প্রত্যাশা ডেস্ক: আজ পবিত্র মাস রমজানের ২৭তম দিন বা শবেকদর। ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবেকদর হচ্ছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত। এই পবিত্র রাতে গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ-দোয়া ও জিকির-আজকারসহ প্রত্যেকটি নেক আমলের সীমাহীন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে হাদিসে। প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদতের মধ্যে রাত জাগবে, তার আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে’ (সহিহ বুখারি: ৩৫) এ রাতে কোরআনুল কারিম নাজিল করা হয়।
আবার লাইলাতুল কদরের সম্মানে ‘সুরাতুল কদর’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরাও আছে পবিত্র কোরআনে। এ সুরায় বলা হয়েছে, লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল হয়েছে, এটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এবং এ রাতে ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। এ রাতের ফজর পর্যন্ত প্রশান্তি বর্ষিত হয়।’ (দেখুন সুরা কদর: ১-৫)
প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রহ.) তার জগদ্বিখ্যাত সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারি’-তে লাইলাতুল কদরের তারিখ নিয়ে আলিমগণের অনেকগুলো মতামত ব্যক্ত করেছেন। ইমাম তিরমিজি (রহ.) তার সুনানে লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ি ২১তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন। তার মতের পক্ষে দলিল হলো আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণিত হাদিস। তিনি বলেন, আমরা নবী (স.)-এর সাথে রমজানের মধ্য দশকে ইতেকাফ করি। তিনি ২০ তারিখ সকালে বের হয়ে আমাদের সম্বোধন করে বলেন, আমাকে কদরের রাত দেখানো হয়েছিল; পরে তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতে তার সন্ধান করো।
আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি (ওই রাতে) কাদা-পানিতে সিজদা করছি। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসুলের সাথে ইতেকাফ করেছে, সে যেন ফিরে আসে (অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের না হয়)। আমরা সবাই ফিরে আসলাম। আমরা আকাশে হালকা মেঘ খণ্ডও দেখতে পাইনি। পরে এমনভাবে মেঘ দেখা দিলো ও জোরে বৃষ্টি হলো যে, খেজুরের শাখায় তৈরি মসজিদের ছাদ হতে পানি ঝরতে লাগলো। সালাত শুরু হলে আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে কাদা-পানিতে সিজদা করতে দেখলাম। পরে তাঁর কপালে আমি কাদার চিহ্ন দেখতে পাই।
(অর্থাৎ, নবীজির স্বপ্ন সত্য হয়েছে) (বুখারি: ২০১৬) মুহাদ্দিসগণ অনেকেই এই হাদিস থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সেবছর কদর হয়েছিল ২১ তম রাতে। (মুফতি আমিমুল ইহসান (রাহ.) সংকলিত, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) অনূদিত ফিকহুস সুনান গ্রন্থে (১/৪৮০) এই বিষয়টি টীকায় উল্লেখিত হয়েছে) আরেকদল আলেমের মতে, শবে কদর শেষ সাত রাতের কোনো এক রাতে। তাদের পক্ষে দলিল হলো- ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে কদরের রাত অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যদি দুর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষ সাত রাতে অলসতা না করে।
(মুসলিম: ২৬৫৫) সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু উনাইস (রা.) রমজানের ২৩তম রাতকে কদরের রাত মনে করতেন (মুসলিম: ২৬৬৫)। তাবেয়ি ইকরামা (রহ.) বলেন, সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত যে, ‘তোমরা ২৪ তম রাতে (কদর) তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০২২) আলেমদের বিরাট আরেক জামাত বলেছেন, এটি রমজানের ২৭তম রাতে। এই মত দিয়েছেন উবাই ইবনু কাব (রা.), ইবনু আব্বাস (রা.), উমর (রা.), ইমাম আবু হানিফা (রহ)-সহ অনেকেই। এই মতের পক্ষে দলিল হলো, সাহাবি উবাই ইবনু কাব (রা.) কসম খেয়ে বলতেন, ২৭তম রাতটি লাইলাতুল কদর। (মুসলিম: ২৬৬৮) রাসুল (স.) বলেন, ‘তোমরা শেষ দশকের বিজোড় রাত লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ (বুখারি: ২০১৭)
জোড় রাতেও হতে পারে শবেকদর: শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রাহ.) একটি বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে বলেছেন, যদি রমজান মাস ৩০ দিনে হয়, তবে শেষ দশকের জোড় রাতগুলোতেও কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর দলিল হলো, আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘তোমরা (কদর) সন্ধান করো (শেষ দশকের) অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) নবম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) সপ্তম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) পঞ্চম রাতে, অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) তৃতীয় রাতে এবং অবশিষ্ট (থাকা রাতগুলোর) শেষ রাতে।’ (তিরমিজি: ৭৯৪) এ হাদিসে আমরা দেখতে পাই যে, যদি রমজান মাস ৩০ দিনের হয়, তাহলে অবশিষ্ট নবম রাতটি হবে রমজানের ২২তম রাত, অবশিষ্ট সপ্তম রাতটি হবে ২৪তম রাত, অবশিষ্ট পঞ্চম রাতটি হবে ২৬তম রাত এবং অবশিষ্ট তৃতীয় রাতটি হবে ২৮তম রাত। আর এভাবেই সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি (রা.) কদরের রাত সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন। (এই গণনা শেষদিক থেকে করা হয়েছে। হাসান বাসরি (রহ) থেকেও এভাবে গণনার পক্ষে দলিল রয়েছে) অন্য দিকে, যদি রমজান মাস ২৯ দিনের হয়, তাহলে উক্ত হাদিস অনুযায়ী কদরের রাত পড়বে শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে। অতএব, ঈমানদারদের উচিত, রামাদানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করা। (মাজমুউ ফতোয়া: ২৫/২৮৪-২৮৫)
গত শতাব্দির প্রখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিস শায়খ ইবনু উসাইমিন (রাহ.)-ও বলেছেন, জোড়-বেজোড় যেকোনো রাতেই কদর হতে পারে। (শারহুল মুমতি: ৬/৪৯২) এজন্য আমরা হাদিসে দেখি, নবীজি শুধু বেজোড় রাতে নয়, শেষ দশকের প্রতিটি রাতেই ইবাদত করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (স.) (রমজানের) শেষ দশকে যে পরিমাণ আমল করতেন, অন্যকোনো সময়ে সে পরিমাণ আমল করতেন না।’ (মুসলিম: ২৬৭৮) তবে, সন্দেহ নেই যে, কদরের রাত বিজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস এসেছে। তাই, আমরা বিজোড় রাতগুলো বেশি গুরুত্ব দেবো, তবে জোড় রাতগুলোতে অবহেলা করবো না।