ঢাকা ০২:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

মহাকাশ অভিযান ও অনুসন্ধানে নারীদের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য

  • আপডেট সময় : ০৫:০৮:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

মহাকাশ অভিযান ও অনুসন্ধানে নারীদের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে রোমাঞ্চ ও বিস্ময়ের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে আকাশ আর তারা। প্রাচীন ধর্মযাজক ও ব্যাবিলনীয়রা তারার উপাসনা করতেন। গ্রিকরা এসবের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তাদের বুঝতে শুরু করেছিলেন। তাদের বাইরেও মাটিতে যায় ঘটুক না কেন, মহাবিশ্বে কী ঘটছে; তা প্রত্যেকের মনেই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। কিন্তু মহাকাশের আধুনিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে নারীরা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রেখেছেন, দুঃখজনকভাবে তা অনেকেই মনে রাখেননি। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার
নারীরা কেবল মহাকাশ অভিযানেই যাননি, বরং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিও তাদের হাত ধরেই এসেছে। তারা মহাবিশ্বের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেসব নারীরা হলেন-

ক্যাথরিন জনসন: যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার শুরুর দিনগুলোতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদ ছিলেন ক্যাথরিন জনসন। নাসার পূর্বসূরি ‘এনএসিএ’তে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের একজনও ছিলেন তিনি। ১৯১৮ সালের ২৬ আগস্টে জন্মেছিলেন জনসন। ডিজিটাল কম্পিউটিং সময়েরও আগে নাসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ ছিলেন তিনি। অসংখ্য ঐতিহাসিক নাসা মিশনের কক্ষপথ ও গতিপথ ম্যানুয়ালি গণনা করেছিলেন জনসন। যার মধ্যে রয়েছে প্রথম আমেরিকান হিসেবে অ্যালান শেপার্ডের ঐতিহাসিক মহাকাশ মিশনও। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৫ সালে তাকে সম্মান জানান প্রেসিডেন্সিয়াল মেডাল অফ ফ্রিডমের মাধ্যমে।

ডরোথি ভন: নাসার আরেকজন মূল সদস্য ও ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ ছিলেন ডরোথি ভন। ভার্জিনিয়ার ‘ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার’-এর কোনো বিভাগের সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারীও ছিলেন তিনি। ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ হিসাবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ভন। ডিজিটাল কম্পিউটিংয়ের আবির্ভাবের মাধ্যমে নাসার হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে ও তার গণিতবিদদের দল ‘ওয়েস্ট এরিয়া কম্পিউটার্স’কে কোডিং ভাষাও শিখিয়েছিলেন ভন।
মেরি উইনস্টন জ্যাকসন: নাসার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রকৌশলী ছিলেন ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া মেরি জ্যাকসন। সংস্থাটির সুপারভাইজার পদে প্রস্তাব পাওয়ার পরও তিনি স্বেচ্ছায় পদাবনতি গ্রহণ করেন, যা সুপারভাইজারের চেয়ে কম মর্যাদার হলেও নাসায় কর্মী নিয়োগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। এ ভূমিকায় নাসায় নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে ও আরো বেশি সংখ্যায় নারীদের নিয়োগ করতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে মারা যাওয়া জ্যাকসনকে মরণোত্তর ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’ দেওয়া হয়েছিল এবং তারই সম্মানে নাসার ওয়াশিংটন ডিসি সদর দপ্তরের নাম পরিবর্তন করে সংস্থাটি।
ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা: রাশিয়ান মহাকাশচারী ও টেক্সটাইল কারখানার সাবেক কর্মী ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা ছিলেন মহাকাশে যাওয়া প্রথম নারী এবং ২০২২ সাল পর্যন্ত একক মহাকাশ মিশন চালানো সবচেয়ে কনিষ্ঠ নারীও। তিনি ১৯৬৩ সালের ৬ জুন মহাকাশে যান এবং ফিরে আসার আগে ৪৮ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। এরপর আর মহাকাশে না গেলেও মহাকাশ কর্মসূচিতে একজন প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন তেরেসকোভা। ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার ‘জুকোভস্কি এয়ার ফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাকাডেমি’ থেকে স্নাতক করেন তিনি।

স্যালি রাইড: তেরেস্কোভার মহাকাশে যাওয়ার প্রায় দুই দশক পর ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানী স্যালি রাইড প্রথম মার্কিন নারী হিসেবে মহাকাশে যান। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের একমাত্র পরিচিত সদস্য ছিলেন যিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন। মহাকাশে ভ্রমণে প্রস্তুতির সময় সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সঙ্গী বাছাইয়ে নিজের পছন্দ গোপন রেখেছিলেন রাইড। তবে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী টেনিস খেলোয়াড় ট্যাম ও’শাগনেসিকে নিজের মৃত্যুর বাণীতে তাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করার অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
কিটি জয়নার: কিটি জয়নার ১৯৩৯ সালে কেবল ‘এনএসিএ’-এর প্রথম নারী প্রকৌশলীই ছিলেন না, বরং ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া’র ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম থেকে স্নাতক হওয়া প্রথম নারীও ছিলেন জয়নার। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এনএসিএ ও নাসায় কাজ চালিয়ে গিয়েছেন জয়নার; যেখানে সংস্থাটির বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প তদারকি করার পাশাপাশি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও নিয়েছেন তিনি, যা পরবর্তীতে সুপারসনিক ফ্লাইটের আবির্ভাবের দিকে নিয়ে গেছে বিশ্বকে।
স্বেতলানা সাভিতস্কায়া: ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে ইতিহাস গড়ার উনিশ বছর পর তার স্বদেশী স্বেতলানা সাভিতস্কায়া দ্বিতীয় নারী নভোচারী হয়ে ওঠেন এবং এর বাইরে আরো কিছু বিষয়ে তিনি পথ দেখিয়েছেন। ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো মহাকাশ ভ্রমণে যান সাভিতস্কায়া এবং তিনিই ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে ওই সময় স্পেস ওয়াক করেন। ‘স্যালিউট ৭’ মহাকাশ স্টেশনের বাইরে সাড়ে তিন ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন তিনি।

পেগি হুইটসন: ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস-এর প্রথম নারী কমান্ডার হন পেগি হুইটসন। এরপর ২০১৫ সালে আবারও আইএসএসের কমান্ডার হন তিনি। যেন একজন ব্যক্তির জন্য ইতিহাস তৈরির ক্ষেত্রে একবার যথেষ্ট নয়! ২০২২ সাল পর্যন্ত একজন আমেরিকান হিসেবে মহাকাশে দীর্ঘতম সময় কাটানোর রেকর্ডটিও ছিল হুইটসনের ঝুলিতে। তার বিস্ময়কর অর্জনের মধ্যে আরো রয়েছে মোট ৬৬৫ দিন মহাকাশে কাটানোর অভিজ্ঞতা। ২০০৮ সালে তার ‘সয়ুজ টিএমএ-১১’ মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশের সময় ক্ষতির মুখে পড়লেও অল্পের জন্য দুর্ঘটনা এড়াতে পেরেছিলেন হুইটসন। ফলে লক্ষ্যমাত্রার বাইরে চারশ ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করেছিল মহাকাশযানটি।
ই সো-ইয়ন: ২০০৮ সালে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান নারী হিসেবে মহাকাশে যান ই সো-ইয়ন। এ সময় আরো দুই রুশ মহাকাশচারীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণ করেন তিনি। আইএসএসে থাকাকালীন মহাকাশে ফলের মাছির আচরণ, শূন্য মাধ্যাকর্ষণে মুখ ফুলে ওঠার মতো ঘটনা ও পৃথিবীর আবহাওয়ার ধরন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন সো-ইয়ন।
ক্যাথরিন সালিভান: সাভিতস্কায়ার কয়েক মাস পরে ১৯৮৪ সালে প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে হেঁটেছিলেন ক্যাথরিন সালিভান। তার পরবর্তী মহাকাশ অভিযানও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এই মিশনেই হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষেপিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণে সহায়তা করেছিলেন সালিভান এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে সহায়তার জন্য অসংখ্যবার মহাকাশে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে অবসর নেওয়ার আগে মহাকাশে মোট পাঁচশ ৩২ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন সালিভান।

মে জেমিসন: যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার ডেকাটুরে জন্ম নেওয়া চিকিৎসক ও প্রকৌশলী মে জেমিসন ১৯৮৭ সালে নাসার নভোচারী প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হন। এর পাঁচ বছর পর মহাকাশে যাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হন তিনি। নাসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন গবেষক ছিলেন জেমিসন। তার মিশনের সময় মোশন সিকনেস থেকে শুরু করে হাড়ের কোষের গঠন পর্যন্ত সবকিছুর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। প্রথমবারের মতো মহাকাশে যাওয়ার পর নাসা থেকে পদত্যাগ করেন এবং মানবদেহের ‘সিকেল’ কোষ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছেন তিনি। বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য ‘স্টেম’ শিক্ষাকে আরো সহজ করার জন্যও সময় উৎসর্গ করেছিলেন জেমিসন।
চিয়াকি মুকাই: ১৯৯২ সালে জেমিসনের সঙ্গে একই মহাকাশ মিশনে ছিলেন চিয়াকি মুকাই, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে এক সহযোগিতামূলক মিশন। মহাকাশে যাওয়া প্রথম জাপানি নারীও তিনি। জাপানি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাক্সা’তে কাজের সময় মোট ২৯ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন তিনি। তখন থেকে একজন গবেষক হিসাবে সফল ও প্রভাবশালী কর্মজীবন পরিচালনা করেছেন মুকাই। ২০১৫ সালে ‘টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
লিউ ইয়াং: ২০১২ সালে প্রথম নারী হিসেবে ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভার ঐতিহাসিক মহাকাশ যাত্রার ৪৯তম বার্ষিকীতে প্রথম চীনা নারী হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছেড়ে ‘শেনঝু-৯’ মিশনে চীনের প্রথম মহাকাশ স্টেশন ‘তিয়ানগং-১’ এ যান লিউ ইয়াং। মহাকাশ যাত্রার সময় থেকেই চীনা বিমান বাহিনীর একজন মেজর ছিলেন তিনি। মহাকাশে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন দরকারি গবেষণাও পরিচালনা করেছিলেন ইয়াং।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

মহাকাশ অভিযান ও অনুসন্ধানে নারীদের ভূমিকা অবিচ্ছেদ্য

আপডেট সময় : ০৫:০৮:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মধ্যে রোমাঞ্চ ও বিস্ময়ের অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছে আকাশ আর তারা। প্রাচীন ধর্মযাজক ও ব্যাবিলনীয়রা তারার উপাসনা করতেন। গ্রিকরা এসবের মানচিত্র তৈরি করেছিলেন এবং তাদের বুঝতে শুরু করেছিলেন। তাদের বাইরেও মাটিতে যায় ঘটুক না কেন, মহাবিশ্বে কী ঘটছে; তা প্রত্যেকের মনেই জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। কিন্তু মহাকাশের আধুনিক গবেষণা ও অনুসন্ধানে নারীরা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রেখেছেন, দুঃখজনকভাবে তা অনেকেই মনে রাখেননি। এ বিষয় নিয়েই এবারের নারী ও শিশু পাতার প্রধান ফিচার
নারীরা কেবল মহাকাশ অভিযানেই যাননি, বরং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিও তাদের হাত ধরেই এসেছে। তারা মহাবিশ্বের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেসব নারীরা হলেন-

ক্যাথরিন জনসন: যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার শুরুর দিনগুলোতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদ ছিলেন ক্যাথরিন জনসন। নাসার পূর্বসূরি ‘এনএসিএ’তে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের একজনও ছিলেন তিনি। ১৯১৮ সালের ২৬ আগস্টে জন্মেছিলেন জনসন। ডিজিটাল কম্পিউটিং সময়েরও আগে নাসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ ছিলেন তিনি। অসংখ্য ঐতিহাসিক নাসা মিশনের কক্ষপথ ও গতিপথ ম্যানুয়ালি গণনা করেছিলেন জনসন। যার মধ্যে রয়েছে প্রথম আমেরিকান হিসেবে অ্যালান শেপার্ডের ঐতিহাসিক মহাকাশ মিশনও। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১৫ সালে তাকে সম্মান জানান প্রেসিডেন্সিয়াল মেডাল অফ ফ্রিডমের মাধ্যমে।

ডরোথি ভন: নাসার আরেকজন মূল সদস্য ও ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ ছিলেন ডরোথি ভন। ভার্জিনিয়ার ‘ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার’-এর কোনো বিভাগের সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারীও ছিলেন তিনি। ‘হিউম্যান কম্পিউটার’ হিসাবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ভন। ডিজিটাল কম্পিউটিংয়ের আবির্ভাবের মাধ্যমে নাসার হয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে ও তার গণিতবিদদের দল ‘ওয়েস্ট এরিয়া কম্পিউটার্স’কে কোডিং ভাষাও শিখিয়েছিলেন ভন।
মেরি উইনস্টন জ্যাকসন: নাসার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রকৌশলী ছিলেন ১৯২১ সালে জন্ম নেওয়া মেরি জ্যাকসন। সংস্থাটির সুপারভাইজার পদে প্রস্তাব পাওয়ার পরও তিনি স্বেচ্ছায় পদাবনতি গ্রহণ করেন, যা সুপারভাইজারের চেয়ে কম মর্যাদার হলেও নাসায় কর্মী নিয়োগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। এ ভূমিকায় নাসায় নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে ও আরো বেশি সংখ্যায় নারীদের নিয়োগ করতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে মারা যাওয়া জ্যাকসনকে মরণোত্তর ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’ দেওয়া হয়েছিল এবং তারই সম্মানে নাসার ওয়াশিংটন ডিসি সদর দপ্তরের নাম পরিবর্তন করে সংস্থাটি।
ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা: রাশিয়ান মহাকাশচারী ও টেক্সটাইল কারখানার সাবেক কর্মী ভ্যালেন্টিনা তেরেসকোভা ছিলেন মহাকাশে যাওয়া প্রথম নারী এবং ২০২২ সাল পর্যন্ত একক মহাকাশ মিশন চালানো সবচেয়ে কনিষ্ঠ নারীও। তিনি ১৯৬৩ সালের ৬ জুন মহাকাশে যান এবং ফিরে আসার আগে ৪৮ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেন। এরপর আর মহাকাশে না গেলেও মহাকাশ কর্মসূচিতে একজন প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করে গিয়েছেন তেরেসকোভা। ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার ‘জুকোভস্কি এয়ার ফোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাকাডেমি’ থেকে স্নাতক করেন তিনি।

স্যালি রাইড: তেরেস্কোভার মহাকাশে যাওয়ার প্রায় দুই দশক পর ১৯৮৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানী স্যালি রাইড প্রথম মার্কিন নারী হিসেবে মহাকাশে যান। ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের একমাত্র পরিচিত সদস্য ছিলেন যিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন। মহাকাশে ভ্রমণে প্রস্তুতির সময় সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সঙ্গী বাছাইয়ে নিজের পছন্দ গোপন রেখেছিলেন রাইড। তবে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী টেনিস খেলোয়াড় ট্যাম ও’শাগনেসিকে নিজের মৃত্যুর বাণীতে তাদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করার অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
কিটি জয়নার: কিটি জয়নার ১৯৩৯ সালে কেবল ‘এনএসিএ’-এর প্রথম নারী প্রকৌশলীই ছিলেন না, বরং ‘ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়া’র ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রাম থেকে স্নাতক হওয়া প্রথম নারীও ছিলেন জয়নার। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এনএসিএ ও নাসায় কাজ চালিয়ে গিয়েছেন জয়নার; যেখানে সংস্থাটির বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প তদারকি করার পাশাপাশি গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও নিয়েছেন তিনি, যা পরবর্তীতে সুপারসনিক ফ্লাইটের আবির্ভাবের দিকে নিয়ে গেছে বিশ্বকে।
স্বেতলানা সাভিতস্কায়া: ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভা প্রথম নারী হিসেবে মহাকাশে ইতিহাস গড়ার উনিশ বছর পর তার স্বদেশী স্বেতলানা সাভিতস্কায়া দ্বিতীয় নারী নভোচারী হয়ে ওঠেন এবং এর বাইরে আরো কিছু বিষয়ে তিনি পথ দেখিয়েছেন। ১৯৮৪ সালে দ্বিতীয়বারের মতো মহাকাশ ভ্রমণে যান সাভিতস্কায়া এবং তিনিই ইতিহাসের প্রথম নারী হিসেবে ওই সময় স্পেস ওয়াক করেন। ‘স্যালিউট ৭’ মহাকাশ স্টেশনের বাইরে সাড়ে তিন ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন তিনি।

পেগি হুইটসন: ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন বা আইএসএস-এর প্রথম নারী কমান্ডার হন পেগি হুইটসন। এরপর ২০১৫ সালে আবারও আইএসএসের কমান্ডার হন তিনি। যেন একজন ব্যক্তির জন্য ইতিহাস তৈরির ক্ষেত্রে একবার যথেষ্ট নয়! ২০২২ সাল পর্যন্ত একজন আমেরিকান হিসেবে মহাকাশে দীর্ঘতম সময় কাটানোর রেকর্ডটিও ছিল হুইটসনের ঝুলিতে। তার বিস্ময়কর অর্জনের মধ্যে আরো রয়েছে মোট ৬৬৫ দিন মহাকাশে কাটানোর অভিজ্ঞতা। ২০০৮ সালে তার ‘সয়ুজ টিএমএ-১১’ মহাকাশযানটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশের সময় ক্ষতির মুখে পড়লেও অল্পের জন্য দুর্ঘটনা এড়াতে পেরেছিলেন হুইটসন। ফলে লক্ষ্যমাত্রার বাইরে চারশ ৭৫ কিলোমিটার দূরে অবতরণ করেছিল মহাকাশযানটি।
ই সো-ইয়ন: ২০০৮ সালে প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান নারী হিসেবে মহাকাশে যান ই সো-ইয়ন। এ সময় আরো দুই রুশ মহাকাশচারীর সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণ করেন তিনি। আইএসএসে থাকাকালীন মহাকাশে ফলের মাছির আচরণ, শূন্য মাধ্যাকর্ষণে মুখ ফুলে ওঠার মতো ঘটনা ও পৃথিবীর আবহাওয়ার ধরন নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন সো-ইয়ন।
ক্যাথরিন সালিভান: সাভিতস্কায়ার কয়েক মাস পরে ১৯৮৪ সালে প্রথম আমেরিকান নারী হিসেবে মহাকাশে হেঁটেছিলেন ক্যাথরিন সালিভান। তার পরবর্তী মহাকাশ অভিযানও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ এই মিশনেই হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষেপিত হয়েছিল। ১৯৯০ সালে টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণে সহায়তা করেছিলেন সালিভান এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজে সহায়তার জন্য অসংখ্যবার মহাকাশে ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৩ সালে অবসর নেওয়ার আগে মহাকাশে মোট পাঁচশ ৩২ ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন সালিভান।

মে জেমিসন: যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামার ডেকাটুরে জন্ম নেওয়া চিকিৎসক ও প্রকৌশলী মে জেমিসন ১৯৮৭ সালে নাসার নভোচারী প্রোগ্রামের জন্য নির্বাচিত হন। এর পাঁচ বছর পর মহাকাশে যাওয়া প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হন তিনি। নাসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন গবেষক ছিলেন জেমিসন। তার মিশনের সময় মোশন সিকনেস থেকে শুরু করে হাড়ের কোষের গঠন পর্যন্ত সবকিছুর ওপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তিনি। প্রথমবারের মতো মহাকাশে যাওয়ার পর নাসা থেকে পদত্যাগ করেন এবং মানবদেহের ‘সিকেল’ কোষ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি করেছেন তিনি। বিশ্বজুড়ে শিশুদের জন্য ‘স্টেম’ শিক্ষাকে আরো সহজ করার জন্যও সময় উৎসর্গ করেছিলেন জেমিসন।
চিয়াকি মুকাই: ১৯৯২ সালে জেমিসনের সঙ্গে একই মহাকাশ মিশনে ছিলেন চিয়াকি মুকাই, যা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যে এক সহযোগিতামূলক মিশন। মহাকাশে যাওয়া প্রথম জাপানি নারীও তিনি। জাপানি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাক্সা’তে কাজের সময় মোট ২৯ দিন মহাকাশে কাটিয়েছেন তিনি। তখন থেকে একজন গবেষক হিসাবে সফল ও প্রভাবশালী কর্মজীবন পরিচালনা করেছেন মুকাই। ২০১৫ সালে ‘টোকিও ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
লিউ ইয়াং: ২০১২ সালে প্রথম নারী হিসেবে ভ্যালেন্তিনা তেরেস্কোভার ঐতিহাসিক মহাকাশ যাত্রার ৪৯তম বার্ষিকীতে প্রথম চীনা নারী হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছেড়ে ‘শেনঝু-৯’ মিশনে চীনের প্রথম মহাকাশ স্টেশন ‘তিয়ানগং-১’ এ যান লিউ ইয়াং। মহাকাশ যাত্রার সময় থেকেই চীনা বিমান বাহিনীর একজন মেজর ছিলেন তিনি। মহাকাশে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন দরকারি গবেষণাও পরিচালনা করেছিলেন ইয়াং।