রকিবুল হাসান
একটা জাতি গঠনের মূল নায়ক শিক্ষক। শিক্ষকের হাতেই তৈরি হন বড় বড় সচিব -সেনা কমকর্তা-বিচারক-ব্যাংকার থেকে শুরু করে সব পেশার গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। যারা দেশ ও জাতির কাণ্ডারি হয়ে ওঠেন। সেই শিক্ষক এখন কয়জন আছেন মেরুদণ্ড সোজা করে নীতি-আদর্শে অবিচল! শিক্ষকরা কী আগের মতো বইয়ের পোকা হয়ে থাকেন, নীতিতে অটল থাকেন, মাথা উঁচু করে বাঁচেন! নাকি সুবিধালাভের আশায় দলীয়বৃত্তে বন্দিত্ব বরণ করেন, মেরুদণ্ডহীনতায় জীবনযাপন করেন! শিক্ষকতার যে নীতি-আদর্শ তা কয়জন ধারণ করেন। অন্ধকার চলে এসেছে শিক্ষকতা পেশায়। শিক্ষার্থীদের হীনস্বার্থে ববহার করে ফায়দা লুটা সহজতর পন্থায় পরিণত হয়েছে। এতে শিক্ষকদের মূল্য দিতে হচ্ছে ভালোমতো। পারিবারিক ও সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মান-সম্মান হারাতে হচ্ছে। আগে যে শিক্ষকরা ছাত্রদের নিঃস্বার্থভাবে পড়াতেন, গড়ে তুলতেন, এমনকি নিজের সন্তানেরও অধিক করে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়ে দিতেন, সেই দিন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শিক্ষকরাও এখন ক্ষমতাপ্রত্যাশী, আর তা অর্জনে অদ্ভুত রকম হীনস্বার্থে দলীয় লেজুরবৃত্তি আর শিক্ষার্থীদের জঘন্যভাবে ব্যবহার বর্তমানে স্পষ্টত। এটা হুট করেই হয়েছে তা নয়। যখন যারা ক্ষমতায় গেছে, তারাও শিক্ষকদের ব্যবহার করেছেন, আর শিক্ষকরাও আনন্দের সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছেন। এতে শিক্ষকদের আসল মেরুদণ্ডটাই হারিয়ে গেছে। নিজেদের পড়া ও শিক্ষার্থীদের পড়ানো এসব মস্তিষ্ক থেকে বিলীন হয়ে গেছে। যদিও এ কথা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিষ্ঠুর নির্লজ্জ বাস্তব।
শিক্ষার্থীরা পড়ালেখায় নেই বললেই চলে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাধ্যবাধকতায় হয়তো পড়ালেখাটা এখনো কিছুটা আছে, কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র তো এক নয়। বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী। সবার পকেটে একটা পাওয়ার কাজ করে এখন, টাকা আর ক্ষমতা-ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা। শিক্ষকদের এখন তারা আর আগের সেই গুরুজনের মতো ভক্তি করেন না। কারণ শিক্ষকরাই তাদের দ্বারা পরিচালিত হন। স্কুল-কলেজ তো দূরের কথা, পাবলিকের ভাইস চান্সেলরও যখন শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হন, তখন দেশ-জাতির মেরুদণ্ডটা কীসের ওপর নির্ভর করে! এসবই দুঃসহ বেদনা। নামিদামি ভিসিরা যখন অনিয়ম আর দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন, অর্থ লুটপাট করেন, নিয়োগ-বাণিজ্য করেন, তখন সব স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হয়। দেশ-জাতি কিসের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে! শিক্ষার্থীরাও, এমনকি সাধারণ মানুষও তাদের প্রতি সম্মান ও আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
আগে পড়ালেখার একটা কমপিটিশন ছিল। সেটা ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যেও ছিল। আমাদের শিক্ষরা বলতেন, আমি ক্লাসে আসার আগে নির্দিষ্ট বিষয়ের পনের-বিশটা বই পড়ে আসবো। তোমরা অন্তত পাঁচ-ছয়টা বই দেখে আসবে। ক্লাস শেষ হওয়ার আগে পনের মিনিট আমাকে প্রশ্ন করবে। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাসে যেতাম। স্যার যেসব বইয়ের নাম বলতেন, উদ্ধৃতি দিতেন, আমরা সেই সব বই সংগ্রহ করে পড়ার চেষ্টা করতাম। এখন খুবই অবাক হই, অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের হাজার বলেও বই কেনানো যায় না, পড়ানো যায় না। এমনকি কম্পিউটার বা মোবাইলে ডাউনলোড করেও পড়ে না। পড়া ব্যাপারটাই যেন থাকছে না। পুরো অনীহা এ বিষয়ে। কিন্তু তারা বড় হতে চায়, প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। বিষয়টা কেমন যেন গড়মিলে, অ্যাবড়োখেবড়ো। জোরে কিছু বলাও যায় না। যদি তাদের ইগোতে লাগে, চাকরি করার সাধ মিটিয়ে দেবে। একথা মনে হয় এই সময়কালে বলাই যায়, একশ্রেণির শিক্ষকরা ছাত্র পোষেন- নিজের আধিপত্য বজায় ও বিস্তার ঘটাতে। ফলে সেসব ছাত্রদের পড়ালেখার দরকার কী! তাদের পকেটে অনায়াসে টাকা ঢুকে যায়। রেজাল্ট ভালো হয়ে যায়। চেহারা চকচকে হয়ে যায়। ক্ষমতাবান হয়ে যান। আদর্শবান অসহায় শিক্ষকদের এসব দেখে নীরবে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। সেই ক্ষতবিক্ষত দিন দিন আরও বাড়ছে, বাড়ছেই।
শিক্ষকদের ভেতর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এখন তলানিতে। ক্ষমতালিপ্সু-স্বার্থান্বেষী শিক্ষকরা দলের অনুগত দাস হয়ে, নিজেকে পাওয়ারফুল ভেবে নিজেদের মধ্যে শ্রদ্ধা-সম্মানের ব্যাপারটিকে মূল্যহীন মনে করেন। দলাদলি ভাগ-বাটোয়ারা লাভেই মশগুল থাকেন। শিক্ষক যে হওয়া যায় না, হয়ে উঠতে হয়-ব্রত ও সাধনায়, সেই জিনিসটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। ক্ষমতা-অর্থ এসবের দখলে ব্যস্ত একটা বৃহৎ শিক্ষকগোষ্ঠী। নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ-গবেষণা- এসব কথার কথায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে। দেশের বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও টাকার লোভে সারাদিন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে বেড়ান ক্লাসের জন্য। নিজের পড়ালেখা কোথায়, নিজের গবেষণা কোথায়, নিজের ডিপোর্টমেন্টের জন্য সময় কোথায়! শুধুই ছুটছেন টাকার পেছনে। অদ্ভুত! আবার যে শিক্ষকরা নিজে সাধনা করছেন, নীতি নিয়ে চলছেন, শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন, তাদের কপালে অনেক দুঃখ এসে জমে বহুবিধ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে। অপমান-অপদস্ত হতে হয়।
অধিকাংশ শিক্ষার্থী বই তো কিনতেই চান না, লাইব্রেরিতেও যান না। এর ব্যতিক্রমও হয়তো আছে, সেটি খুব কম। একটা সময় এমন ছিল, হাই স্কুলে পড়ার সময়েই শিক্ষার্থীদের মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশের অনেক বই পড়া হয়ে যেত। ইতিহাস- ঐতিহ্য সম্পর্কে পড়তেন। হয়তো সেসব বই পাঠ্য নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে পারিবারিক ছোটখাটো একটা পাঠাগার থাকতো। তখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যে ভালো ছিল, তাও নয়; যেটি ছিল, তা হলো মূল্যবোধ গড়ে ওঠার স্বপ্ন ও সাধনা। এর সঙ্গে ছিল পারিবারিক-সামাজিক সুবন্ধন- সবাই মিলে বড় হয়ে ওঠা। গ্রামের মতো জায়গায়ও পাঠাগার থাকতো। বিকেলে সেখানে সারিবদ্ধভাবে বই পড়া হতো। নাটক হতো, গান হতো- কী চমৎকার পরিবেশ ছিল। সপ্তায় সপ্তায় পাঠচক্র হতো, আলোচনা হতো। সেখানে শিক্ষকরাও যোগ দিতেন। বাড়ি বাড়ি শিক্ষকরা গিয়ে খোঁজ-খবর নিতেন পড়ালেখা ঠিকমতো করছে কি না! তখন শিক্ষকের কত সম্মান ছিল। হয়তো আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না; কিন্তু সম্মান ছিল, মান-মর্যাদা ছিল। নিজের সন্তানের থেকে শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব বেশি ছিল, স্বপ্ন ছিল। সেই সময় তো কোনো ছাত্র শিক্ষকের গলা টিপে ধরেননি, সেই সময়তো কোনো ছাত্র শিক্ষকের কাছে চাঁদাবাজি করেননি। বরং শিক্ষকের পায়ের ধুলো ছিল তাদের মাথায়। ওই সময় কোনো ছাত্র ভালো রেজাল্ট করলে, ভালো কোনো চাকরি পেলে, ভালো কিছু হলে শিক্ষকের কাছে ছুটে এসে তার পায়ের ধুলো মাথায় মাখতেন। তখন তো শিক্ষকে শিক্ষকে দলাদলি হয়নি, হাতাহাতি হয়নি, শিক্ষার্থীরা তো এসব নোংরামির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। শিক্ষকও তো তাদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেননি। সময়ের সঙ্গে সবকিছু কেন উল্টে-পাল্টে গেলো! এখন কেন ছাত্ররা শিক্ষকের গলা টিপে ধরে! এখন কেন ছাত্ররা বলে, এখনই পদত্যাগ করতে আপনাকে! এখন কেন বলে আপনাকে ভিসি বানিয়েছি আমরা! এখন কেন দুইজন শিক্ষক একসঙ্গে অধ্যক্ষ দাবিতে চেয়ার কাড়াকাড়ি করেন! এই অবক্ষয় কেন ঘটলো, এখান থেকে মুক্তির পথ কী! আমাদের পড়ালেখা কোনদিকে যাচ্ছে-আমাদের নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধ কেন অস্তমিত হচ্ছে- এসব তো এখন ভয়াবহ কঠিন প্রশ্ন।
সুস্থধারায় যদি আমরা ফিরতে না পারি, আমরা যদি পড়ালেখায় না ফিরতে পারি; তাহলে আমাদের শিক্ষা ও মূল্যবোধ ভয়াবহ অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। শিক্ষক যে জাতি গঠনের নায়ক; তিনি নিজেই যদি মেরুদণ্ড বেচে দেন, অনুগত দাসে পরিণত হন, পেশিশক্তির প্রয়োগ করেন হীনস্বার্থে, কোমলমতি শিশুদের অন্ধকারে অন্ধমোহের দিকে ঠেলে দেন; তাহলে আলোটা জ্বালাবেন কে?
লেখক: ডিন, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ