প্রত্যাশা ডেস্ক: ‘আমরা বন্ধুরা আগে নিয়মিত মাঠে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলতাম। এখন চাচ্চুরা (বড়রা) বলে, মাঠে খেলা যাবে না-ছাদে গিয়ে খেলো। কিন্তু ছাদে খেলাও নিষেধ! বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আমাদের ছাদে উঠতেই দেন না। কিছুদিন খেলেছিলাম, এখন আর ছাদেও যেতে পারি না।’
অভিমান ঝরে পড়ে আট বছর বয়সী মো. রোহানের কণ্ঠে। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকার এই শিশুটি একটি সংবাদসংস্থা আক্ষেপ করে আরো বলে, ‘ঈদের আগ থেকেই আমাদের মাঠে খেলা বন্ধ। আব্বুকে বলেছিলাম। তিনি বললেন, গ্রাম থেকে ফিরলে খেলতে পারবো। কিন্তু এখনও খেলতে পারছি না।’
রোহানের বাবা মো. আব্দুল লতিফ বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের সময় থেকে মাঠ দখল করে ব্যবসা শুরু করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এর আগে কখনও এমনটা হয়নি। আমার ছেলে ও ফ্ল্যাটের অন্যান্য শিশুরা খেলাধুলার জন্য উদগ্রীব। প্রতিদিন ছেলে জিজ্ঞেস করে, বাবা, আমি আবার কবে খেলতে পারবো? কিন্তু আমার কাছে কোনো উত্তর নেই। প্রায় এক সপ্তাহ আগে অভিযোগ জানাতে সিটি করপোরেশনে গিয়েছিলাম, কিন্তু তখন নগর ভবন বন্ধ ছিল।’
প্রভাবশালীদের দখলে মাঠ, বঞ্চিত শিশুরা: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদ ও বৈশাখী মেলার নামে পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের মাঠ ও আশপাশের জায়গা দখল করে বিনা অনুমতিতে ব্যবসা করছেন স্থানীয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নাম ভাঙিয়ে তারা এসব কর্মকাণ্ড চালালেও, সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়নি বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউন সরেজমিনে দেখে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ডিএসসিসির ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীবাজারের খেলার মাঠে নাগরদোলা, নৌকা ও অন্যান্য রাইড বসানো হয়েছে। প্রতিটি রাইডে প্রবেশের জন্য নেওয়া হচ্ছে ৪০ টাকা করে। গত ২৭ মে থেকে এসব কার্যক্রম চলছে। একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, অর্ধলাখ টাকার বিনিময়ে ‘ঢাকা বিনোদন এক্সপ্রেস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে মাঠটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের কয়েকজন নেতার সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে। ‘ঢাকা বিনোদন এক্সপ্রেস’-এর এক কর্মচারী নয়ন বলেন, ‘এটা যাত্রাবাড়ীর মিন্টু ভাই ইজারা নিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের জসিম ভাই দেখাশোনা করছেন। থানা পুলিশও জানে, তারা অনুমতি দিয়েছে।’
ক্ষোভে ফুঁসছে স্থানীয়রা: লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিন বিকালে আমার ছেলে ও আশপাশের বাচ্চারা মাঠে খেলতে যেতো। গত মাসের ২০ তারিখে ছেলে খেলতে গিয়ে ফিরে আসে। পরে জানায়, কিছু আঙ্কেল খেলতে নিষেধ করেছে। গিয়ে দেখি মাঠে রাইড বসানো হয়েছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, তারা সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নিয়েছে।’
স্থানীয় গৃহবধূ জেসমিন আক্তার বলেন, ‘ছেলেরা এখন সারা দিন বাসায় বসে মোবাইল টিপে। এই মাঠে খেলতে পেরে ওরা খুব আনন্দিত ছিল। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে খেলতে পারছে না। বিনোদনের নামে ব্যবসা চলছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকায় খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই বললেই চলে। যে কটা আছে, তাও দখল হয়ে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ, দ্রুত মাঠটি দখলমুক্ত করা হোক।’
যা বলছেন ছাত্রদলের নেতারা: এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি বা আমার সংগঠনের কেউ এতে জড়িত নই। হতে পারে, কলেজের সাবেক কেউ বা অন্য কোনো দলের কেউ জড়িত।’ মাঠের পাশের ডিআইটি মার্কেটের সামনের খালি জায়গাও দখল করে দোকান বসিয়েছে স্থানীয় ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজ ছাত্রদলের একজন যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, ‘ঈদের জন্য এসব দোকান ও রাইড বসানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসা ভালো হওয়ায় এখনও তুলে নেয়নি। স্থানীয় বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতারাই এর পেছনে আছেন।’
ডিএসসিসি বলছে, ইজারা দেওয়া হয়নি: ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) হাছিবা খান বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে কোনো খেলার মাঠ ইজারা দেওয়া হয়নি। যারা বসিয়েছে, তারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে করেছে। গত ঈদেও এমন ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করেছি।’ কবে মাঠ দখলমুক্ত করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন অভিযোগ পেলে আমরা খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’