নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন শুরু করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গতকাল সোমবার (২ জুন) বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন তিনি। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা-যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম।
প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং এডিপি ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সংকোচনমূলক বাজেট।
এর আগে সোমবার (২ জুন) সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে অনুষ্ঠিত হয় উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠক। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন শেষে তাতে সই করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর বাজেট ডকুমেন্টস নিয়ে রামপুরার বিটিভি ভবনে যান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। সেখানে রেকর্ড করা হয় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট উপস্থাপনা। যা বিকাল ৩টায় সম্প্রচার শুরু করে বাংলাদেশ টেলিভিশন।
সংযত বাজেটে ৫.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা: মূল্যস্ফীতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত আর রাজস্ব ঘাটতির বাস্তবতায় সামষ্টিক অর্থনীতি যখন চাপের মুখে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ তখন বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছেন।
সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য উত্থাপিত ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি, যা বহু বছরের মধ্যে কম। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, মূল্যস্ফীতির সাথে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। ইতোমধ্যে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে ৩.৯৭ শতাংশ হয়েছে, যা চূড়ান্ত হিসাবে কিছুটা বাড়তে পারে। তবে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি বৃদ্ধি পাবে এবং মধ্যমেয়াদে ৬.৫ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আমরা আশা করছি।
তার এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় বাজেটের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে। সেখানে বলা হয়েছে, দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদে মাঝারি মানের প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদে একটি টেকসই ও সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। সরকার আশা করছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাক্কলিত (সংশোধিত) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা ৬ শতাংশ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। গতবছর বাজেটের সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। দুমাস ধরে চলা সেই আন্দোলন আর সহিংসতায় দেশের অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায়।
মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ডিসেম্বরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৫ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। কিন্তু সেই লক্ষ্যেও পৌঁছানো যায়নি। সংশোধনে তা ৫ শতাংশ হবে বলে ধরা হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ধরা হত। তবে অনেক অর্থনীতিবিদের মত বর্তমান সরকারেরও অভিযোগ, সে সময় তথ্য-উপাত্ত-পরিসংখ্যান নিয়ে কারসাজি হত। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য দেখানো হত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে। তবে ২০০৫-২০০৯ সময়ে বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা সালেহউদ্দিন আহমেদ সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেছেন।
অর্থনীতিবিদদের অনেকে প্রবৃদ্ধির হারকে অর্থনীতির গতিশীলতা হিসেবে মানলেও টেকসই উন্নয়নের সূচক হিসেবে মানতে নারাজ। তারপরও অর্থনীতির এই প্রপঞ্চটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বারবার আলোচনায় এসেছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। এরপর আসে মহামারী। তার মধ্যেও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিল তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু অর্জিত হয় ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ, যা তিন দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশ ইকোনোমিক রিভিউয়ের তথ্য অনুসারে, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল এর চেয়ে কম, তিন দশমিক ২৪ শতাংশ।
মহামারির ধাক্কা সামলে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে। দুঃসময় কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এরপর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে অর্থনীতির আকার ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য ধরেছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। পরে তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশে নামানো হলেও তা অর্জন হয়নি। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ওই অর্থবছর শেষে স্থির মূল্যে জিডিপি বেড়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা যখন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করল তখনই শুরু হল ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে ফের টালমাটাল করে দেয়, আবার অনিশ্চয়তার কবলে পড়ে অর্থনীতি। বিশ্বের সব দেশকেই কমবেশি এর জের টানতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়, চড়ে যায় ডলারের বিনিময় হার। তাতে পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়ে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। তারপরও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু অর্জনের খাতায় যোগ হয়েছে ৫ শতাংশ।
এবার প্রবৃদ্ধি কমবে, এমন পূর্বাভাস আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আগেই দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংক বলেছিল এ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৩ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল। নতুন বাজেটে চলতি মূল্যে জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ৬২ লাখ ৪৪ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এর আকার ছিল ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি: ব্যাংক ঋণ ২৪ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব: নতুন অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চায় সরকার, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এবার ব্যাংক ঋণ প্রায় ২৪ শতাংশ কমতে যাচ্ছে। অবশ্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক ঋণ সংশোধনের পর কমে হয় ৯৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ কমানোর সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ বলেন, ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেওয়া কমাবে, এটা একদিক থেকে বেসরকারি খাতের জন্য ভালো। কারণ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ বেশি পাবেন। ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারের বন্ড মার্কেট থেকেও ঋণ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। আমরা ভেবেছিলাম, সরকার বন্ড মার্কেট থেকে ঋণ নেবে। তাহলে এই মার্কেট আরো বেশি চাঙ্গা হত। ঋণের জন্য ব্যাংক খাতের ওপর ভরসা কমাতে হবে।