ঢাকা ০৭:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশেই বেশি : বিশ্বব্যাংক

  • আপডেট সময় : ০৮:০০:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

অর্থনৈতিক ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে না। বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতির তালিকায় বাংলাদেশ টানা দুই বছর ধরে ‘লাল’ শ্রেণিতে রয়েছে। এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশেই বেশি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’ (নেতিবাচক), অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই চিত্র। নেপাল ও মালদ্বীপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম। ভুটানের হিসাব পাওয়া যায়নি। সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তানেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন মাইনাস।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরে মূল্যস্ফীতি ধরে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এ চিত্র পাওয়া গেছে। সর্বশেষ হিসাব মূলত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা-বিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। এর আগের টানা এক বছর বাংলাদেশ লাল শ্রেণির তালিকায় ছিল। প্রতি ছয় মাস পরপর এই চিত্র প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। সেই অনুসারে প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ লাল তালিকায় অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও ১৪টি দেশ এক বছর ধরে লাল শ্রেণিতে আছে। এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ভারতও আছে। অন্য দেশের মধ্যে রয়েছে কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়া।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কত বেশি, তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চার শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’ শ্রেণিতে; ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, তাদের ‘লাল’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদনে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তথা খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিষয়টি স্বীকার করতেই অনেক সময়ক্ষেপণ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে ডলারের বিনিময় হারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ওই সরকার একবার পেছনে, একবার সামনে গেছে- এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি নেই। চাঁদাবাজির উৎপাত বন্ধ হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। বাজারে শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছে, খেলা পরিবর্তন হয়নি। বাজারের খেলোয়াড়েরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কেমন করল: ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। অনেক দেশ নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়তে শুরু করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি ছিল। বেশি বিপাকে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। তারা এখন মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে পেরেছে। ভারতও চাপ সামলে নিয়েছে।

২০২২ সালে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই অবস্থা থেকে এখন উত্তরণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে মাইনাস দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, শ্রীলঙ্কা এখন সবুজ তালিকায়। এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমাতে জ্বালানি তেলসহ সরকারি পরিষেবার বিলের খরচ কমিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। একইভাবে বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানও অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়ে। পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশে পৌঁছায়। মূলত খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানও আইএমএফের কাছ থেকে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ছিল। বিশ্বব্যাংকের সবুজ তালিকায় আছে পাকিস্তান।

কয়েক বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে ভারতও চাপে পড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে ছিল দেশটি। কিন্তু দেশটির মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও ভারত এখনো বিশ্বব্যাংকের ‘লাল’ তালিকায় আছে। তবে বাংলাদেশের মতো খাদ্য মূল্যস্ফীতি এত বাড়েনি ভারতে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ আফগানিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক বছর ধরেই মাইনাস আছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল মাইনাস ৩ শতাংশ। দেশটিতে ব্যাপক হারে খাদ্যের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, নেপালে গত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে নেপালে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। মালদ্বীপে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। ভুটানের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়নি বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশ কেন লাল শ্রেণিতে: প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। তবে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। টানা ১০ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি।
১০ মাস পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে। মার্চ মাসেও তা এক অঙ্কের ঘরেই ছিল, যা একটু স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসের পর খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আর এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তিতে পড়েননি। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিবিএসের হিসাবে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যদি আপনার খাবার কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়; পরের এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খাবার কিনতে লাগল ১১০ টাকা ৪৪ পয়সা। প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা। এর মানে, বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের খাবার খরচ গড়ে এক-দশমাংশ বেড়েছে।

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। ধরুন, আপনার প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়; কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সে অনুযায়ী আপনার আয় না বাড়লে আপনাকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার অনেক দিন ধরেই কম।
অন্য শ্রেণিতে কোন দেশ: উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের তালিকায় টানা এক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ শ্রেণি বেগুনিতে আছে ছয়টি দেশ। এই দেশগুলো হলো মালাবি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক।

খাবারের দাম নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছে আটটি দেশ। সবুজ শ্রেণিভুক্ত দেশগুলো হলো সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন।
তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো গত এক বছরে কখনো লাল, কখনো বেগুনি, কখনো-বা হলুদ বা সবুজ তালিকায় ছিল। কেউ নিজেদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নতি করেছে, কারও অবনতি হয়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে কী করা উচিত- এমন প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্ব নীতিগুলো এমন করতে হবে, যেন মূল্যস্ফীতি কমে। এ ছাড়া বাজার তদারকিও জোরদার করতে হবে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশেই বেশি : বিশ্বব্যাংক

আপডেট সময় : ০৮:০০:৫০ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

অর্থনৈতিক ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে পারলেও বাংলাদেশ এখনো পারছে না। বিশ্বব্যাংকের খাদ্য মূল্যস্ফীতির তালিকায় বাংলাদেশ টানা দুই বছর ধরে ‘লাল’ শ্রেণিতে রয়েছে। এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশেই বেশি।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ভারতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ৬ শতাংশের কম। পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি এখন ‘মাইনাস’ (নেতিবাচক), অর্থাৎ খাদ্যপণ্যের দাম কমছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই চিত্র। নেপাল ও মালদ্বীপে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কম। ভুটানের হিসাব পাওয়া যায়নি। সার্কভুক্ত দেশ আফগানিস্তানেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন মাইনাস।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তার হালনাগাদ পরিস্থিতি তুলে ধরে মূল্যস্ফীতি ধরে হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর এ চিত্র পাওয়া গেছে। সর্বশেষ হিসাব মূলত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মার্চ শেষে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ ১০ থেকে ১২ মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা-বিষয়ক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। এর আগের টানা এক বছর বাংলাদেশ লাল শ্রেণির তালিকায় ছিল। প্রতি ছয় মাস পরপর এই চিত্র প্রকাশ করে থাকে সংস্থাটি। সেই অনুসারে প্রায় দুই বছর ধরে বাংলাদেশ লাল তালিকায় অর্থাৎ অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।

বাংলাদেশের পাশাপাশি আরও ১৪টি দেশ এক বছর ধরে লাল শ্রেণিতে আছে। এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ভারতও আছে। অন্য দেশের মধ্যে রয়েছে কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, মাদাগাস্কার, ঘানা, লাওস, লেসেথো, তিউনিসিয়া, জাম্বিয়া, বেলারুশ ও রাশিয়া।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোন দেশে কত বেশি, তা বোঝাতে বিভিন্ন দেশকে চার শ্রেণিতে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ বা তার বেশি, সেসব দেশকে ‘বেগুনি’ শ্রেণিতে; ৫ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে যেসব দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি, তাদের ‘লাল’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ২ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘হলুদ’ ও ২ শতাংশের কম মূল্যস্ফীতির দেশগুলোকে ‘সবুজ’ শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭২টি দেশের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে সংস্থাটির প্রতিবেদনে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, তথা খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিষয়টি স্বীকার করতেই অনেক সময়ক্ষেপণ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে ডলারের বিনিময় হারের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ওই সরকার একবার পেছনে, একবার সামনে গেছে- এমন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজার তদারকি নেই। চাঁদাবাজির উৎপাত বন্ধ হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। বাজারে শুধু খেলোয়াড় পরিবর্তন হয়েছে, খেলা পরিবর্তন হয়নি। বাজারের খেলোয়াড়েরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কেমন করল: ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বজুড়ে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে। অনেক দেশ নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়তে শুরু করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি ছিল। বেশি বিপাকে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। তারা এখন মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে পেরেছে। ভারতও চাপ সামলে নিয়েছে।

২০২২ সালে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। এরপর ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২৯০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দেশটি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সেই অবস্থা থেকে এখন উত্তরণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে মাইনাস দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, শ্রীলঙ্কা এখন সবুজ তালিকায়। এক বছর ধরে শ্রীলঙ্কার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের বেশি হয়নি। মূল্যস্ফীতি কমাতে জ্বালানি তেলসহ সরকারি পরিষেবার বিলের খরচ কমিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। একইভাবে বছর দুয়েক আগে পাকিস্তানও অর্থনীতি নিয়ে বিপদে পড়ে। পাকিস্তানেও মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশে পৌঁছায়। মূলত খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পাকিস্তানও আইএমএফের কাছ থেকে ৭০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ ১০ মাসের মধ্যে পাঁচ মাসই খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ছিল। বিশ্বব্যাংকের সবুজ তালিকায় আছে পাকিস্তান।

কয়েক বছর ধরে অর্থনীতি নিয়ে ভারতও চাপে পড়ে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ে চাপে ছিল দেশটি। কিন্তু দেশটির মূল্যস্ফীতি কয়েক মাস ধরে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ভারতের খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও ভারত এখনো বিশ্বব্যাংকের ‘লাল’ তালিকায় আছে। তবে বাংলাদেশের মতো খাদ্য মূল্যস্ফীতি এত বাড়েনি ভারতে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ আফগানিস্তানের খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক বছর ধরেই মাইনাস আছে। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল মাইনাস ৩ শতাংশ। দেশটিতে ব্যাপক হারে খাদ্যের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, নেপালে গত এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ছিল। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে নেপালে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। মালদ্বীপে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল। ভুটানের খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাব দেয়নি বিশ্বব্যাংক।

বাংলাদেশ কেন লাল শ্রেণিতে: প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। তবে এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। টানা ১০ মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি।
১০ মাস পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে নামে। মার্চ মাসেও তা এক অঙ্কের ঘরেই ছিল, যা একটু স্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের মার্চ মাসের পর খাদ্যের মূল্যস্ফীতি আর এক অঙ্কের ঘরে নামেনি। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ এত দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তিতে পড়েননি। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে ওঠে, যা গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বিবিএসের হিসাবে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের পর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

গত এক বছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৪ শতাংশ হওয়ার মানে হলো, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যদি আপনার খাবার কিনতে ১০০ টাকা খরচ হয়; পরের এক বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের মার্চ থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত খাবার কিনতে লাগল ১১০ টাকা ৪৪ পয়সা। প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ১০ টাকা ৪৪ পয়সা। এর মানে, বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষের খাবার খরচ গড়ে এক-দশমাংশ বেড়েছে।

মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। ধরুন, আপনার প্রতি মাসে আয়ের পুরোটাই সংসার চালাতে খরচ হয়ে যায়; কিন্তু হঠাৎ জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এবং সে অনুযায়ী আপনার আয় না বাড়লে আপনাকে ধারদেনা করে সংসার চালাতে হবে কিংবা খাবার, কাপড়চোপড়, যাতায়াতসহ বিভিন্ন খাতে কাটছাঁট করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধি বা আয় বৃদ্ধি কম হলে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে। প্রকৃত আয় কমে যায়। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার অনেক দিন ধরেই কম।
অন্য শ্রেণিতে কোন দেশ: উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের তালিকায় টানা এক বছর ধরে সবচেয়ে খারাপ শ্রেণি বেগুনিতে আছে ছয়টি দেশ। এই দেশগুলো হলো মালাবি, দক্ষিণ সুদান, হাইতি, মিয়ানমার, আর্জেন্টিনা ও তুরস্ক।

খাবারের দাম নিয়ে সবচেয়ে ভালো আছে আটটি দেশ। সবুজ শ্রেণিভুক্ত দেশগুলো হলো সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, সৌদি আরব, ম্যাকাও, চীন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও বেনিন।
তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো গত এক বছরে কখনো লাল, কখনো বেগুনি, কখনো-বা হলুদ বা সবুজ তালিকায় ছিল। কেউ নিজেদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির উন্নতি করেছে, কারও অবনতি হয়েছে।
খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে কী করা উচিত- এমন প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্ব নীতিগুলো এমন করতে হবে, যেন মূল্যস্ফীতি কমে। এ ছাড়া বাজার তদারকিও জোরদার করতে হবে।