ঢাকা ০৮:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৬ মে ২০২৫
স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে ‘মৌলিক অধিকার’ ঘোষণার সুপারিশ

  • আপডেট সময় : ০৫:০৭:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য কমিশনের সদস্যরা সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন -ছবি সংগৃহীত

বিশেষ প্রতিনিধি: অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটি অধ্যাদেশ জারি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং দরিদ্রদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।

এছাড়া বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস চালু, মেডিকেল পুলিশ গঠন, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মতো একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে এ কমিশনের প্রতিবেদনে।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এই কমিশনের সদস্যরা সোমবার (৫ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। পরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে তারা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতি দরিদ্র মানুষ সব ধরনের সেবা বিনামূল্যে পাবে। ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগী বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পাবে। অত্যাবশ্যকীয় ঔষধ প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং ওষুধের তালিকা প্রতি দুই বছর পর হালনাগাদ করতে হবে।

ক্যান্সার, ডায়বেটিসের ওষুধের ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। জরুরি ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো ও দুই বছর পর পর সেই তালিকা হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

কমিশন বলেছে, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের কাছে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন না। কেবল চিকিৎসকদের ই-মেইলে বা ডাকযোগে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবেন। কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ নামে একটি স্বতন্ত্র কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। সেজন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন এবং জনবল কাঠামো পুনর্র্নিধারণের প্রস্তাব করেছে কমিশন।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন -ছবি সংগৃহীত

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে।

বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস প্রধান ও উপপ্রধান, মহাপরিচালক, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, বিএমডিসি ও বিএমআরসি চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা সম্পর্কে জাতীয় সংসদকে অবহিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা বিভাগ পৃথককরণ, জনবল নিয়োগ ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, নতুন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগেই প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা, বাজেট বরাদ্দ ও দালাল দমন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠন, ফিজিওথেরাপি বিভাগ ও পদ সৃষ্টি এবং গ্রাম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনে।

সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে কিছু নতুন আইন করার কথা বলা হয়েছে। আইনগুলো হল– স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন; হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক এক্রেডিটেশন আইন; বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিকেল ডিভাইস আইন।

এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি কপোরেশন আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৫১টি বৈঠক করেছেন। কমিশন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল এবং ঢাকায় ৩২টি পরামর্শ সভা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের মাধ্যমে ৮২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে।

হাজারের বেশি বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া চলছে: স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১৫ হাজার ২৩৩টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ১২৩টি তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে এবং ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল এবং আইন লঙ্ঘনের মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা রোগীদের নিরাপত্তা এবং পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এই খাতের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা প্রসঙ্গে বলা হয়, বেসরকারি খাতের লাইসেন্সিং এবং চিকিৎসা অবহেলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জগুলো জটিল।

অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি দফতরের অনুমতি নিতে গিয়ে মালিকদের বারবার বিভিন্ন অফিসে যাতায়াত করতে হয়। লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর চাহিদা প্রসঙ্গে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিবেশ লাইসেন্স চায়, অথচ পরিবেশ অধিদফতর প্রথমে হাসপাতাল লাইসেন্স চায়। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফি বেড়ে যাওয়ায় ছোট ক্লিনিকগুলো লাইসেন্স করতে আগ্রহ হারাচ্ছে বলে মনে করে কমিশন। লাইসেন্স পেতে বিলম্বের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অনেক সময় কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ২-৩ বছর পর্যন্ত লাইসেন্স পেতে বিলম্ব হয় এবং অননুমোদিত অর্থের দাবি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।

অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়ানো ও চিকিৎসকদের উপহার বন্ধের সুপারিশ: স্বাস্থ্য খাতের অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা অনেক দুর্বল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। তাদের মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এখনও একটি কার্যকর ও অভিযোগ নিষ্পত্তির সুলভ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যা জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো যথাযথভাবে সমাধান করতে পারে, সেটা সরকারি হোক বা বেসরকারি খাতেই হোক।

৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকদের উপহার গ্রহণ করা বন্ধ করারও সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল হলো দেশের চিকিৎসক ও দন্ত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এবং এদের পেশাগত আচরণ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির এখতিয়ারও এই সংস্থার রয়েছে। তবে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অভিযোগ নিষ্পত্তিতে খুবই দুর্বল পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, যার ফলে রোগী ও তাদের পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনগণের আস্থাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে।

এতে বলা হয়, মেডিক্যাল এথিকস কমিটি এবং রিপোর্টিং গাইডলাইন থাকা সত্ত্বেও, অনিয়ম ও অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রয়োগ ক্ষমতা দুর্বল। দেরি ও জবাবদিহির অভাবে বহু অনিয়মের অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় না। এছাড়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল একটি বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় কাজ করে, যেখানে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত দুর্বল। ফলে অকার্যকারিতা আরো বাড়ে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে একটি আধুনিক ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পত্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অভিযোগকারীরা সহজে অনলাইনে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন এবং প্রতিটি অভিযোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এতে স্বয়ংক্রিয় অভিযোগ শ্রেণিবিন্যাস, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি, তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবাপ্রদানকারীর এবং অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রেখে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে। এই প্ল্যাটফর্ম স্বাস্থ্য খাতের জবাবদিহি ও নৈতিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রতিবেদনে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বিষয়ে বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বজনীন প্রাপ্যতাকে একটি মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। দেশের সব নাগরিককে প্রয়োজনের ভিত্তিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিনামূল্যে (যথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে এবং অতি দরিদ্রের ক্ষেত্রে) বা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এজন্য সরকারি ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়ন ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ওষুধ সংগ্রহে কৌশলগত ক্রয়ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। এই ফার্মেসিগুলো জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্কের আওতায় পরিচালিত হবে।

এছাড়া অ্যান্টি-ক্যান্সার, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর ভ্যাট এবং প্রযোজ্য অন্যান্য শুল্ক ও কর শূন্য করার সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে, ভিটামিন, মিনারেলস, ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট ও প্রোবায়োটিকসহ স্বাস্থ্য-সম্পূরক ও উচ্চমূল্যের ঔষধের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়বে, অপরদিকে তুলনামূলক কম-প্রয়োজনীয় ও বিলাসমূলক পণ্যে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় জোরদার করা যাবে।

প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবনার আলোকে চিকিৎসকদের ওষুধের নমুনা বা উপহার প্রদান করে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মেডিক্যাল কনফারেন্স আয়োজনের আগে অবশ্যই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল অনুমোদিত ক্রেডিট পয়েন্ট গ্রহণের জন্য আবেদন করতে হবে এবং মেডিক্যাল কনফারেন্সের সব আয়-ব্যয়ের হিসাব ট্যাক্স অফিসে জমা দিতে হবে এবং এর একটি কপি বিএমইএসি-তে জমা দিতে হবে।

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্যরা -ছবি সংগৃহীত

কনফারেন্সে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো অনুমোদিত কনফারেন্সে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পারবে, তবে কেবলমাত্র প্রদর্শনী এলাকায় পণ্যের উপস্থাপনার জন্য তাদের প্রতিনিধির শারীরিক উপস্থিতি অনুমোদিত থাকবে। কোনো ধরনের খাবার, উপহারের ব্যাগ বা অন্য কোনো উপহার সামগ্রী সরবরাহ ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, রাফেল ড্র ইত্যাদি করতে পারবে না।

সুপারিশে বলা হয়, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র চিকিৎসকদের ই-মেইল বা ডাকযোগের মাধ্যমে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবে। প্রতিনিধিরা সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে দৈনন্দিন প্রোডাক্ট প্রমোশন করতে পারবে না। চিকিৎসকের চেম্বার বা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কোনো ধরনের ওষুধের/ পণ্য প্রচার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে, কারণ এসব কর্মকাণ্ডে চিকিৎসকের মনোযোগ বিঘ্নিত হয় এবং রোগীরা সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন।

স্বাস্থ্যখাতে নতুন ৭ আইন প্রণয়নের প্রস্তাব: স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠনসহ ৭টি আইন সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। তিনি বলেন, রোগীর সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ ও ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা ও জরুরি প্রস্তুতি নিশ্চিত করার জন্য সব সংশ্লিষ্ট পুরাতন আইন পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করতে হবে। নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

প্রস্তাবিত নতুন আইনগুলো হলো-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ এবং প্রবেশাধিকার আইন, অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনাল কমিশনার আইন ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কমিশনার আইন।

এ সময় কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এস এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বিফ্রিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কারের কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে ‘মৌলিক অধিকার’ ঘোষণার সুপারিশ

আপডেট সময় : ০৫:০৭:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

বিশেষ প্রতিনিধি: অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটি অধ্যাদেশ জারি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং দরিদ্রদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন।

এছাড়া বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস চালু, মেডিকেল পুলিশ গঠন, জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের মতো একগুচ্ছ সুপারিশ রয়েছে এ কমিশনের প্রতিবেদনে।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এই কমিশনের সদস্যরা সোমবার (৫ মে) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। পরে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে তারা প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।

কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতি দরিদ্র মানুষ সব ধরনের সেবা বিনামূল্যে পাবে। ১০ শতাংশ দরিদ্র রোগী বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে সেবা পাবে। অত্যাবশ্যকীয় ঔষধ প্রাথমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং ওষুধের তালিকা প্রতি দুই বছর পর হালনাগাদ করতে হবে।

ক্যান্সার, ডায়বেটিসের ওষুধের ভ্যাট ট্যাক্স মওকুফ করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। জরুরি ওষুধের সংখ্যা বাড়ানো ও দুই বছর পর পর সেই তালিকা হালনাগাদ করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

কমিশন বলেছে, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকের কাছে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে তাদের পণ্যের প্রচার করতে পারবেন না। কেবল চিকিৎসকদের ই-মেইলে বা ডাকযোগে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবেন। কমিশনের সদস্য ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন বলেন, ওষুধের নমুনা বা উপহার দিয়ে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস’ নামে একটি স্বতন্ত্র কাঠামো গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। সেজন্য আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন (স্বাস্থ্য) গঠন এবং জনবল কাঠামো পুনর্র্নিধারণের প্রস্তাব করেছে কমিশন।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন -ছবি সংগৃহীত

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতা, স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নিয়োগের সুপারিশ করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে।

বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস প্রধান ও উপপ্রধান, মহাপরিচালক, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রো-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, বিএমডিসি ও বিএমআরসি চেয়ারম্যানের মত গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা সম্পর্কে জাতীয় সংসদকে অবহিত করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখার সুপারিশ এসেছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবা বিভাগ পৃথককরণ, জনবল নিয়োগ ও উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, নতুন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগেই প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবল নিয়োগ নিশ্চিত করা, বাজেট বরাদ্দ ও দালাল দমন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ও রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ গঠন, ফিজিওথেরাপি বিভাগ ও পদ সৃষ্টি এবং গ্রাম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে প্রতিবেদনে।

সেই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে কিছু নতুন আইন করার কথা বলা হয়েছে। আইনগুলো হল– স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও রোগী নিরাপত্তা আইন; হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক এক্রেডিটেশন আইন; বাংলাদেশ সেইফ ফুড, ড্রাগ, আইভিডি ও মেডিকেল ডিভাইস আইন।

এছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, মেডিকেল শিক্ষা অ্যাক্রেডিটেশন আইন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল আইন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন, পৌর ও সিটি কপোরেশন আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংস্কার কমিশনের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৫১টি বৈঠক করেছেন। কমিশন চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশাল এবং ঢাকায় ৩২টি পরামর্শ সভা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বিভাগের মাধ্যমে ৮২৫৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের মতামত নেওয়া হয়েছে।

হাজারের বেশি বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া চলছে: স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১৫ হাজার ২৩৩টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ১২৩টি তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে এবং ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দুর্বল এবং আইন লঙ্ঘনের মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যা রোগীদের নিরাপত্তা এবং পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলছে।

৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে এই খাতের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা প্রসঙ্গে বলা হয়, বেসরকারি খাতের লাইসেন্সিং এবং চিকিৎসা অবহেলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় চ্যালেঞ্জগুলো জটিল।

অনুমোদন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে বলা হয়, বিভিন্ন সরকারি দফতরের অনুমতি নিতে গিয়ে মালিকদের বারবার বিভিন্ন অফিসে যাতায়াত করতে হয়। লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর চাহিদা প্রসঙ্গে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর পরিবেশ লাইসেন্স চায়, অথচ পরিবেশ অধিদফতর প্রথমে হাসপাতাল লাইসেন্স চায়। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফি বেড়ে যাওয়ায় ছোট ক্লিনিকগুলো লাইসেন্স করতে আগ্রহ হারাচ্ছে বলে মনে করে কমিশন। লাইসেন্স পেতে বিলম্বের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, অনেক সময় কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ২-৩ বছর পর্যন্ত লাইসেন্স পেতে বিলম্ব হয় এবং অননুমোদিত অর্থের দাবি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।

অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়ানো ও চিকিৎসকদের উপহার বন্ধের সুপারিশ: স্বাস্থ্য খাতের অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা অনেক দুর্বল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। তাদের মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এখনও একটি কার্যকর ও অভিযোগ নিষ্পত্তির সুলভ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যা জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো যথাযথভাবে সমাধান করতে পারে, সেটা সরকারি হোক বা বেসরকারি খাতেই হোক।

৩২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে অথবা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির কাছ থেকে চিকিৎসকদের উপহার গ্রহণ করা বন্ধ করারও সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল হলো দেশের চিকিৎসক ও দন্ত চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এবং এদের পেশাগত আচরণ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির এখতিয়ারও এই সংস্থার রয়েছে। তবে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল অভিযোগ নিষ্পত্তিতে খুবই দুর্বল পারফরম্যান্স দেখিয়েছে, যার ফলে রোগী ও তাদের পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এই ব্যর্থতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জনগণের আস্থাকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে।

এতে বলা হয়, মেডিক্যাল এথিকস কমিটি এবং রিপোর্টিং গাইডলাইন থাকা সত্ত্বেও, অনিয়ম ও অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রয়োগ ক্ষমতা দুর্বল। দেরি ও জবাবদিহির অভাবে বহু অনিয়মের অভিযোগ নিষ্পত্তি হয় না। এছাড়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল একটি বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থায় কাজ করে, যেখানে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় অত্যন্ত দুর্বল। ফলে অকার্যকারিতা আরো বাড়ে। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়াকে দ্রুত, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করতে একটি আধুনিক ডিজিটাল অভিযোগ নিষ্পত্তি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা জরুরি। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অভিযোগকারীরা সহজে অনলাইনে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন এবং প্রতিটি অভিযোগের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। এতে স্বয়ংক্রিয় অভিযোগ শ্রেণিবিন্যাস, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্ত ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি, তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সেবাপ্রদানকারীর এবং অভিযোগকারীর পরিচয় গোপন রেখে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা যাবে। এই প্ল্যাটফর্ম স্বাস্থ্য খাতের জবাবদিহি ও নৈতিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

প্রতিবেদনে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বিষয়ে বলা হয়েছে, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সর্বজনীন প্রাপ্যতাকে একটি মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। দেশের সব নাগরিককে প্রয়োজনের ভিত্তিতে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বিনামূল্যে (যথা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে এবং অতি দরিদ্রের ক্ষেত্রে) বা ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করতে হবে। এজন্য সরকারি ওষুধ উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আধুনিকায়ন ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করতে হবে। বেসরকারি খাত থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত ওষুধ সংগ্রহে কৌশলগত ক্রয়ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। এই ফার্মেসিগুলো জাতীয় ফার্মেসি নেটওয়ার্কের আওতায় পরিচালিত হবে।

এছাড়া অ্যান্টি-ক্যান্সার, অ্যান্টি-ডায়াবেটিক, অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকাভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর ভ্যাট এবং প্রযোজ্য অন্যান্য শুল্ক ও কর শূন্য করার সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে, ভিটামিন, মিনারেলস, ব্রেস্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট ও প্রোবায়োটিকসহ স্বাস্থ্য-সম্পূরক ও উচ্চমূল্যের ঔষধের ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে জনগণের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রাপ্যতা বাড়বে, অপরদিকে তুলনামূলক কম-প্রয়োজনীয় ও বিলাসমূলক পণ্যে কর বাড়িয়ে রাজস্ব আয় জোরদার করা যাবে।

প্রতিবেদনে ওয়ার্ল্ড মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাবনার আলোকে চিকিৎসকদের ওষুধের নমুনা বা উপহার প্রদান করে কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মেডিক্যাল কনফারেন্স আয়োজনের আগে অবশ্যই বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল অনুমোদিত ক্রেডিট পয়েন্ট গ্রহণের জন্য আবেদন করতে হবে এবং মেডিক্যাল কনফারেন্সের সব আয়-ব্যয়ের হিসাব ট্যাক্স অফিসে জমা দিতে হবে এবং এর একটি কপি বিএমইএসি-তে জমা দিতে হবে।

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্যরা -ছবি সংগৃহীত

কনফারেন্সে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো অনুমোদিত কনফারেন্সে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পারবে, তবে কেবলমাত্র প্রদর্শনী এলাকায় পণ্যের উপস্থাপনার জন্য তাদের প্রতিনিধির শারীরিক উপস্থিতি অনুমোদিত থাকবে। কোনো ধরনের খাবার, উপহারের ব্যাগ বা অন্য কোনো উপহার সামগ্রী সরবরাহ ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধূলা, রাফেল ড্র ইত্যাদি করতে পারবে না।

সুপারিশে বলা হয়, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র চিকিৎসকদের ই-মেইল বা ডাকযোগের মাধ্যমে তাদের পণ্য সম্পর্কিত তথ্য পাঠাতে পারবে। প্রতিনিধিরা সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে দৈনন্দিন প্রোডাক্ট প্রমোশন করতে পারবে না। চিকিৎসকের চেম্বার বা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কোনো ধরনের ওষুধের/ পণ্য প্রচার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ থাকবে, কারণ এসব কর্মকাণ্ডে চিকিৎসকের মনোযোগ বিঘ্নিত হয় এবং রোগীরা সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হন।

স্বাস্থ্যখাতে নতুন ৭ আইন প্রণয়নের প্রস্তাব: স্বাধীন ও স্থায়ী ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন’ গঠনসহ ৭টি আইন সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। তিনি বলেন, রোগীর সুরক্ষা, আর্থিক বরাদ্দ ও ধারাবাহিকতা, জবাবদিহিতা ও জরুরি প্রস্তুতি নিশ্চিত করার জন্য সব সংশ্লিষ্ট পুরাতন আইন পর্যালোচনা ও যুগোপযোগী করতে হবে। নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

প্রস্তাবিত নতুন আইনগুলো হলো-বাংলাদেশ স্বাস্থ্য কমিশন আইন, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস আইন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় আইন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ এবং প্রবেশাধিকার আইন, অ্যালায়েড হেলথ প্রফেশনাল কমিশনার আইন ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কমিশনার আইন।

এ সময় কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, সাবেক সচিব এস এম রেজা, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফ, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপ প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বিফ্রিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সংস্কারের কমিশনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।

২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।