নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ না থাকলেও জনগণের অংশগ্রহণ সঠিকভাবে হলে আগামী নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে বলে মনে করছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে অন্তর্ভুক্তি মানে হচ্ছে, প্রত্যেক বাংলাদেশি যেন মতামত দেওয়ার সুযোগ পায়।
বুধবার (৪ জুন) ঢাকায় ডিপ্লোম্যাটিক করেসপেন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত ডিক্যাব টক অনুষ্ঠানে গোয়েন লুইসকে প্রশ্ন করা হয়-আওয়ামী লীগ না থাকা অবস্থায় নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কি না।
উত্তরে তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন মানে হচ্ছে, সমাজের প্রত্যেক অংশই যেন ভোট দিতে পারে-নারী, ১৮ বছর বয়সী, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়-অন্তর্ভূক্তিমূলক দিয়ে আমরা এটাই বোঝাই। তবে প্রত্যেকের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রবেশাধিকার ও সক্ষমতা যেন থাকে। তখন এক সাংবাদিক জানতে চান, তার মানে এটা কোনো রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়? উত্তর জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক বলেন, “না।”
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কোনো মন্তব্য করছি না। আমি বোঝাতে চাইছি, জাতিসংঘ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নয়। এই প্রশ্ন করতে হবে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে।
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে দলটির নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছর ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে চলে যান।
আন্দোলনে দমন-পীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনাসহ তার দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। এমনকি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনও করা হয়েছে। বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির সব ধরনের কার্যক্রমে জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সরকারের ওই পদক্ষেপের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন। এর ফলে, ছয় মেয়াদে দুই যুগের বেশি সময় সরকারে থাকা দেশের অন্যতম প্রাচীন এ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের সংঘাত নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশের সূত্র ধরে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের বিষয়ে আরেক প্রশ্নে গোয়েন লুইস বলেন, এই প্রশ্ন আমাকে নয়, এই প্রশ্ন সরকারের জন্য। আমরা সুপারিশ করেছি কারণ, সব দলের অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মেরুকরণ এবং সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো যায়। তবে, আমি মনে করি, পারিপার্শ্বিক অবস্থার দিকে তাকাতে এবং দেশের প্রেক্ষাপটে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকাতে হবে। এ বিষয়ে আমার এর বেশি কিছু বলার নেই। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের সিদ্ধান্ত।
কারিগরি সহায়তা: নির্বাচন কমিশনকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘ। তিনি বলেন, ‘আমি এই শব্দটি নির্দিষ্ট করে ব্যবহার করছি। কারণ, আমরা সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতে এই সহায়তা দিচ্ছি। অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে জাতিসংঘ সমর্থন করে, কিন্তু কবে নির্বাচন হবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো ভূমিকা নেই এবং আমাদের কোনো রাজনৈতিক মতামত নেই কোনটি আগে হবে। এটি বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে।’ আমরা নির্বাচনের জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়াতে খুশি এবং নির্বাচনে অন্য সহায়তা দিতে পারলে খুশি হবো। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে আমাদের কোনো অবস্থান নেই বলে তিনি জানান।
সংলাপ: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংলাপ করছে সরকার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আরো আলোচনা হওয়া দরকার। আমি বলতে চাই কনসেনসাস কমিশন যেভাবে কাজ করছে, সেটিতে আমি অভিভূত। রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে হয়েছে এবং বড় আকারে আলোচনা করছে এবং তারা কিছু জটিল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছে। আমরা আরো দেখছি অনেক বিষয়ে তারা একমতও হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি অনেক বড় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটির নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমি মনে করি, বিশ্বাসযোগ্য এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়কে জাতিসংঘ সমর্থন করে।’
জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস: বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস খোলার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে এবং খুব শিগগিরই এটি সই হবে। বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার অফিস এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমঝোতা চূড়ান্ত হয়েছে। আমরা এটি স্বাক্ষরের জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করি, এটি দ্রুত সই হবে। এর মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে একটি ছোট আনুষ্ঠানিক অফিস খুলতে পারবো।’
ট্রুথ ও হিলিং প্রসেস: ট্রুথ এবং রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে এখন। বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামত দিচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনও সমাজে জুলাই সংঘাতের মতো পরবর্তী পরিস্থিতিতে ট্রুথ এবং হিলিং প্রক্রিয়া সেটির ভিত্তিতে হয়, যেটি মানুষ চায়। কী প্রক্রিয়া প্রয়োজন – এ বিষয়ে যেকোনও ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দরকার একটি জাতীয় সংলাপ। বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনা হয় না বা অন্য কোনো দেশ যেখানে অনেক দিন ধরে সংঘাত চলছে। কারণ, সবদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন।’
ভারতের পুশইন: ভারতের পুশইন নিয়ে তিনি বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান এ বিষয়ে খুব পরিষ্কার। উপদেষ্টা হোসেন এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমার ধারণা, তার অবস্থান খুব পরিষ্কার। আমি জানি না। জাতিসংঘের দিক থেকে এটি উদ্বেগজনক এই কারণে যে ভঙ্গুর জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাকে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে এবং আমরা অবশ্যই তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। তবে, এ বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে অ্যাড্রেস করতে হবে।’
ডিক্যাব সভাপতি একেএম মঈনুদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মামুনও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।