বিশেষ সংবাদদাতা : ভারত বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার পর দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে আলোচনা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্তে পরিমাণে কম হলেও আর্থিক প্রভাব পড়তে পারে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের (আইটিসি) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত তিন বছরে ভারতের তৈরি পোশাক আমদানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল গড়ে ৪১ শতাংশের বেশি। ২০২২ সালে ভারত তৈরি পোশাক আমদানি করেছিল ১৭৩ কোটি ডলারের, যার মধ্যে ৭১ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য যায় বাংলাদেশ থেকে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালেও একই প্রবণতা বজায় ছিল। বিকেএমইএ ও বিজিএমইএ সূত্র বলছে, ভারতের বাজারে বাংলাদেশের নিট ও ওভেন পোশাকের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, মান এবং সরবরাহ সক্ষমতা এখনও আকর্ষণীয়। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের তৈরি পোশাক বাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য ক্রমেই সুসংহত হচ্ছে। আইটিসি-এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারত বিশ্ববাজার থেকে ১৭২ কোটি ৫৫ লাখ মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যায় ৭১ কোটি ৯ লাখ ডলারের পণ্য, যা ভারতের আমদানির ৪১.২০ শতাংশ। ২০২৩ সালে দেশটির আমদানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলারে, যার মধ্যে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ডলারের পোশাক যায় বাংলাদেশ থেকে— অর্থাৎ বাংলাদেশের অংশীদারত্ব ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশ। ২০২৪ সালে ভারতের মোট তৈরি পোশাক আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫৪ কোটি ৫৮ লাখ মিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৬৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ, দখলে রাখে ৪১ শতাংশ বাজার। অর্থাৎ তিন বছর ধরেই ৪০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের জন্য এটি একটি বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রতিফলন।
ভারতের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় বাজারে আমাদের পণ্যের প্রতি আগ্রহ আগামী দিনে আরও সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করছে।’ তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল সরাসরি পোশাক রফতানিতে প্রভাব না ফেললেও এটি দুই দেশের ব্যবসায়িক আস্থায় ঘাটতি তৈরি করতে পারে। ভবিষ্যতে স্থায়ী ও নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক আস্থা জরুরি। অপরদিকে ইপিবির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ১৭ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে ৪৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার, যা এই সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের মতো বিশাল বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমাগত বাড়ছে, যা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার পরিধিকে বিস্তৃত করছে। বিকেএমইএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ভারতে আমাদের পোশাকের ভালো বাজার তৈরি হয়েছে। একসময় রফতানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, পরে কিছুটা হোঁচট খেলেও আবার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। এই গতি ধরে রাখতে হলে কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে।’ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতকে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ২১৩ কোটি ডলার, যা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তবে পরের অর্থবছরে কিছুটা ভাটা পড়ে রপ্তানি কমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ ডলারে।
ভারতের সড়ক ব্যবহার করে ৩৬ দেশে পোশাক রফতানি
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ এই ১৫ মাসে ভারতের সড়ক ব্যবহার করে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩৬টি দেশে রফতানি করেছে প্রায় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার পণ্য। এতে ডলার হিসাবে আয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, প্রতি মাসে গড়ে ৩৭৬ কোটি টাকা রফতানি করতো বাংলাদেশ। এই পণ্য পরিবহন হয়েছে ট্রাকযোগে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিভিন্ন বন্দর এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে। তবে সম্প্রতি ভারত হঠাৎ করে এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে, যার ফলে অনিশ্চয়তায় পড়েছে এই রফতানি কার্যক্রম। শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করলে ঢাকার চেয়ে প্রতি কেজিতে ৫০ সেন্ট থেকে ১ ডলার পর্যন্ত খরচ কম হতো। সেই সঙ্গে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরের বুকিং জট এড়ানো যেতো। ফলে ভারত এই সুবিধা বাতিল করায় বিকল্প পথ হারিয়ে পোশাক রফতানিতে নতুন চাপ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার ৯০৯ মেট্রিক টন, যার বাজারমূল্য ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা এবং মার্কিন ডলারে ৪৬২ মিলিয়ন ডলার। এই তথ্যটি বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক পণ্যের ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রফতানির (ট্রান্সশিপমেন্ট) চিত্র তুলে ধরেছে। এই রফতানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে সড়কপথে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতের পেট্রাপোল হয়ে বিভিন্ন দেশের গন্তব্যে পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল থেকে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে সড়কপথে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানোর সুযোগ দেয়। বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০১৮ থেকে এ পর্যন্ত ৬২৪টি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা ব্যবহার করে প্রায় ৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। এর মধ্যে ৬০৬টি প্রতিষ্ঠান পোশাক খাতভুক্ত।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বেনাপোল কাস্টমসের তথ্য অনুসারে, গত বছর কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে ৪৪ হাজার টনের পণ্য রফতানি হয়েছে। এখন এই পুরো চাপ শাহজালাল বিমানবন্দরে পড়বে, যার জন্য বাড়তি প্রায় ৭৩০টি ফ্লাইট প্রয়োজন হবে। এতে ইউরোপ-আমেরিকার রুটে পরিবহন খরচ ও জট দুই-ই বাড়তে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখন বড় এক পরীক্ষার মুখে। ভারত হয়ে রফতানির বিকল্প পথ যদি কার্যকর না থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় দ্রুত কূটনৈতিক পদক্ষেপ এবং বিকল্প রফতানি রুট খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি। এদিকে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করলেও এতে বড় কোনও সমস্যা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা দিয়ে দ্রুত এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠবো।’ জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, বিশেষ করে নারীদের ব্লাউজ, ব্রিফস, প্যান্টি, স্কার্ট, প্যান্ট, কোট, জামাকাপড়সহ নানা ধরনের পণ্য ভারত হয়ে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বৈশ্বিক বাজারে পৌঁছাচ্ছিল। নারীদের ও পুরুষদের পোশাকের পাশাপাশি, শিশুদের পোশাক, ট্র্যাকস্যুট, স্নিগ্ধতর পোশাক এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক। বাংলাদেশের এই পোশাক রফতানির গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, চিলি, চীন, কলম্বিয়া, জার্মানি, ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, নেপাল, ফিলিপাইনস, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র এবং দক্ষিণ আফ্রিকা।
চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সুবিধা নিচ্ছে ভারত
২০২০ সালের ২৯ জুন ভারত ‘ব্যবসা সহজীকরণ’ নীতির আওতায় বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয়। কিন্তু গত ৯ এপ্রিল ভারতের সিবিআইসি আকস্মিকভাবে ওই সুবিধা বাতিল করে। কিন্তু বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি এখনও বলবৎ আছে ভারতের জন্য। ২০১৮ সালের চুক্তির আওতায় ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি আদেশ জারির মাধ্যম ভারতের আমদানি-রফতানিকারকরা এ সুবিধা পাচ্ছেন।
বাণিজ্য ঘাটতি
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিবছর ভারতে ২ বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য রফতানি করলেও আমদানি করে প্রায় ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারতে বাংলাদেশের বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে পণ্য আমদানি করে প্রায় ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ভারতের বাজারে রফতানি করেছে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। রফতানি পণ্যের মধ্যে তৈরি পোশাক, পাটজাত পণ্য, চামড়া ও প্লাস্টিক সামগ্রী রয়েছে। অন্যদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আসছে প্রধানত চাল, গম, নানা প্রকার কৃষিপণ্য, অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য।