈতিক হয়রানি করেছিল। গণঅভ্যুত্থানের সেøাগান আর ঘটনাগুলোর শিরোনাম কোনোভাবেই বৃথা হতে দেওয়া যাবে না। এর আকাক্সক্ষা ‘গণতন্ত্র-মানবাধিকার ও সুশাসন’; যা নাগরিকদের মধ্যে আরো শক্তিশালী হচ্ছে। কারো কাছ থেকে এই আকাক্সক্ষা বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ভবিষ্যতের দায়: দেশকে গভীর সংকট থেকে উত্তরণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এখন সংস্কারের পথে হাঁটছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়- শহীদদের রক্ত কি সত্যিই বৃথা যাবে না? গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাক্সক্ষা- গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে?
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবনা নিয়ে ‘ঐক্যমত্য কমিশন’ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যেভাবে নিরলস চেষ্টা করে চলেছেন, জনগণ তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। এ জন্য দেশের কল্যাণে সংস্কার বিষয়ে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ওই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়, এটি একটি ব্যবস্থার পরিবর্তনের সূচনা। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন এই রক্তাক্ত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারব। শহীদদের স্বপ্ন ছিল একটি সুন্দর বাংলাদেশ; যেখানে কোনো স্বৈরাচার, কোনো নিপীড়ন থাকবে না। গণঅভ্যুত্থানের এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। কারণ ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—স্বৈরাচারের ফিরে আসার চেষ্টা কখনোই থামে না। কিন্তু জনগণের জাগরণই পারে তাকে রুখে দিতে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ