ঢাকা ১১:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
স্বাস্থ্য প্রতিদিন

নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে চাই সামাজিক উদ্যোগ

  • আপডেট সময় : ০৫:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
  • ৬ বার পড়া হয়েছে
  • ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

রোগটি খুব একটা টের পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং একপর্যায়ে অকালমৃত্যুর কারণ হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ নামে চিহ্নিত করেছে। এটি এমন একটি অসংক্রামক রোগ, যার প্রভাবে স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল হওয়া কিংবা অন্ধত্বের মতো গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। অথচ কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ-দুটিই সম্ভব।

গত ১৭ মে ছিল বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক হাইপারটেনশন সোসাইটি দিনকে ঘিরে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছিল-‘Measure Your Blood Pressure Accurately, Control It, Live Longer’, অর্থাৎ “রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘজীবী হোন”। এই প্রতিপাদ্য এখন শুধু একটি স্বাস্থ্য বার্তা নয়, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ১২৮ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। কিন্তু তাদের প্রায় ৪৬ শতাংশই জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। প্রতি বছর উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আরো বাড়বে যদি এখনই সচেতনতা ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়।

বাংলাদেশেও চিত্রটি উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালের জাতীয় STEPS জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, যাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জানেন না তারা এ রোগে ভুগছেন। অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণেই তাদের অনেকেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা পান না।

এ রোগের প্রধান বিপদ এখানেই-শুরুতে কোনো উপসর্গ না থাকায় এটি দীর্ঘদিন অজান্তেই শরীরের ভেতর ক্ষয় চালাতে থাকে। মাথাব্যথা, অবসাদ, ঘাড় ভারী হওয়া, ঝাপসা দেখা-এসব লক্ষণ দেখা দিলেও অনেকেই গুরুত্ব দেন না। ফলে রোগ শনাক্ত না হওয়াই এর বড় সমস্যা। অথচ নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা, জীবনাচরণে পরিবর্তন ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এই অসুখের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়মিত জীবনযাপন এবং বংশগত প্রবণতা। উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের তরুণ সমাজও এখন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে রয়েছে। মোবাইল নির্ভরতা, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার গ্রহণ, ওজন বৃদ্ধি, ধূমপানের প্রতি আসক্তি-সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

তবে আশার কথা হলো-এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম, কম লবণ খাওয়া, প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যাদের উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না- এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (NCDC) মাধ্যমে ইতিমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্তরে উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা ও চিকিৎসা চালু রয়েছে। তবে এই উদ্যোগের পরিধি ও কার্যকারিতা আরো বাড়ানো জরুরি।

উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলার ৩১০টি উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অসংক্রামক রোগ কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৮২টি উপজেলার সব কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সঙ্গে জনসচেতনতামূলক মতবিনিময় করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব উপজেলার ১০ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপ ও এ সংক্রান্ত ওষুধ নির্দেশনা নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে রক্তচাপ মাপা, জীবনধারা পরিবর্তনের পরামর্শ, চিকিৎসকের কাছে রেফার করা ও সচেতনতা তৈরি-এই কাজগুলো নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছে প্রশিক্ষিত কর্মীরা। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য সংগঠনের এই কর্মসূচির মাধ্যমে রক্তচাপ পরিমাপ করে বহু মানুষ প্রথমবারের মতো জেনেছেন, তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রেজিস্টার্ড ৮ লাখের বেশি মানুষ এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে রোগীদের বিনামূল্যে ৫টি ওষুধ (Amlodipine, Losartan, Hydrochlorothiazide, Metformin, Gliclazide) প্রদান করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সচেতনতা ও চিকিৎসাসেবা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি? শহরের বাইরে কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো সচেতনতার অভাব প্রকট। অনেকেই জানেন না, রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করার দরকার কতটা জরুরি। চিকিৎসাসেবা গ্রহণেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা-ওষুধের দাম, চিকিৎসকের অভাব কিংবা অবহেলা।

এ পরিস্থিতিতে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে আমাদের এখনই সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। একদিকে যেমন দরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহজপ্রাপ্য করা, অন্যদিকে দরকার শিক্ষা, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মিলে স্কুল পর্যায় থেকেই স্বাস্থ্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। খাদ্য পণ্যে অতিরিক্ত লবণ ও ট্রান্সফ্যাট কমানো, তামাক ও সোডা ড্রিংক্সের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবান পরিবেশ নিশ্চিত করা-এই নীতিগত পদক্ষেপগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। বাড়ির বয়স্ক সদস্য হোক বা কর্মজীবী তরুণ-সবারই উচিত বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরিমাপ করা। এই অভ্যাস জীবন বাঁচাতে পারে।

বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি আহ্বান-নিজের এবং আশপাশের মানুষের জীবনের প্রতি দায়িত্ব নেওয়ার। একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে উচ্চ রক্তচাপের মতো নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্বাস্থ্য প্রতিদিন

নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে চাই সামাজিক উদ্যোগ

আপডেট সময় : ০৫:৫৫:৩৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
  • ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী

রোগটি খুব একটা টের পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং একপর্যায়ে অকালমৃত্যুর কারণ হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞান তাই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ নামে চিহ্নিত করেছে। এটি এমন একটি অসংক্রামক রোগ, যার প্রভাবে স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বিকল হওয়া কিংবা অন্ধত্বের মতো গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। অথচ কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ-দুটিই সম্ভব।

গত ১৭ মে ছিল বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক হাইপারটেনশন সোসাইটি দিনকে ঘিরে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছিল-‘Measure Your Blood Pressure Accurately, Control It, Live Longer’, অর্থাৎ “রক্তচাপ সঠিকভাবে মাপুন, নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘজীবী হোন”। এই প্রতিপাদ্য এখন শুধু একটি স্বাস্থ্য বার্তা নয়, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে প্রায় ১২৮ কোটি মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। কিন্তু তাদের প্রায় ৪৬ শতাংশই জানেন না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে। প্রতি বছর উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছেন প্রায় ১ কোটি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আরো বাড়বে যদি এখনই সচেতনতা ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়।

বাংলাদেশেও চিত্রটি উদ্বেগজনক। ২০১৮ সালের জাতীয় STEPS জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত, যাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি জানেন না তারা এ রোগে ভুগছেন। অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণেই তাদের অনেকেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা পান না।

এ রোগের প্রধান বিপদ এখানেই-শুরুতে কোনো উপসর্গ না থাকায় এটি দীর্ঘদিন অজান্তেই শরীরের ভেতর ক্ষয় চালাতে থাকে। মাথাব্যথা, অবসাদ, ঘাড় ভারী হওয়া, ঝাপসা দেখা-এসব লক্ষণ দেখা দিলেও অনেকেই গুরুত্ব দেন না। ফলে রোগ শনাক্ত না হওয়াই এর বড় সমস্যা। অথচ নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা, জীবনাচরণে পরিবর্তন ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

এই অসুখের মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অনিয়মিত জীবনযাপন এবং বংশগত প্রবণতা। উদ্বেগের বিষয় হলো, আমাদের তরুণ সমাজও এখন উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে রয়েছে। মোবাইল নির্ভরতা, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার গ্রহণ, ওজন বৃদ্ধি, ধূমপানের প্রতি আসক্তি-সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

তবে আশার কথা হলো-এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম, কম লবণ খাওয়া, প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন, পর্যাপ্ত ঘুম ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রক্তচাপ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যাদের উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না- এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (NCDC) মাধ্যমে ইতিমধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিকসহ বিভিন্ন স্তরে উচ্চ রক্তচাপ পরীক্ষা ও চিকিৎসা চালু রয়েছে। তবে এই উদ্যোগের পরিধি ও কার্যকারিতা আরো বাড়ানো জরুরি।

উচ্চ রক্তচাপ শনাক্তকরণ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ বর্তমানে দেশের ৪৪টি জেলার ৩১০টি উপজেলার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অসংক্রামক রোগ কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতিমধ্যে প্রায় ১৮২টি উপজেলার সব কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপের সঙ্গে জনসচেতনতামূলক মতবিনিময় করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব উপজেলার ১০ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্চ রক্তচাপ পরিমাপ ও এ সংক্রান্ত ওষুধ নির্দেশনা নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে রক্তচাপ মাপা, জীবনধারা পরিবর্তনের পরামর্শ, চিকিৎসকের কাছে রেফার করা ও সচেতনতা তৈরি-এই কাজগুলো নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছে প্রশিক্ষিত কর্মীরা। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন এবং অন্যান্য সংগঠনের এই কর্মসূচির মাধ্যমে রক্তচাপ পরিমাপ করে বহু মানুষ প্রথমবারের মতো জেনেছেন, তাদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। বর্তমানে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রেজিস্টার্ড ৮ লাখের বেশি মানুষ এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে রোগীদের বিনামূল্যে ৫টি ওষুধ (Amlodipine, Losartan, Hydrochlorothiazide, Metformin, Gliclazide) প্রদান করা হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সচেতনতা ও চিকিৎসাসেবা দেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি? শহরের বাইরে কিংবা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখনো সচেতনতার অভাব প্রকট। অনেকেই জানেন না, রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করার দরকার কতটা জরুরি। চিকিৎসাসেবা গ্রহণেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা-ওষুধের দাম, চিকিৎসকের অভাব কিংবা অবহেলা।

এ পরিস্থিতিতে উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে আমাদের এখনই সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিতে হবে। একদিকে যেমন দরকার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহজপ্রাপ্য করা, অন্যদিকে দরকার শিক্ষা, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের সব স্তরের অংশগ্রহণ।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মিলে স্কুল পর্যায় থেকেই স্বাস্থ্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। খাদ্য পণ্যে অতিরিক্ত লবণ ও ট্রান্সফ্যাট কমানো, তামাক ও সোডা ড্রিংক্সের বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবান পরিবেশ নিশ্চিত করা-এই নীতিগত পদক্ষেপগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। বাড়ির বয়স্ক সদস্য হোক বা কর্মজীবী তরুণ-সবারই উচিত বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ পরিমাপ করা। এই অভ্যাস জীবন বাঁচাতে পারে।

বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি আহ্বান-নিজের এবং আশপাশের মানুষের জীবনের প্রতি দায়িত্ব নেওয়ার। একটি সুস্থ ও কর্মক্ষম জাতি গঠনে উচ্চ রক্তচাপের মতো নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট