ঢাকা ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় মৃত্যুর মিছিলে

  • আপডেট সময় : ০৬:৫১:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫
  • ৭৭ বার পড়া হয়েছে

চলন্ত ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে ভিডিও বানানোর সময় পড়ে গিয়ে এই চার তরুণের দুই জন নিহত হয়েছেন। ছবি: রেলওয়ে পুলিশের সৌজন্যে

জান্নাতুল রুহী : ঈদের ছুটিতে প্রতিবছরই সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সড়ক, লঞ্চ কিংবা ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের খবর। এবছরও এটার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি, এক চট্টগ্রামের লোহাগাড়াতেই তিন দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৫ জন। সুতরাং এই মৃত্যু সংবাদটা অনেকটাই যেন অভ্যস্ত ব্যাপার! এই রুটিন ঘটনার আড়ালে যে ঘটনাটা উঁকি দিচ্ছিল সেটা ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় পড়ে গিয়ে দুই তরুণের নিহত হওয়ার খবর। সংবাদটা পড়ে আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠে! ঘটনাটা মোটেও নতুন নয়, বরং এটাও ওই ‘রুটিন সংবাদ’ হয়ে যাওয়ার পথে যাচ্ছে।

বিভিন্ন মিডিয়া থেকে জানা যায়, ঘটনাটা ছিল এরকম যে, গত ২ এপ্রিল সিলেটগামী পাহাড়িকা নামের ট্রেনটি আখাউড়ার মোগড়া রেলওয়ে সেতু এলাকায় পৌঁছালে ট্রেনের যাত্রীবাহী একটি বগির ছাদে থাকা চার তরুণ উঠে দাঁড়ান এবং টিকটক ভিডিও বানাতে শুরু করেন। তিনজন মিলে একজনের ভিডিও করছিলেন। এ সময় রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া তারে জড়িয়ে চার তরুণ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যান। প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় ভয়ডরহীন দুই তরুণ মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিলেন। আর বাকি দুজনের একজনকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়, অন্যজনের খবর সংবাদকর্মীরা নিশ্চিত হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ওই পরিণতি কি হয়েছে, জানা গেল না।

চারজনের কারোরই শিক্ষাগত কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, তাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর, অর্থাৎ তাদের জন্ম সাল ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে। অর্থাৎ প্রজন্মের বিবেচনায় তারা জুমারস্ বা প্রজন্ম জেড। বলা বাহুল্য যে, নতুন প্রযুক্তির কিছুই তাদের কাছে ‘নতুন’ না। কারণ তারা এটার মধ্যে দিয়েই বেড়ে উঠছিলেন। আমার প্রথম প্রশ্ন এখানেই, যে প্রজন্ম জন্মের পর থেকে প্রথমে পরিবারের মধ্যে, তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তিগুলোকে বিভিন্ন প্রয়োজনে দৈনন্দিন ব্যবহার হতে দেখে আসছেন, কেন তাদের এই নতুন প্রযুক্তির নতুন পরিবেশ নিয়ে যথার্থভাবে জানানো হয়নি, কিংবা এখনও হয় না?

দ্বিতীয়ত, আখাউড়ার ঘটনা থেকে চার তরুণের মনস্তত্ত্বের দুটো দিক লক্ষ্য করা যায়: ১. প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা; ২. আকাঙ্ক্ষা পূরণে অত্যন্ত সাহসিকতা। আমার মনে প্রশ্ন আসে, মননের গহীনের এই দুই বৈশিষ্ট্যকে উসকে দিয়ে জীবন বিপন্ন করে যে ভিডিওটা তারা তৈরি করছিলেন, এ ধরনের ভিডিও কেন টিকটক তাদের নীতিমালা দিয়ে আপলোডের সময়ই বাতিল করে না?

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রজন্ম জেডের জন্ম সাল ১৯৯৭ থেকে ২০১২। এর অর্থ হলো, তারাই ইন্টারনেট, সামাজিক মিডিয়া, স্মার্ট ফোন এবং অন্যান্য সকল ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম। এবং এসব উপাদান সম্মিলিতভাবে তাদের বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণকে আকার দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, তারা নতুন মিডিয়ার দ্বি-মুখী যোগাযোগের অনন্য এক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম। মূলত মিডিয়ার বৈশিষ্ট্যগত এই পরিবর্তন স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তিকে কোনো ধরনের ফিল্টার ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করা সুযোগ করে দেয়। এই পরিবর্তনটাই সমাজকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে।

আমরা অভিভাবকরা লক্ষ্য করলাম, এর ইতিবাচক দিকগুলো দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করে ফেলল। শিক্ষক আর অভিভাবকের মধ্যকার দূরত্ব কাটিয়ে ক্রমেই তাদের মধ্যে একধরনের যোগাযোগ গড়ে উঠল। বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ তৈরি করে প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া শুরু করল। এরপর থেকে যে কোনো ধরনের একাডেমিক সমস্যা অভিভাবকরা শিক্ষকদের সঙ্গে যে কোনো সময় শেয়ার করতে পারছেন, একই সঙ্গে শিক্ষকরাও তাদের বিভিন্ন নোটিশ দ্রুতবেগে অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে পারছেন। প্রজন্ম জেডের কাছে এই পরিবেশ নতুন না। এটাই তাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’ পরিবেশ।

কিন্তু এর পাশে নতুন মিডিয়ার সঙ্গে, নতুন মিডিয়ার প্রভাবে পরিবর্তিত নতুন সমাজের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করার কোনো ধরনের ব্যবস্থা আমরা দেখিনি, এখনও দেখছি না। নতুন এই পরিবেশের সঙ্গে শিশুদের সরাসরি সম্পর্কের দিকটাও কেন স্বাভাবিক করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো না? ক্রমান্বয়ে এটাকে কেন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করে শিশু বয়স থেকেই তাদের মননে ভিত গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না? বছর বছর পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করলেও এখন পর্যন্তও আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি না, প্রশ্ন তুলি না, আলোচনাও করি না। বয়সভেদে প্রতিবছর বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোতে নতুন মিডিয়া-সংক্রান্ত একটা করে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে শ্রেণীকক্ষে পাঠ করালে শিশুদের পক্ষে অলৌকিক কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবতার পরিস্থিতি বোঝা সহজ হয়, স্বাভাবিক হয়।

অনলাইন প্লাটফর্মের অ্যাপ টিকটকের পাতা থেকে জানা গেল, তাদের উদ্দেশ্য হলো সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করা এবং আনন্দিত করা। উদাহরণ হিসেবে তারা তাদের সাইটে যে ১৮টি ছোট ছোট ভিডিও দিয়ে রেখেছে, তার প্রত্যেকটিতেই এই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। অথচ যারা এর ব্যবহারকারী এবং যারা প্রতিনিয়ত এখানে ভিডিও শেয়ার করছেন, তাদের ভিডিওগুলোতে কি আদৌ এই উদ্দেশ্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়?

ইতোমধ্যে ২০২১ সালে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে এই অ্যাপ বন্ধ করা হয়েছিল। হাইকোর্টের রিটে বলা হয়েছিল, “টিকটকের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের শিশু-কিশোর এবং যুবসমাজ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি নারী পাচারের ঘটনা এবং দেশের বাইরে টিকটক, লাইকি ও বিগো লাইভের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, দেশের জনস্বার্থ শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।” রিটের এই অভিযোগ থেকে বোঝা যায়, টিকটকের পর্নো ভিডিও, সহিংস ভিডিও প্রভৃতি ধরনের ভিডিওও আপলোড হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ছাড়াই এটা বোঝা যায় যে, এগুলোর কোনোটাই টিকটকের নিজের উদ্দেশ্যের ধারক নয়। তাহলে এই ভিডিওগুলো কেন এই অ্যাপে আপলোড হচ্ছে?

আর কোনো ধরনের ফিল্টারিং ছাড়াই এভাবে ভিডিও আপলোড করার ফলে মানুষের ‘দেখাতে চাওয়ার মানসিকতা’কে ক্রমশ উসকে দেওয়া হচ্ছে। মনোযোগ আকর্ষণ করার আচরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ সবসময়ই অন্যের কাছে থেকে নিজের সম্পর্কে একধরনের বৈধতা চায় যেটা তাকে নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মানুষের এই আচরণগত দিক যখন কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয় তখন মানুষের মনের গহীনের বন্যতা জাগ্রত হয়। সৃজনশীলতা আর আনন্দ প্রদানের আড়ালে টিকটক মানুষের ভেতরের এই বন্যতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে।

কোনো মাধ্যম বন্ধ করা কিংবা নিষিদ্ধ করাকে আমি মোটেও সমর্থন করি না। কারণ, প্রতিটা সৃষ্টির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক অবশ্যই থাকবে এবং সেটা বিবেচনা করেই আমাদেরকে এগুলো ব্যবহার করতে হবে। মূলধারার মিডিয়ায় চর্চিত হওয়া বহু সমালোচিত একটা তত্ত্ব গেটকিপিং। গেটকিপিং ‘আরোপিত’ ও ‘পক্ষপাতমূলক’ হিসেবে সমালোচিত হলেও বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় টিকটকের জন্য গেটকিপারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

গেটকিপার আসলে কি? সহজভাষায় গেটকিপার হলেন কোন তথ্য গেট দিয়ে গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো উচিত এবং কোন তথ্য তাদের কাছে পৌঁছানো উচিত নয়–তার নির্ধারক। অর্থাৎ তারা সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থায় তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত তথ্য ফিল্টারিংয়ের কাজ করা হয়। ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন রুটিন, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে তারা নির্দিষ্ট তথ্য তাদের অডিয়েন্সের কাছে প্রেরণ করতে দেন। জার্মান মনোবিজ্ঞানী কার্ট লেউইন সর্বোপ্রথম এই প্রক্রিয়াটির কথা বলেছিলেন। এরপর ১৯৯১ সালে আমেরিকার সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগের শিক্ষক পামেলা জে শুমেখার মডেলটি নিয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছিলেন। টিকটকের কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে গেটকিপার তত্ত্বটা কীভাবে এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে– এটা নিয়ে আলোচনা উঠানো যেতে পারে।

সামাজিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন সাংস্কৃতিক বিভাজনগুলো ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এরপরও কিছু বিভেদকে গুরুত্ব দিয়ে, আঞ্চলিকভাবে টিকটকের কার্যক্রমকে ভাগ করে, খুবই ভালো হয়, বাংলাদেশে তাদের একটা স্থানীয় অফিস করা এবং সেখানে একটা বিশেষজ্ঞ দলের নিয়োগ দেওয়া। তাদের কাজই হবে, শুধু টিকটকের উদ্দেশ্যকে দেশীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভিডিওগুলোই আপলোড করা। এতে করে দেশে সংগঠিত অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা, অনেক আবেগনির্ভর মৃত্যুকে রোধ করা যাবে। আখাউড়ার মতো ঘটনা যেন মিডিয়ার রুটিন খবর না হয়ে উঠে– সেই ব্যবস্থাটা এখনই নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় মৃত্যুর মিছিলে

আপডেট সময় : ০৬:৫১:১৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫

জান্নাতুল রুহী : ঈদের ছুটিতে প্রতিবছরই সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সড়ক, লঞ্চ কিংবা ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের খবর। এবছরও এটার কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি, এক চট্টগ্রামের লোহাগাড়াতেই তিন দুর্ঘটনায় মারা গেছে ১৫ জন। সুতরাং এই মৃত্যু সংবাদটা অনেকটাই যেন অভ্যস্ত ব্যাপার! এই রুটিন ঘটনার আড়ালে যে ঘটনাটা উঁকি দিচ্ছিল সেটা ছিল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় চলন্ত ট্রেনের ছাদে দাঁড়িয়ে টিকটক ভিডিও বানানোর সময় পড়ে গিয়ে দুই তরুণের নিহত হওয়ার খবর। সংবাদটা পড়ে আমার ভেতরটা খাঁ খাঁ করে উঠে! ঘটনাটা মোটেও নতুন নয়, বরং এটাও ওই ‘রুটিন সংবাদ’ হয়ে যাওয়ার পথে যাচ্ছে।

বিভিন্ন মিডিয়া থেকে জানা যায়, ঘটনাটা ছিল এরকম যে, গত ২ এপ্রিল সিলেটগামী পাহাড়িকা নামের ট্রেনটি আখাউড়ার মোগড়া রেলওয়ে সেতু এলাকায় পৌঁছালে ট্রেনের যাত্রীবাহী একটি বগির ছাদে থাকা চার তরুণ উঠে দাঁড়ান এবং টিকটক ভিডিও বানাতে শুরু করেন। তিনজন মিলে একজনের ভিডিও করছিলেন। এ সময় রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া তারে জড়িয়ে চার তরুণ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যান। প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষায় ভয়ডরহীন দুই তরুণ মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিলেন। আর বাকি দুজনের একজনকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হয়, অন্যজনের খবর সংবাদকর্মীরা নিশ্চিত হতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ওই পরিণতি কি হয়েছে, জানা গেল না।

চারজনের কারোরই শিক্ষাগত কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, তাদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছর, অর্থাৎ তাদের জন্ম সাল ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে। অর্থাৎ প্রজন্মের বিবেচনায় তারা জুমারস্ বা প্রজন্ম জেড। বলা বাহুল্য যে, নতুন প্রযুক্তির কিছুই তাদের কাছে ‘নতুন’ না। কারণ তারা এটার মধ্যে দিয়েই বেড়ে উঠছিলেন। আমার প্রথম প্রশ্ন এখানেই, যে প্রজন্ম জন্মের পর থেকে প্রথমে পরিবারের মধ্যে, তারপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তিগুলোকে বিভিন্ন প্রয়োজনে দৈনন্দিন ব্যবহার হতে দেখে আসছেন, কেন তাদের এই নতুন প্রযুক্তির নতুন পরিবেশ নিয়ে যথার্থভাবে জানানো হয়নি, কিংবা এখনও হয় না?

দ্বিতীয়ত, আখাউড়ার ঘটনা থেকে চার তরুণের মনস্তত্ত্বের দুটো দিক লক্ষ্য করা যায়: ১. প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা; ২. আকাঙ্ক্ষা পূরণে অত্যন্ত সাহসিকতা। আমার মনে প্রশ্ন আসে, মননের গহীনের এই দুই বৈশিষ্ট্যকে উসকে দিয়ে জীবন বিপন্ন করে যে ভিডিওটা তারা তৈরি করছিলেন, এ ধরনের ভিডিও কেন টিকটক তাদের নীতিমালা দিয়ে আপলোডের সময়ই বাতিল করে না?

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রজন্ম জেডের জন্ম সাল ১৯৯৭ থেকে ২০১২। এর অর্থ হলো, তারাই ইন্টারনেট, সামাজিক মিডিয়া, স্মার্ট ফোন এবং অন্যান্য সকল ডিজিটাল প্রযুক্তির মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম। এবং এসব উপাদান সম্মিলিতভাবে তাদের বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণকে আকার দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, তারা নতুন মিডিয়ার দ্বি-মুখী যোগাযোগের অনন্য এক পরিবেশের মধ্যে বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম। মূলত মিডিয়ার বৈশিষ্ট্যগত এই পরিবর্তন স্বতন্ত্র একজন ব্যক্তিকে কোনো ধরনের ফিল্টার ছাড়াই নিজেকে প্রকাশ করা সুযোগ করে দেয়। এই পরিবর্তনটাই সমাজকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সামনে ফেলে।

আমরা অভিভাবকরা লক্ষ্য করলাম, এর ইতিবাচক দিকগুলো দ্রুতই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করে ফেলল। শিক্ষক আর অভিভাবকের মধ্যকার দূরত্ব কাটিয়ে ক্রমেই তাদের মধ্যে একধরনের যোগাযোগ গড়ে উঠল। বিভিন্ন ধরনের গ্রুপ তৈরি করে প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া শুরু করল। এরপর থেকে যে কোনো ধরনের একাডেমিক সমস্যা অভিভাবকরা শিক্ষকদের সঙ্গে যে কোনো সময় শেয়ার করতে পারছেন, একই সঙ্গে শিক্ষকরাও তাদের বিভিন্ন নোটিশ দ্রুতবেগে অভিভাবকদের জানিয়ে দিতে পারছেন। প্রজন্ম জেডের কাছে এই পরিবেশ নতুন না। এটাই তাদের কাছে ‘স্বাভাবিক’ পরিবেশ।

কিন্তু এর পাশে নতুন মিডিয়ার সঙ্গে, নতুন মিডিয়ার প্রভাবে পরিবর্তিত নতুন সমাজের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করার কোনো ধরনের ব্যবস্থা আমরা দেখিনি, এখনও দেখছি না। নতুন এই পরিবেশের সঙ্গে শিশুদের সরাসরি সম্পর্কের দিকটাও কেন স্বাভাবিক করে গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো না? ক্রমান্বয়ে এটাকে কেন পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করে শিশু বয়স থেকেই তাদের মননে ভিত গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না? বছর বছর পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করলেও এখন পর্যন্তও আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবি না, প্রশ্ন তুলি না, আলোচনাও করি না। বয়সভেদে প্রতিবছর বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তকগুলোতে নতুন মিডিয়া-সংক্রান্ত একটা করে অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করে শ্রেণীকক্ষে পাঠ করালে শিশুদের পক্ষে অলৌকিক কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবতার পরিস্থিতি বোঝা সহজ হয়, স্বাভাবিক হয়।

অনলাইন প্লাটফর্মের অ্যাপ টিকটকের পাতা থেকে জানা গেল, তাদের উদ্দেশ্য হলো সৃজনশীলতাকে অনুপ্রাণিত করা এবং আনন্দিত করা। উদাহরণ হিসেবে তারা তাদের সাইটে যে ১৮টি ছোট ছোট ভিডিও দিয়ে রেখেছে, তার প্রত্যেকটিতেই এই উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়। অথচ যারা এর ব্যবহারকারী এবং যারা প্রতিনিয়ত এখানে ভিডিও শেয়ার করছেন, তাদের ভিডিওগুলোতে কি আদৌ এই উদ্দেশ্যের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়?

ইতোমধ্যে ২০২১ সালে তিন মাসের জন্য বাংলাদেশে এই অ্যাপ বন্ধ করা হয়েছিল। হাইকোর্টের রিটে বলা হয়েছিল, “টিকটকের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে দেশের শিশু-কিশোর এবং যুবসমাজ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে। দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি নারী পাচারের ঘটনা এবং দেশের বাইরে টিকটক, লাইকি ও বিগো লাইভের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক, দেশের জনস্বার্থ শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।” রিটের এই অভিযোগ থেকে বোঝা যায়, টিকটকের পর্নো ভিডিও, সহিংস ভিডিও প্রভৃতি ধরনের ভিডিওও আপলোড হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ছাড়াই এটা বোঝা যায় যে, এগুলোর কোনোটাই টিকটকের নিজের উদ্দেশ্যের ধারক নয়। তাহলে এই ভিডিওগুলো কেন এই অ্যাপে আপলোড হচ্ছে?

আর কোনো ধরনের ফিল্টারিং ছাড়াই এভাবে ভিডিও আপলোড করার ফলে মানুষের ‘দেখাতে চাওয়ার মানসিকতা’কে ক্রমশ উসকে দেওয়া হচ্ছে। মনোযোগ আকর্ষণ করার আচরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ সবসময়ই অন্যের কাছে থেকে নিজের সম্পর্কে একধরনের বৈধতা চায় যেটা তাকে নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। মানুষের এই আচরণগত দিক যখন কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয় তখন মানুষের মনের গহীনের বন্যতা জাগ্রত হয়। সৃজনশীলতা আর আনন্দ প্রদানের আড়ালে টিকটক মানুষের ভেতরের এই বন্যতাকেই প্রশ্রয় দিচ্ছে।

কোনো মাধ্যম বন্ধ করা কিংবা নিষিদ্ধ করাকে আমি মোটেও সমর্থন করি না। কারণ, প্রতিটা সৃষ্টির ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক অবশ্যই থাকবে এবং সেটা বিবেচনা করেই আমাদেরকে এগুলো ব্যবহার করতে হবে। মূলধারার মিডিয়ায় চর্চিত হওয়া বহু সমালোচিত একটা তত্ত্ব গেটকিপিং। গেটকিপিং ‘আরোপিত’ ও ‘পক্ষপাতমূলক’ হিসেবে সমালোচিত হলেও বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় টিকটকের জন্য গেটকিপারের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।

গেটকিপার আসলে কি? সহজভাষায় গেটকিপার হলেন কোন তথ্য গেট দিয়ে গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে পৌঁছানো উচিত এবং কোন তথ্য তাদের কাছে পৌঁছানো উচিত নয়–তার নির্ধারক। অর্থাৎ তারা সমগ্র সামাজিক ব্যবস্থায় তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত তথ্য ফিল্টারিংয়ের কাজ করা হয়। ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতা, দৈনন্দিন রুটিন, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে তারা নির্দিষ্ট তথ্য তাদের অডিয়েন্সের কাছে প্রেরণ করতে দেন। জার্মান মনোবিজ্ঞানী কার্ট লেউইন সর্বোপ্রথম এই প্রক্রিয়াটির কথা বলেছিলেন। এরপর ১৯৯১ সালে আমেরিকার সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগের শিক্ষক পামেলা জে শুমেখার মডেলটি নিয়ে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছিলেন। টিকটকের কাঠামো বিবেচনায় নিয়ে গেটকিপার তত্ত্বটা কীভাবে এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে– এটা নিয়ে আলোচনা উঠানো যেতে পারে।

সামাজিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন সাংস্কৃতিক বিভাজনগুলো ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এরপরও কিছু বিভেদকে গুরুত্ব দিয়ে, আঞ্চলিকভাবে টিকটকের কার্যক্রমকে ভাগ করে, খুবই ভালো হয়, বাংলাদেশে তাদের একটা স্থানীয় অফিস করা এবং সেখানে একটা বিশেষজ্ঞ দলের নিয়োগ দেওয়া। তাদের কাজই হবে, শুধু টিকটকের উদ্দেশ্যকে দেশীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভিডিওগুলোই আপলোড করা। এতে করে দেশে সংগঠিত অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা, অনেক আবেগনির্ভর মৃত্যুকে রোধ করা যাবে। আখাউড়ার মতো ঘটনা যেন মিডিয়ার রুটিন খবর না হয়ে উঠে– সেই ব্যবস্থাটা এখনই নিতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট