নিজস্ব প্রতিবেদক: ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর সেনাপ্রধানের বক্তব্যের জন্য দেশের মানুষ মুখিয়ে ছিলেন উল্লেখ করে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রশ্ন করেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে সেনাপ্রধান এখন বক্তব্য দিলে তাতে সমস্যা কোথায়?
সেনাপ্রধানের প্রস্তাবকে ইতিবাচক অভিহিত করে আমীর খসরু বলেছেন, ‘তিনি (সেনাপ্রধান) বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন।’
সোমবার (২৬ মে) রাজধানীর ডিআরইউ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
কারও একক সুবিধার জন্য ঐক্য গঠন সম্ভব নয় উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু বলেন, ‘সংস্কারের জন্য গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করাটা গ্রহণযোগ্য নয়। সংস্কারের কথা বিএনপি সাত বছর আগেই বলেছে। আমাদের ২৭ দফা ও যুগপৎ আন্দোলনে যারা ছিলেন, তাদের সমন্বয় সেটা পরে ৩১ দফায় পরিণত হয়। কাজেই সংস্কারের কথা আমাদের। যারা বাস্তবায়নের কথা বলছেন, এটা তাঁদের কথা নয়।’
বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে যাঁরা ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন, সেসব ছাত্রনেতার মধ্যে কতজন এখন ঐক্যবদ্ধ আছেন? কবে তাঁরা জনপ্রিয় হবেন, তারপর নির্বাচনে যাবেন, এসব খেলা মানুষ বোঝে।’
অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে বাক্স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটা গোল্ডেন রুল। সরকার যখনই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবে, তখনই দেশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করবে। আমরা চাই, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব ছাড়ার পরেও তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সরকার কাজ করতে পারবে, এমন পরিবেশ অব্যাহত থাকবে।’
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে বহু মানুষের ত্যাগকে স্মরণ করা হয় না বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখন মনে হচ্ছে হাসিনা শুধু কিছু মানুষের মৌখিক কথায় পালিয়ে গেছে। “আনসাং হিরোদের” কৃতিত্ব না দিয়ে শুধু গুটিকয় মানুষ কৃতিত্ব নিলে এটা বিশ্বাসযোগ্য হবে?’
কারও একক কৃতিত্বের জন্য জাতিকে বিভক্ত করা হলে সেটা কারও জন্য সুখকর হবে না বলে সতর্ক করেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু। তিনি বলেন, ‘ইতিহাসকে স্বীকার করতে হবে। যাঁরা মারা গেছেন, জেলবন্দী থেকে নির্যাতন সহ্য করেছেন, তাঁদের ভুলে গেলে হবে না।’
শেখ হাসিনার আমলে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের কোনো বক্তব্য দেওয়ার জন্যও খুঁজে পাওয়া যেত না বলে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘হাসিনা না পালালে এখন রাজনীতিবিদদের কী অবস্থা হতো? কারও ফাঁসি, কেউ আয়নাঘরে বা কেউ আজীবন জেলে থাকতেন। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের লোকেরা কোথায় থাকতেন? তাঁ নিজ নিজ কাজেই ব্যস্ত থাকতেন।’
অনলাইন নিউজ পোর্টাল শীর্ষ নিউজ ডটকমের নতুন যাত্রা উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নিউজ পোর্টালটির সম্পাদক একরামুল হক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
সেখানে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্ধশতাব্দী সময় পার করলেও রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্তরে উন্নয়ন অর্জিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। মৌলিক সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধও থাকতে হবে। কোনো অবস্থাতেই পুরোনো ফ্যাসিবাদকে ফিরে আসতে দেওয়া যাবে না।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই গণমাধ্যম স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছিল বলে মন্তব্য করেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আমলে ছাপা পত্রিকা থেকে অনলাইন এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মানুষের কণ্ঠরোধ করা হয়। তবে ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেলেও তাদের দোসররা এখনো রয়ে গেছে।’
সব সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় উল্লেখ করে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের শাসকেরা যে যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন গণমাধ্যম নিয়ে সংবেদনশীল থাকেন। আর যখন বিরোধী শিবিরে থাকেন, তখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা বলেন। আবার হাসিনাকে ফ্যাসিবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গণমাধ্যমের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে।’
সরকার অনেক ধরনের সংস্কারের কথা বললেও এখনো দৃশ্যমান কিছুই দেখা যায়নি উল্লেখ করে সাইফুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন কমিশন দুর্নীতির শ্বেতপত্র দিয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেই। যারা ছয় মাসে কিছু করতে পারেনি, তারা ছয় বছরে কিছু করতে পারবে, এটা আমরা বিশ্বাস করতে পারি না।’
সরকারকে নিরপেক্ষতা প্রমাণের আহ্বান জানিয়ে সাইফুল হক বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থা রাখতে চাই। তবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এই অন্তর্বর্তী সরকারকে দেওয়া হয়নি। যাকে নিরাপত্তা উপদেষ্টা করা হয়েছে, তিনি তিন বাহিনীর ওপর খবরদারি করতে চাইছেন। সরকারের উচিত হবে, বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অপসারণ করা। শুধু মৌখিক আশ্বাসে দেশ চলবে না। আমরা নির্দিষ্ট কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমা দেখতে চাই।’
গণ-অভ্যুত্থানের চিত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিপীড়নের চিত্র কখনো উঠে আসে না বলে মন্তব্য করেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের সময়ে রাজনীতিবিদেরা অনিশ্চিত জীবনে ছিলেন। কখন কোন বক্তব্যের কারণে ডিজিএফআই এসে রাতে গুম করে। সেই আতঙ্কে দিন কাটাতে হতো। কিন্তু এখন কথা বলতে ভাবতে হয়, কোন কথা বললে প্রধান উপদেষ্টা বা বিএনপি কিংবা অন্য কেউ রাগ করেন।’
প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পারবেন, সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘তিনি ফ্রান্সের তিনজন চিত্রকর এলে সম্ভবত এক ঘণ্টা সময় দেন। চা খাবেন, ছবি তুলবেন। কিন্তু দেশের দুইজন রাজনীতিবিদ গেলে তাঁদের সঙ্গে ১০ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না। আমি অধ্যাপক ইউনূসের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার কথা বলছি। এই বক্তব্যকে সমালোচনা হিসেবে নিলে সমালোচনা হবে। কিন্তু এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই আমাদের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করতে হবে।’
ফ্যাসিবাদী আমলের গণমাধ্যমের ভূমিকা এখন কতটা পরিবর্তন হয়েছে, সে প্রশ্ন তুলে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘বিগত সময়ে নাহিদ ইসলাম তাঁর কাজ অসমাপ্ত রেখেই পদত্যাগ করেন। আরেকজন নামধারী মাস্টারমাইন্ড সেই পদে বসেছেন। কিন্তু তিনিও তাঁর কাজ কতটা করছেন?’
সংস্কারের নামে সরকার মুখে ফেনা তুলছে উল্লেখ করে রাশেদ খান বলেন, ‘জনগণ এখনো ধোঁয়াশায় রয়েছে। সরকার বারবার সংলাপ করছে। কিন্তু এই সংলাপের ফলাফল কী, আমরা কেউই জানি না। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে ডেকে কোনো সিদ্ধান্ত না দিতে পারলে এ ধরনের সংলাপের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা চা-শিঙাড়ার সংলাপ।’