বিল্লাল বিন কাশেম : গত কিছুদিনে বাংলাদেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে দোকানপাট, নামিদামি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে হামলা চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা বলেছে, তারা ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্দোলন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- এই হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও সহিংসতা স্বাধীন ফিলিস্তিনের কল্পিত বিজয়ের কোনো অংশ নয়; বরং এটি নৃশংসতা, অসভ্যতা এবং অপরাধ প্রবণতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
একটি স্বাধীন জাতির জন্য সমর্থন জানানো এক কথা। কিন্তু সেই সমর্থনের নামে যদি কারও দোকানপাট ভাঙা হয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা শ্রমজীবী মানুষের জীবিকায় আঘাত হানা হয়, তাহলে সেটা আন্দোলন নয়, সেটা ডাকাতি। এটাকে লুটপাট, চাঁদাবাজি, ভ্রান্ত চেতনার ধ্বংসাত্মক দানবীয় উন্মাদনা ছাড়া কিছুই বলা চলে না।
‘প্যালেস্টাইন’ নিয়ে ভুয়া আবেগের রাজনীতি: বাংলাদেশের মানুষ ফিলিস্তিনের প্রতি সহানুভূতিশীল, এটা সত্যি। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনের পাশে ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন সরকার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। তাই জনগণের মাঝে ফিলিস্তিন নিয়ে যে আবেগ, তা কৃত্রিম নয়। কিন্তু সমস্যার শুরু তখন, যখন কিছু চিহ্নিত উগ্রবাদী গোষ্ঠী; কিছু কিশোর অপরাধী ও ছদ্মবেশী ধর্মীয় ব্যবসায়ী এই আবেগকে ব্যবহার করে নিজেদের অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারা দোকানপাটে হামলা চালিয়ে বলে, ‘আমরা জিয়াদার পক্ষে’ বা ‘আমরা গাজা রক্ষায় আন্দোলন করছি।’ অথচ বাস্তবতা হলো, বাটার দোকান ভাঙলে গাজার শিশুরা খাবার পাবে না। কেএফসির কর্মীদের গালাগালি দিলে গাজার নারীরা সুরক্ষিত হবে না। এখানে ফিলিস্তিনের নামে শুধু নিজের ভেতরের লুণ্ঠন প্রবণতা, অপকর্ম ও সহিংস চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে।
দোকানপাটে হামলা বৈধ না, বোধগম্যও না: যে কেএফসি বা পিজ্জা হাটে হামলা চালানো হচ্ছে, তার বেশিরভাগ মালিকই বাংলাদেশি। ব্র্যান্ডটি বিদেশি হলেও ফ্র্যাঞ্চাইজিটি বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগে পরিচালিত হচ্ছে। সেখানে কাজ করেন আমাদের দেশের তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী, নিম্নবিত্ত কর্মজীবী মানুষ। একজন ডেলিভারি ম্যান যখন রিকশায় খাবার পৌঁছে দেয়, সে ফিলিস্তিন বা ইসরায়েল বোঝে না—সে বোঝে তার প্রতিদিনের আয়। অথচ সেই ডেলিভারিম্যানকেই হেনস্তা করে, রেস্টুরেন্টে আগুন লাগিয়ে বা জানালা ভেঙে এই তথাকথিত ফিলিস্তিনপন্থীরা নিজেদের কাজকে মহৎ বলে চালাতে চায়। এর নাম কি আন্দোলন? না, এ হলো বেপরোয়া হিংস্রতার অপর নাম। যে আন্দোলনে সাধারণ মানুষের জানমাল নিরাপদ নয়, যে প্রতিবাদ অন্যায়ভাবে সহিংসতা ও লুণ্ঠনের রূপ নেয়, সেটা আর আন্দোলন থাকে না— সেটা হয় নিছক ভাঙচুর, যাকে রাষ্ট্রীয় আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
ফিলিস্তিনের ইস্যু এক, আমাদের বোধভূমি আরেক: ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলি হামলা মানবতাবিরোধী। সেখানে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটছে, শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে, হাসপাতাল ধ্বংস হচ্ছে —তাতে আমরা স্তব্ধ ও ক্ষুব্ধ, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই ক্ষোভ যদি আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো, শান্তিপূর্ণ শহুরে পরিবেশ, অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দেয়, তাহলে এটা আত্মঘাতী।
আজ যারা কেএফসি ভাঙছে, কাল তারা স্কুল ভাঙবে। আজ যারা জুতা বা কাপড়ের দোকানে আগুন লাগাচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো না কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ইস্যুকে সামনে এনে ব্যাংকে ঢুকবে, হাসপাতালের ওষুধের দোকানে লুট চালাবে। এই প্রবণতা আজই থামাতে হবে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
ইসলাম কখনো চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠনের পক্ষ নেয়নি: এই কথিত আন্দোলনকারীরা মাঝে মাঝে ধর্মের নামে সেøাগান দেয়। অথচ ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন এক বিন্দু রক্তপাতও ঘটাননি। যারা অন্যের সম্পদ দখল করে, অন্যকে কষ্ট দেয়, অন্যায়ভাবে হামলা চালায়; তারা ইসলাম ও মানবতার শত্রু। ইসলাম লুণ্ঠন ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। যারা ধর্মের নামে পাপাচার করছে, তারা আসলে ইসলামকেই কলুষিত করছে। তারা ইসরায়েলের বিরোধিতা নয়, বরং ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিচ্ছবি। তারা সভ্যতার পক্ষে নয়, বরং বর্বরতার প্রতিনিধি।
রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্ব: সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। যারা এ ধরনের সহিংসতায় জড়িত, তাদের শনাক্ত করে দ্রুত বিচার করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ছত্রছায়ায় এই অপরাধীদের রক্ষা করা হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। সামাজিকভাবে আমাদের সচেতন হতে হবে- কোনো আন্দোলনের নামে অরাজকতা আমরা বরদাস্ত করবো না।
মুসলিম বিশ্বে বহু সময় আন্দোলন হয়েছে- তিউনিসিয়ার জেসমিন রেভোলিউশন, মিসরের তাহরির স্কয়ার, ইরানে হিজাব-বিরোধী প্রতিবাদ—কিন্তু কোথাও নিজ দেশে নিজেদের দোকানপাট লুট করা হয়নি। এটা শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব, যেখানে ধর্মীয় আবেগ ও রাজনৈতিক ফায়দা একত্রে লুণ্ঠনের লাইসেন্সে পরিণত হয়।
ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর সঠিক পথ: ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়াতে হলে সচেতন কূটনৈতিক অবস্থান নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের কণ্ঠ জোরালো হতে হবে। মানবিক সহায়তা পাঠানো যেতে পারে। ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্কলারশিপ চালু করা যেতে পারে। বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো ফান্ড গঠন করে সাহায্য পাঠাতে পারে। কিন্তু সেটা অবশ্যই শান্তিপূর্ণ, গঠনমূলক এবং মানবিক হবে- লুণ্ঠন নয়।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা জাতির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের উপায় কখনোই ঘরের ভেতরে আগুন দেওয়া নয়। বাংলাদেশে বসে, বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষতি করে কেউ ফিলিস্তিনের মুক্তি এনে দিতে পারবে না। বরং এই ধরনের তাণ্ডব আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে অস্থিতিশীল করবে, যো ইসরায়েলকেই খুশি করবে, ফিলিস্তিনকে নয়। তাই এই কথিত ‘আন্দোলনকারীদের’ আসল চেহারা আমাদের চিনে নিতে হবে। এরা আন্দোলনকারী নয়—এরা সুযোগসন্ধানী লুণ্ঠনকারী, যারা মানবিকতার মুখোশ পরে নৃশংসতা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রকে কঠোর হাতে তাদের দমন করতে হবে।
আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ চাই- দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়ার উন্মাদনা নয়।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট