বাংলাদেশের মাটি কৃষিপ্রধান। এখানকার মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবনধারা ও অর্থনৈতিক কাঠামো- সবই এক কথায় কৃষি ঘিরে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যতই বহুমুখী হোক না কেন; এর মূল ভিত্তি এখনো গাঁথা আছে কৃষকের কাস্তে, লাঙল আর ঘামে। দেশে যত খাদ্যশস্য, সবজি, ফল, মাছ বা মাংস আমরা খাই; এর সবই আসে সরাসরি কৃষকের পরিশ্রম থেকে। এ বিষয় নিয়েই এবারের কৃষি ও কৃষক পাতার প্রধান ফিচার
বোরো ফসলের অফুরন্ত ভান্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলা। এক সময় এই জেলার হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটার মৌসুমে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লাখো কৃষি শ্রমিকের আগমন ঘটতো। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধান কাটার মৌসুমেও শ্রমিক সংকট ক্রমেই প্রকট হচ্ছে।
বৈশাখের প্রখর রোদ ও ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কষ্ট করেও ন্যায্য মজুরি না পাওয়ায় অনেক শ্রমিকই এখন আর এই পেশায় থাকতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। পেশা বদল করে কেউ প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন, কেউ কেউ গার্মেন্টস ও নির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। এছাড়াও কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের প্রভাবে কমছে কৃষি শ্রমিক। আগে বোরো ধান কাটার মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলায় লাখো শ্রমিক কাজ করলেও চলতি মৌসুমে ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছেন।
মিঠামইন হাওরের কৃষক মারুফ মিয়া জানান, আগের মতো আর সহজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ধান কাটার শ্রমিকের সংখ্যা। বৈশাখের প্রখর রোদ ও ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে হাওরে ধান কাটা অনেক কষ্টের কাজ। তাই অনেক শ্রমিক তাদের পেশা বদল করছেন।
কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম জানান, আগে বোরো ধান কাটার সময় প্রতিদিনই ভোরে করগাঁও স্কুল মাঠে কৃষি শ্রমিকের হাট বসতো। এই হাটে স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের আগমন ঘটতো। এখন এই কৃষি শ্রমিকের হাট আর বসে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিকও আসে না।
নিকলী হাওরের কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, কৃষিশ্রমিক কমে যাওয়ার মূল কারণ কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের প্রভাব। শ্রমিক দিয়ে ১ একর জমির ধান কাটতে সময় লাগতো ৫-৬ ঘণ্টা, আর এই জমির ধান মেশিন দিয়ে কাটতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। এ ছাড়া কৃষিকাজ খুব কষ্টের কাজ, এটাও একটা কারণ।
নিকলী হাওরের ধান কাটতে নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলা থেকে ১৬ জনের একটি দল নিয়ে এসেছেন ষাট-ঊর্ধ্ব রুহুল আমিন। তিনি জানান, ৩০ বছর ধরে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলে বোরো ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আসেন। আগে দেখতাম রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক হাওরে ধান কাটাতে আসতো। গত বছর কম শ্রমিক আসছিল, এ বছর আরও কম শ্রমিক এসেছে। হাওরে রোদ-বৃষ্টিতে কাজ করা অনেক কষ্টের, রোজগারও কম। আগে আমার দলেই ছিল ৬০ থেকে ৬৫ জন। এখন এই দল ১৬ জনে নেমে এসেছে। অনেকেই এই পেশা বদল করে বিদেশে চলে গেছে।
ময়মনসিংহ থেকে ইটনা হাওরে ধান কাটতে আসা রহিম মিয়া জানান, যুগের পর যুগ ধরে কৃষিকাজে যুক্ত থাকলেও এখন অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আমরা কৃষি শ্রমিকরা দৈনিক কঠোর পরিশ্রম করেও ন্যায্য মজুরি পাচ্ছি না। ধান কাটার মতো মৌসুমী কাজ থেকে বছরে অল্প আয় হয়, যা দিয়ে আমাদের পরিবার চালানো দুষ্কর। এই আর্থিক অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের অনেকেই বিকল্প পেশায় যুক্ত হচ্ছেন।
মিঠামইন হাওরের কৃষক জিলানী ভূইয়া বলেন, শিক্ষার হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম অফিস বা শহরের চাকরিকে বেশি সম্মানজনক ও আরামদায়ক বলে মনে করছে। তারা কৃষিকাজকে ‘নিম্নমানের পেশা’ হিসেবে ভাবছে। তাই স্থানীয় কৃষিশ্রমিকও কমে যাচ্ছে।
কৃষিশ্রমিক মনিরুজ্জামান বলেন, আগে বোরো ধান কাটার মৌসুমে হাওরে এত বজ্রপাত হতো না, এখন কয়েক বছর ধরে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে হাওরে। বজ্রপাতে অনেক কৃষিশ্রমিক মারা যাচ্ছে। এই ভয়েও অনেক শ্রমিক হাওরে কাজ করতে আসতে চায় না। এ কারণেও তারা অন্য নিরাপদ পেশার দিকে ঝুঁকছে।
কৃষিশ্রমিক নুরুল ইসলাম জানান, এখন তো আমাদের ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে। তাই আমাদের অনেকেই মনে করেন, কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করলে সমাজে তাদের মর্যাদা কমে যায়। তাই তারা অন্য পেশায় যেতে আগ্রহী হচ্ছেন, বিশেষ করে যুবসমাজ।
নিকলী হাওরের কৃষক মানিক হোসেন বলেন, কম্বাইন্ড হারভেস্টার, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি কারণে কৃষিকাজ দ্রুত ও সাশ্রয়ী হয়েছে। শ্রমিকরাতো আর মেশিনের সঙ্গে কাজ করে পারবে না। তাই অনেকেই এই পেশা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু বলেন, আগে এক সময় কৃষিশ্রমিক হিসেবে হাওরে অনেক তরুণ-যুবক শ্রমিক দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানের তরুণ-যুবকরা চাকরি, ব্যবসা বা বিদেশে যাওয়ার সুযোগকে বেশি গুরুত্ব দেয়। অনেকেই মনে করেন কৃষিকাজ অসম্মানজনক। ফলে তারা বাবার এ পেশা অনুসরণ করতে চাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, শহরমুখী প্রবণতা এবং শ্রমের অবমূল্যায়নে দিন দিন ধান কাটার শ্রমিক সংকট বাড়ছে। কৃষি খাতে টেকসই সমাধান আনতে হলে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্য ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে এবং কৃষি শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। এসব সমস্যা যদি দ্রুত সমাধান না করা যায়, তাহলে কৃষিতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কৃষক ও শ্রমিক উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি খালেদ হাসান জুম্মন বলেন, কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃষি শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। মৌসুমি কাজ ছাড়াও কৃষি কাজে বিকল্প কাজের সুযোগ তৈরি করে হবে। সরকারকে কৃষি শ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। আধুনিক কৃষি প্রশিক্ষণ ও যন্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা দিয়ে কৃষিকাজে অংশগ্রহণে তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, আগে যেখানে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলেই লাখো কৃষিশ্রমিক কাজ করতো, সেখানে চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ৪৫ হাজার ৬০ জন কৃষিশ্রমিক কাজ করছে। কারণ সব কৃষকই তার কষ্টের ফসল দ্রুত ঘরে তুলতে চান। হাওরে যেকোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে চলতি বোরো ধান কাটার মৌসুমে কিশোরগঞ্জে ৫৭১টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে ধানা কাটা হচ্ছে। এই মেশিনের মাধ্যমে ধান কাটা হচ্ছে বলেই দ্রুত হাওরের ধান কাটা শেষের দিকে। কৃষকেরাও দ্রুত তার ধান করে তুলে নিরাপদ বোধ করছে।