খান মুহঃ আশরাফুল আলম
ঈদুল আজহার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। ঈদ মানেই খুশি, আর সেই খুশির আনন্দ অনেক গুণ বেড়ে যায় প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটালে। তাই ঈদের ছুটিতে নাড়ির টানে শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ছুটছেন অনেকেই। অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সবখানেই ছুটি চলছে। তবে ঈদযাত্রার প্রস্তুতিতে অনেকেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যান; যা পরবর্তীকালে ভোগান্তির কারণ হতে পারে। এবারের ঈদযাত্রা হোক নিখুঁত ও নিশ্চিন্ত- এ জন্য কিছু বিষয়ে আগে থেকেই খেয়াল রাখা জরুরি। ঈদে গ্রামে যাওয়ার আগে কয়েকটি কাজ সারতে হবে।
রেফ্রিজারেটর রক্ষণাবেক্ষণ: সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিদ্যুৎ সংযোগমুক্ত করার সময় ফ্রিজের ব্যাপারে ব্যতিক্রম করা যেতে পারে। কেননা যেসব খাবার সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয়ে সেগুলোকে সতেজ রাখার জন্য ফ্রিজে বিদ্যুৎ সংযোগ রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে যদি ভ্রমণের আগেই পচনশীল খাবারগুলো শেষ হয়ে গেলে ভালো। সেক্ষেত্রে ফ্রিজ ছেড়ে রাখতে হবে না। এছাড়া ভ্রমণের আগের দিনগুলোতে কোনো পচনশীল খাবার না কেনাই উত্তম। বাড়ির ছাড়ার আগের সপ্তাহের খাদ্যতালিকায় ফ্রিজের অবশিষ্ট খাবারযোগ্য আইটেমগুলো রাখা যেতে পারে। অপচনশীল খাবার বা কেনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত খেয়ে ফেলতে হয় এমন খাবারগুলো কেনা যেতে পারে অল্প করে। বের হওয়ার আগের দিন ফ্রিজের ভেতরটা ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ফ্রিজে এমন কিছু রাখা যাবে না যা পরবর্তীতে দুর্গন্ধের কারণ হতে পারে।
বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ করা: তাড়াহুড়ায় বিদ্যুতের সুইচ বন্ধ করতে ভুলে যান অনেকে। বিশেষ করে বের হওয়ার সময় বাড়িতে যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তাহলে লাইট-ফ্যানের সুইচ অন ছিল কি না, অনেক সময় বোঝা যায় না। লম্বা ছুটিতে যাওয়ার আগে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে বাসার প্রতিটি লাইট, ফ্যানের সুইচ বন্ধ করা হয়েছে; এমনকি বাসার গুরুত্বপূর্ণ লাইন- কম্পিউটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদির প্লাগ খুলে রাখার চেষ্টা করবেন।
সঠিকভাবে তালা লাগানো: ঈদের সময় বেড়ে যায় চুরি ডাকাতি। তাই বাড়ি যাওয়ার সময় বাসার নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। দরজায় ভালো মানের তালা লাগান। ভেতরে প্রতিটি ঘরে আলাদা আলাদা করে তালা দিন। এতে ঘর সুরক্ষিত থাকবে।
গ্যাস-পানির লাইন বন্ধ করা: ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে গ্যাস সিলিন্ডার অথবা গ্যাসের লাইন বন্ধ করতে হবে। এমনকি বাড়ি থেকে ফিরে এসে চুলা জ্বালানোর আগে বাসার দরজা-জানালা খুলে দিন। এতে বাসার ভেতরে গ্যাস জমে থাকলেও বের হয়ে যাবে; এমনকি পানির কল ভালোভাবে বন্ধ হয়েছে কি না, এ ব্যাপারেও নজর রাখবেন।
পোষা প্রাণীর যত্ন: বাসায় পোষা প্রাণী থাকলে তাকে একা বাসায় রেখে যাওয়ার ভুল করবেন না। সম্ভব হলে সঙ্গে করে নিয়ে চলুন অথবা পরিচিত কারও বাসায় রেখে যান। ঢাকাতেই পোষা প্রাণীদের কিছু কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে, যেখানে নামমাত্র মূল্যে চাইলেই নিজের পোষা প্রাণীকে রেখে যেতে পারবেন আপনি।
সরঞ্জামসহ রান্নাঘর পরিষ্কার করা: খাবারের পরপরই থালা-বাসন ধুয়ে রাখা হলে এই কাজটি অনেকটা এগিয়ে যায়। রান্নাঘরে প্রায় ক্ষেত্রে ফল ও সবজি স্তূপ করে রাখা হয়। এভাবে এলোমেলাভাবে না রেখে প্রত্যেকটিকে তার যথাস্থানে রাখতে হবে। এতে করে রান্নাঘরের ময়লা পরিষ্কার করতে সুবিধা হবে। সিঙ্কের জায়গা, কেবিনেট, শেল্ফ ও তৈজসপত্র ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা উত্তম। এতে করে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশের সম্মুখীন হতে হবে না। একই সঙ্গে বাড়ি ফিরেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধোয়া-মোছার কাজে লেগে পড়তে হবে না।
দরজা-জানালা বন্ধ করা: বাড়ি যাওয়ার আগে দরজা-জানালা ঠিকঠাক বন্ধ করেছেন কি না, খেয়াল করুন। প্রয়োজনে বারবার দেখে নিন, বাসায় তালা ঠিকভাবে লাগানো হয়েছে কি না। ঈদের সময়টায় চুরি-ডাকাতি বেড়ে যায়। তাই বাসার সম্পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এরপর যাত্রাপথে বের হবেন।
পরিধেয় কাপড় পরিষ্কার করা: ভ্রমণের জন্য ব্যাগ গোছানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যে বাড়ি ফিরে পরিধানের জন্য পরিষ্কার কাপড় আছে কি না। এছাড়া পরনের কাপড় সব স্তূপ করে রেখে দিলে তা বাজে গন্ধ ছড়ায়। সেই সঙ্গে বদ্ধ ফাঁকা ঘরে এই গন্ধ অস্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাছাড়া ভ্রমণের পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে কাপড় ধোয়ার আর অবস্থা থাকে না। তাই এই সব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাড়ি ছাড়ার আগেই কাপড়গুলো পরিষ্কার করা। নিদেনপক্ষে নিয়মিত পরিধানের কাপড়গুলো ধুয়ে শুকিয়ে আয়রন করে রাখতে হবে।
ঘর গুছিয়ে রাখা: দীর্ঘ যাত্রার আগে ঘর ভালোমতো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখে যান। ঈদের ছুটি শেষে যখন আবারও ব্যস্ত জীবনে ফিরবেন, তখন অগোছালো ঘরবাড়ি দেখে মুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে ছুটিতে যাওয়ার আগেই ঘরদোর গুছিয়ে যান। এতে ছুটি শেষ করে ফিরে অস্বস্তিকর গন্ধ বা পোকামাকড়ের পাল্লায় পড়তে হবে না।
লকারগুলো লক করা: আলমারি, টেবিল, দেরাজ বা কেবিনেটের লকারগুলো ভালো করে চেক করতে হবে। কোনো ত্রুটি থাকলে তা ঠিক করে নিশ্চিত করতে হবে- যেন সেগুলো মজবুতভাবে বন্ধ থাকে। কেননা এগুলোয় নগদ টাকা, ডেভিট বা ক্রেডিট কার্ড, অলঙ্কার, সার্টিফিকেট সহ মূল্যবান সব জিনিসপত্র রাখা হয়। এগুলোর কোনোটাকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে টেবিল বা বিছানার ওপর ফেলে রাখা একদমি ঠিক নয়।
দরকারি কাগজপত্র ফটোকপি: ঈদে বাড়ির পথে পা বাড়ানোর আগে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র- আইডি কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি ফটোকপি করে এক কপি নিজের কাছে রাখুন এবং মূল কপি সযত্নে রেখে যান। যাত্রাপথে ভিড়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হারিয়ে গেলে পুনরুদ্ধার করতে বিশাল ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে।
আসবাবপত্রসহ ঘর পরিষ্কার করা: বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, ও টেবিল ক্লথ অনেক দিন হয়ে গেলে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং ঘরের পরিবেশ নষ্ট করে। আনন্দের ঈদ উদযাপন করে বাসায় ফিরে এমন অস্বস্তিকর পরিবেশের সম্মুখীন হওয়া কারোই কাম্য নয়। এছাড়া ক্লান্ত শরীরে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে চান। তাই নিজেই নিজেকে স্বাগত জানানোর জন্য আগে থেকেই এই চাদর-পর্দাসহ প্রতিটি আসবাব পরিষ্কারের দিকটি মাথায় রাখা উচিত। প্রতিটি কক্ষ পরিষ্কারের সময় বাথরুম পরিষ্কারে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাথরুমে পানির কল চেক করে দেখার সময়েই এক সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার দিকটাতেও নজর দেওয়া যেতে পারে।
ময়লা ফেলার বাক্স নির্দিষ্ট স্থানে রাখা: রান্নাঘরসহ প্রতিটি ঘরের ট্র্যাশ বক্সের সব ময়লা একটি পলিথিনে নিয়ে বাড়ির বাইরে যথাস্থানে ফেলে আসতে হবে। সারা ঘর পরিষ্কার থাকলেও শুধু ময়লায় ভর্তি ট্র্যাশবক্স ঘিরেও কীটপতঙ্গ ও ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। আর এভাবে বেশ কিছু দিন বদ্ধ অবস্থায় থাকলে সারা বাড়ি জুড়ে অস্বস্তিকর পরিবেশে সৃষ্টি হয়। তাই আগেই ট্র্যাশ বক্সগুলো খালি করে ফেলতে হবে।
ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে এই বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া মানেই শহরের বাড়িটির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আপনার এই কয়েকটি পদক্ষেপ দীর্ঘসময়ের ছুটিকে করবে নিশ্চিন্ত ও আনন্দময়। সব মিলিয়ে ভ্রমণের ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর প্রশান্তিদায়ক পরিবেশ পেতে এই করণীয়গুলো অপরিহার্য।
লেখক: সাংবাদিক
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ