নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বলছে, গেলো বছরের তুলনায় এই বছর জুলাইয়ের ১০ দিনে রোগী বেড়েছে সাড়ে ৬ গুণ এবং মৃত্যু বেড়েছে ৪ গুণ। আর গত বছরের তুলনায় মোট রোগী বেড়েছে ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং মৃত্যু বেড়েছে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। ডেঙ্গু এখন আর আগের মতো সহজভাবে মোকাবিলা করার পর্যায়ে নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ২০৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৪৭ জন মারা যান। এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৩ হাজার ৯৩১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
শুধুমাত্র জুলাইয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ১০ দিনে ৫৫৭ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং এই সময়ের মধ্যে মারা যান ৩ জন। অন্যদিকে, এ বছরের জুলাইয়ের প্রথম ১০ দিনে ৩ হাজার ৬৩৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মারা গেছেন ১২ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত বছর জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে’তে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনে ৭৯৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩, মার্চে ৫, এপ্রিলে ২, মে’তে ১২ এবং জুনে ৮ জন মারা গেছেন।
অন্যদিকে, এই বছর জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪, মার্চে ৩৩৬, এপ্রিলে ৭০১, মে’তে ১ হাজার ৭৭৩ এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩, এপ্রিলে ৭, মে’তে ৩ এবং জুনে ১৯ জন মারা গেছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, গেলো জুন মাস থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ উচ্চ হারে বাড়ছে। বরিশাল বিভাগে এ বছর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া এই বিভাগে মারা গেছেন ১৪ জন। গত বছরের তুলনায় এই বিভাগে রোগী বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ আর মৃত্যু বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। গেলো বছর এই ধরনের প্রকোপ দেখা গিয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে।
বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর প্রকোপ বরগুনায়। বরগুনা পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটি ওয়ার্ডই ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। জেলা সদরে লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় সাড়ে ৮ গুণ বেশি পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আইইডিসিআর বলছে, বরগুনায় ডেঙ্গুর ডেন-৩ ও ডেন-২ সোরোটাইপের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেছেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর আগের মতো সহজভাবে মোকাবিলা করার অবস্থায় নেই। ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন রোগীদের মধ্যে জটিল উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘বরগুনায় কিছুদিন আগে ডেঙ্গুর একটি আউটব্রেক দেখা দিলেও বর্তমানে তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে সারা দেশে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। জ্বর হলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সময় মতো চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো সম্ভব।’
মহাপরিচালক বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগী শকে চলে গেলে সেখান থেকে রিভার্স করা যায় না। এজন্য জরুরি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব রোগটি শনাক্ত করা।’
কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশারের মতে, ‘বর্তমানে বরিশাল বিভাগ, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল জেলা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেল অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুরে ডেঙ্গু ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব জ্যামিতিক হারে বেড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
হাসপাতালে আরো ১৩৮ রোগী, বেশিরভাগই বরিশালের: দেশে ২৪ ঘণ্টায় এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো ১৩৮ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারো মৃত্যু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শুক্রবারের (১১ জুলাই) বুলেটিনে বলা হয়েছে, চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ১৪ হাজার ৬৯ জনে। এ বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ১৯ জন মারা গেছেন জুন মাসে। আর জুলাই মাসের এগারো দিনে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এছাড়া জানুয়ারিতে ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, মে মাসে তিন জন মারা যান। মার্চ মাসে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। চলতি মাসে পর্যন্ত পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ হাজার ৭৭৩ জন। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন এবং জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৯৫১ জন রোগী। নতুন রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ জন বরিশাল বিভাগের। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৫ জন, ঢাকা বিভাগে ১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৮ জন, খুলনা বিভাগে তিন জন এবং রাজশাহী বিভাগের তিন জন। এই সময়ে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুরে বিভাগে নতুন করে কেউ আক্রান্ত হয়নি। ডেঙ্গু নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ১ হাজার ২৭১ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৩৬১ জন, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৯১০ জন। গেল ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ১৫৩ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। এ বছর এ নিয়ে ১২ হাজার ৭৪৪ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছাড়লেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। দেশে ২০২৪ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২১১ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর এই সংখ্যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। আর মৃতের সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। ২০২২ সালে সারাদেশে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, যা বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।