নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা স্পষ্ট করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
রোববার (১১ মে) দুপুরে ঢাকার মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, আমরা যত প্রশ্ন উত্থাপন করতেসি, যত ধরনের আলোচনা করতেসি, এই আলোচনার সঙ্গে আসলে নির্বাচন পিছানো-আগানো এগুলোর সম্পর্ক নাই। নির্বাচনের সাপেক্ষে আমরা যাতে এ দাবিগুলোকে না দেখি। আমাদের দলের জায়গা থেকে আমরা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা যে সময় দিয়েছেন আমরা সেটাকে সমর্থন করছি। তবে নির্বাচনে যাওয়ার আগে মৌলিক সংস্কারের যে রূপরেখা সেটি আমাদের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।”
রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের মধ্যে পাঁচটির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগলোর সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ চলমান রয়েছে।
সংস্কারের খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম সংবিধান সংস্কার। এ বিষয়ে নাগরিক জোটের ৭ প্রস্তাব নিয়ে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘নাগরিক কোয়ালিশন’।
সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা তুলে ধরেছে এনসিপি। এছাড়া নির্বাচনের আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের বিচারও দলটির অন্যতম দাবি। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়।
সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আওয়ামী লীগ এবং দলটির নেতাদের বিচার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
নাগরিক কোয়ালিশনের আলোচনা সভায় এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের মাধ্যমে বিচার কার্যক্রমে আমরা একটা অংশ এগিয়ে গিয়েছি। বিচারের রোডম্যাপটা যদি আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয় যে এটা কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে, সেটা জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করবে। আর একই সাথে সংস্কারে ঐকমত্যে আসলে নির্বাচনের জন্য আর কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা না।
রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে সমঝোতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করে নাহিদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নিজেরা আলোচনা করে, সমঝোতা করে এগুতে পারি, এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় উদাহারণ তৈরি হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো কেন নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করে সমঝোতা করতে পারবে না? এ প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, যে কোনো ধরণের সিভিল সোসাইটি ছাড়া যদি আমরা সমঝোতায় আসতে পারি এটা বাংলাদেশের জন্য বড় উদাহারণ হবে। রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে যে আস্থার সংকট সেটাও দূর হবে। ২৪ সৃষ্টি হওয়ার ঐক্যের জায়গাটা ধরে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারবো।
সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের জন্য গণপরিষদ প্রয়োজন মন্তব্য করে এনসিপির এই নেতা বলেন, জাতীয় নাগরিক পার্টি গণপরিষদকে সাপোর্ট করে আসছে শুরু থেকে। নতুন সংবিধান যেহেতু আমাদের একটা দলীয় এজেন্ডা, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের একটি নতুন রিপাবলিক একটি নতুন সংবিধানের মাধ্যমে তৈরি করা উচিত। তবে এ ইন্টেরিম সময়ের জন্য যেহেতু একটা মধ্যপন্থা হিসেবে আমরা বলেছি, নির্বাচিত সংসদ একই সাথে আইনসভা ও গণপরিষদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে; আমরা দলের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব করেছি।
বিভিন্ন সময় সংবিধানের সংশোধনীগুলো টেকসই হয়নি মন্তব্য করে নাহিদ বলেন, এটা বারবার আদালতে গিয়েছে, পরবর্তী সময় আদালত এসে তা বাতিল করে দিয়েছে। সত্যিকারের মৌলিক পরিবর্তন চাইলে গণপরিষদের মাধ্যমেই যেতে হবে।
এক ব্যক্তির ইচ্ছায় সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, একটা গণঅভ্যুত্থানের পরও এত মানুষ রক্ত দিয়েছে, কিন্তু সংবিধানকে মৌলিকভাবে পরিবর্তনের জন্য সম্মত হতে পারছি না, এটি আমাদের জন্য দুঃখজনক।
সংবিধান পরিবর্তন বা একটা ভালো সংবিধান প্রণয়ন সব সমাধান করবে না বলেও স্বীকার করে তিনি। এনসিপি নেতা বলেন, সংবিধানকে যদি আপনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ একটা চুক্তি আকারে ধরেন তাহলে সে চুক্তির সাথে জনগণের একটা আস্থার জায়গা থাকতে হয়। কিন্তু একটা নতুন সংবিধান তৈরি করার মাধ্যমে সে আস্থার জায়গাটা স্থাপন করা যাবে।
সংবিধানে দলীয় মূলনীতির প্রতিফলন দেখতে চান না তুলে ধরে এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, বাহাত্তর ও বাহাত্তর পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ‘দলের মূলনীতিকেই সংবিধানের মূলনীতি’ করা হয়েছে। এখনও আবারও একটা দলীয় মূলনীতি ফিরিয়ে আনার ‘প্রস্তাব’ আছে। যদি মূলনীতি থাকতে হয় সেটা যেন কোনো দলীয় মূলনীতি না হয়। মূলনীতি এমন হতে পারে যেটাকে রাষ্ট্রের প্রতিটা নাগরিক ওউন করতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত ভিশন, মূল্যবোধ ও চরিত্র সে মূলনীতির মধ্য দিয়ে স্থাপিত হবে।
একই অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি মু. শফিকুল ইসলাম মাসুদ সংবিধান ও জনগণের সম্পর্ককে সূতা ও ঘুড়ির সঙ্গে তুলনা করেন।
তিনি বলেন, সূতাও ঘুড়ি উড়ায় না, ঘুড়িও সূতা উড়ায় না। মূলত সূতা যদি ঘুড়িকে অস্বীকার করে তাহলে ঘুড়ির অস্তিত্ব থাকে না, ঘুড়ি যদি সূতাকে অস্বীকার করে তাহলে ঘুড়ির ওড়ার ক্ষমতা থাকে না। বিভিন্ন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সমন্বয়ে গঠিত নাগরিক কোয়ালিশনের এ আয়োজনের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আলোকচিত্রী ও নাগরিক কোয়ালিশনের সহ-আহ্বায়ক শহিদুল আলম।
অনুষ্ঠানে সংবিধান সংস্কার নিয়ে নাগরিক জোটের ৭ প্রস্তাব তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান। আর প্রস্তাব কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা তুলে ধরেন অর্থনীতিবিদ ও লেখক জিয়া হাসান।
আলোচনা সভায় অন্যদের বক্তব্য রাখেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন, ঐক্যমত কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরের আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, এনডিএম সভাপতি ববি হাজ্জাজ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান।