ঢাকা ০৯:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা সম্পর্কে জানুন, পদক্ষেপ নিন

  • আপডেট সময় : ০৩:৫১:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

মো. ফিরোজ আমিন : আমার বন্ধু অরূপ, জীবন নিয়ে তার ভাবনা অনেকটা ভাবলেশহীন। কিন্তু তাকে দেখলাম চিন্তিত। কারণ কী? ‘তুমি তো জানো, আমার মা ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি খারাপ হয়ে মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। আজ বাসার গ্লুকোমিটারে চেক করে দেখি, ১৩ মিলিমোল, মন খারাপ হয়ে আছে, চিন্তা লাগছে তাই।’ অরূপের বয়স ৫৫। যে কেউ তার দিকে তাকানোর আগে তার ভুঁড়ির দিকে তাকাবে। বললাম, ব্লাড প্রেশারের কী অবস্থা?

কথার মাঝখানে এলো এক রোগী, যাকে আমি চাচা বলে ডাকি। ৭৯ বছর তার। ৩০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, কিন্তু তার সব রিপোর্ট নরমাল। তার গড় ডায়াবেটিস ৭ শতাংশের নিচে থাকে, রক্তচাপ নরমাল থাকে। খুব নিয়ম মেনে চলেন।
বন্ধুকে বললাম, এত চিন্তার কিছু নেই। তাকে দেখ, নিয়ম মানছেন। ভালো আছেন। সকালের নাশতা খেলাম একসঙ্গে দুজনে। খাবার ছিল রুটি, সবজি, ডিম আর চিনি দিয়ে কফি। নাশতায় যে রুটি খেলাম, চিনি দিয়ে চা খেলাম, সবজি- এসব খাবার ভেঙে গ্লুকোজ হয়। আর এসব গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে লাগে ইনসুলিন। অনেকটা চাবি দিয়ে দরজা খোলার মতো। যদি শরীরে ইনসুলিন না থাকে অথবা পরিমাণে কমে যায়, কারো কারো এমনও হয়, ইনসুলিন শরীরে আছে, এমনকি অনেক সময় বেশিও থাকে, তারপরও দেখা যায় সে ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ কমাতে পারছে না। থেকেও নেই। ইনসুলিন আধিক্য থাকা সত্ত্বেও যখন গ্লুকোজ বেশি থাকে, তখন বলা হয় ইনসুলিন রেসিসটেন্স।

যদি গ্লুকোজ কোষের ভেতরে ঢুকতে না পারে, তাহলে আমাদের এই খাবার কোনো কাজে আসে না, বরং রক্তে গ্লুকোজ বেশি আছে, কিন্তু ইনসুলিনের অভাবে, অথবা ইনসুলিন কাজ না করার কারণে কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়, আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যায়, ওজন কমে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, মহাসাগরে ভেসে থাকা একটি ডিঙি নৌকা কিন্তু খাবার পানি নেই। চারদিকে লবণাক্ত পানি। ইনসুলিন শরীরে একেবারেই যদি না থাকে, খুব অল্প সময়ের ভেতরে রোগীরা বিভিন্ন জটিলতায় মারা যান। যেমন ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস। যাদের আমরা টাইপ-১ ডায়াবেটিক বলে থাকি।
বেঁচে থাকার জন্য তাদের ইনসুলিন অপরিহার্য। সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য পরিমিত ইনসুলিন দরকার। ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে অথবা ইনসুলিন যদি কাজ না করতে পারে, তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকে তখন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের শরীরে প্রাথমিক অবস্থায় ইনসুলিনের আধিক্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। একজন মানুষ যদি খাবার বেশি খেয়ে থাকে, ব্যায়াম না করে থাকে, ওজন বেড়ে যায়, পেটে ও লিভারে চর্বি জমে, তখন শরীরের বাইরে কিছু পরিবর্তন হয়, যেমন ঘাড় কালো হয়ে যায়। রক্তচাপ বেড়ে যায়।

এ সময় অরূপ জিজ্ঞেস করল, আজকাল কি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, ঐঙগঅ-ওজ, ওহংঁষরহ-এর মাত্রা এগুলো করব নাকি? দেখো, টাইপ-২ ডায়াবেটিস মানেই ইনসুলিন আধিক্য বা ইনসুলিন রেসিসটেন্স, যারা হাঁটে না, খাবার খায় বেশি, ওজন বেশি, তারা সবাই ইনসুলিন রেসিসটেন্স। তাদের বেশি থাকবে, এটাই গবেষণায় প্রমাণিত। এ জন্য পয়সা খরচ করে ইনসুলিন লেভেল সব রোগীর পরীক্ষা করার দরকার নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। বরং ওজিটিটি করলে বোঝা যাবে, ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে কার কত গ্লুকোজ বাড়ে? যার ইনসুলিন লেভেল যত শরীরে কমে যাবে অথবা বেশি ইনসুলিন খাকা সত্ত্বেও কম কাজ করবে, তার গ্লুকোজের মাত্রা তত বেশি। কখনো কখনো ঈ-ঢ়বঢ়ঃরফব দেখা হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগীদের থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আলাদা করার জন্য।

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খালি পেটে ৭ মিলিমোল ও ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে ১১.১ মিলিমোল ও তার বেশি থাকলেই ডায়াবেটিস। আর খালি পেটে ৬.১-এর বেশি গ্লুকোজ এবং খাওয়ার পরে ৭.৮ মিলিমোল এর কম থাকলে প্রিডায়াবেটিস। অর্থাৎ খালি পেটে ৬.১ থেকে ৭ মিলিমোল-এর মধ্যে, আর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পরে ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোলের মধ্যে থাকা প্রিডায়াবেটিকের রোগীরা ব্যায়াম, খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরোপুরি ডায়াবেটিস হওয়া থেকে বাঁচতে পারেন।
ডায়াবেটিস এক ধরনের নীরব ঘাতক। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে ধীরে ধীরে আমাদের চোখ, হার্ট, কিডনি নষ্ট করে দেয়। রক্তনালিগুলোয় চর্বি জমে হার্টের রোগ হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, পায়ে ঘা হয়, চিকিৎসা দেরি হলে পা কেটে ফেলতে হয়। চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণের কারণে অন্ধত্ব দেখা দেয়। কিডনির কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। একটা সময়ে কিডনি বদলাতে হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। চুল, নখ, চামড়া, হাড়, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময় যত যায়, ডায়াবেটিসের বয়স বাড়ে, শরীরের ক্ষতিও বাড়তে থাকে।
যে রোগীর ৫০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, আর যার ২০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, দেখা গেছে, কম বয়সের তিনি ৫০ বছরে আসার আগেই চোখ, হার্ট, কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। এ জন্য কম বয়সের রোগীদের অনেক বেশি সজাগ থাকতে হয়। ওষুধ অথবা ইনসুলিন নিতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে। সকাল, দুপুর ও রাতে যাদের খালি পেটে ৫ থেকে ৬ মিলিমোল এবং সকাল, দুপুর ও রাতে খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৮ থেকে ১০ মিলিমোলের মধ্যে রাখতে পারে এবং তিন মাসের গড় ডায়াবেটিস ৭ শতাংশের নিচে রাখতে পারে, তাদের ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা খুব একটা দেখা দেয় না।
খালি পেটে (৭) অথবা খাওয়ার পরে (১০) গ্লুকোজ বেশি থাকলে ধীরে ধীরে সমস্যা দেখা দেয়। হাত-পা জ্বালাপোড়া থেকে অনুভূতি কমে যায়। গ্লুকোজের মাত্রা যত বেশি, ক্ষতির পরিমাণও তত বেশি। এ জন্য গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে আমরা ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি। মুখে খাওয়ার ওষুধ শরীরের জমানো ইনসুলিন বের করে। কিন্তু ইনসুলিন তৈরি করে না। এ কারণে মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে খেতে এক সময় বিটা সেলে জমানো ইনসুলিন ঘাটতি দেখা দেয়, ইনসুলিন আর বের করতে পারে না, রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। তাই বাইরে থেকে ইনসুলিন নেওয়াটা একমাত্র সমাধান।

যার খালি পেটে গ্লুকোজ সব সময় ১১ বা ১২ মিলিমোল থাকে, অথবা এর বেশি থাকে, গবেষণায় প্রমাণিত সত্য যে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তার বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেবে। সঙ্গে যদি রক্তচাপ থাকে, মা–বাবারও ডায়াবেটিস থাকে, ধূমপান করে থাকেন, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস না থাকে, রক্তে চর্বি বেশি থাকে তাহলে বিভিন্ন জটিলতা সময়ের আগেই দেখা দেয়। আর খালি পেটে ৯ বা ১০ মিলিমোল থাকলে তাদেরও একই জটিলতা দেখা দেবে, হয়তো ৪ বা ৫ বছর দেরি হবে, কিন্তু হবেই। অনেক রোগী ভেবে থাকেন সকালে ভালো আছে, তার মানে সারা দিনও রিপোর্ট ভালো, কিন্তু দেখা গেছে দুপুরে খাওয়ার পর তার গ্লুকোজ অনেক বেশি ১৬, ১৭ অথবা ১৮-এর ওপরে। তিনি কখনো চেকও করেননি, জানেন না। এ জন্য প্রত্যেক রোগীর নিজেদের গ্লুকোমিটার থাকা দরকার। ভালো থাকতে হলে ২৪ ঘণ্টাই গ্লুকোজ নরমাল রাখতে হবে। নিয়মিত চেক করতে হবে।

কথার মাঝখানে একজন রোগী বলল, কিটোডায়েটের কথা শোনা যায়, এ নিয়ে কী ভাবনা আপনার? দেখুন কিটোডায়েট অনেকটা মেইন বই না পড়ে নোট বই পড়ার মতো। সাময়িক কাজ করে, ওজনও কমে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটা না। খাবারে যদি গ্লুকোজ কম থাকে, তাহলে শরীরে জমানো প্রোটিন/মাংস, চর্বি থেকে গ্লুকোজ নতুন করে তৈরি করে, কিন্তু যদি ইনসুলিন শরীরে না থাকে অথবা পরিমাণে কমে গেলে, চর্বি ভেঙে কিটো অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এ রোগীরাই ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসে মারা যান। নিকট অতীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লোকের ব্যবসায়িক প্ররোচনায় টাইপ–১ রোগীরা ইনসুলিন বন্ধ করে দেয়, তাদের আইসিইউ নিয়েও বাঁচাতে পারিনি। আবার টাইপ-২ রোগীরা বেশিদিন যারা কিটোডায়েট মেনেছে, তাদের হার্টের, লিভারের জটিলতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। প্রোটিন বেশি খাওয়ার কারণে ইউরিক অ্যাসিড, কোলোন ক্যানসার ও কিডনির জটিলতা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রত্যেক রোগীর জন্য গাইড বুক ছাপিয়েছে, যেখানে ডায়াবেটিস সম্পর্কে একটা সহজ ভাষায় তথ্য, ব্যায়াম, খাবারের নিয়ম, সময়, ওজন অনুযায়ী খাবারের চার্ট সব দেওয়া আছে। সুস্থ থাকার জন্য নিজেদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে হবে। শুধু ওষুধ খেলেই হবে না, গ্লুকোজের পরিমাণ সকাল, দুপুর ও রাতে তিনবেলাতেই ভালো আছে কি না, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে কি না, রক্তে কোলেস্টেরল লেভেলের নিচে আছে কি না, ওজন কেমন রাখতে হবে, তিন মাসের গড় ৭ শতাংশের নিচে কি না, ইউরিনের সঙ্গে প্রোটিন যাচ্ছে কি না, কিডনি, চোখ এসবের কী অবস্থা- সবকিছু সম্পর্কে আপনার চিকিৎসক থেকে জেনে নেবেন। আর নিজে বুঝলেই ভালো থাকবেন। পরিবারকে ভালো রাখতে পারবেন।

লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারে জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বেগ

ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা সম্পর্কে জানুন, পদক্ষেপ নিন

আপডেট সময় : ০৩:৫১:৪১ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

মো. ফিরোজ আমিন : আমার বন্ধু অরূপ, জীবন নিয়ে তার ভাবনা অনেকটা ভাবলেশহীন। কিন্তু তাকে দেখলাম চিন্তিত। কারণ কী? ‘তুমি তো জানো, আমার মা ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি খারাপ হয়ে মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। আজ বাসার গ্লুকোমিটারে চেক করে দেখি, ১৩ মিলিমোল, মন খারাপ হয়ে আছে, চিন্তা লাগছে তাই।’ অরূপের বয়স ৫৫। যে কেউ তার দিকে তাকানোর আগে তার ভুঁড়ির দিকে তাকাবে। বললাম, ব্লাড প্রেশারের কী অবস্থা?

কথার মাঝখানে এলো এক রোগী, যাকে আমি চাচা বলে ডাকি। ৭৯ বছর তার। ৩০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, কিন্তু তার সব রিপোর্ট নরমাল। তার গড় ডায়াবেটিস ৭ শতাংশের নিচে থাকে, রক্তচাপ নরমাল থাকে। খুব নিয়ম মেনে চলেন।
বন্ধুকে বললাম, এত চিন্তার কিছু নেই। তাকে দেখ, নিয়ম মানছেন। ভালো আছেন। সকালের নাশতা খেলাম একসঙ্গে দুজনে। খাবার ছিল রুটি, সবজি, ডিম আর চিনি দিয়ে কফি। নাশতায় যে রুটি খেলাম, চিনি দিয়ে চা খেলাম, সবজি- এসব খাবার ভেঙে গ্লুকোজ হয়। আর এসব গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে লাগে ইনসুলিন। অনেকটা চাবি দিয়ে দরজা খোলার মতো। যদি শরীরে ইনসুলিন না থাকে অথবা পরিমাণে কমে যায়, কারো কারো এমনও হয়, ইনসুলিন শরীরে আছে, এমনকি অনেক সময় বেশিও থাকে, তারপরও দেখা যায় সে ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ কমাতে পারছে না। থেকেও নেই। ইনসুলিন আধিক্য থাকা সত্ত্বেও যখন গ্লুকোজ বেশি থাকে, তখন বলা হয় ইনসুলিন রেসিসটেন্স।

যদি গ্লুকোজ কোষের ভেতরে ঢুকতে না পারে, তাহলে আমাদের এই খাবার কোনো কাজে আসে না, বরং রক্তে গ্লুকোজ বেশি আছে, কিন্তু ইনসুলিনের অভাবে, অথবা ইনসুলিন কাজ না করার কারণে কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়, আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যায়, ওজন কমে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, মহাসাগরে ভেসে থাকা একটি ডিঙি নৌকা কিন্তু খাবার পানি নেই। চারদিকে লবণাক্ত পানি। ইনসুলিন শরীরে একেবারেই যদি না থাকে, খুব অল্প সময়ের ভেতরে রোগীরা বিভিন্ন জটিলতায় মারা যান। যেমন ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস। যাদের আমরা টাইপ-১ ডায়াবেটিক বলে থাকি।
বেঁচে থাকার জন্য তাদের ইনসুলিন অপরিহার্য। সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য পরিমিত ইনসুলিন দরকার। ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে অথবা ইনসুলিন যদি কাজ না করতে পারে, তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকে তখন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের শরীরে প্রাথমিক অবস্থায় ইনসুলিনের আধিক্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। একজন মানুষ যদি খাবার বেশি খেয়ে থাকে, ব্যায়াম না করে থাকে, ওজন বেড়ে যায়, পেটে ও লিভারে চর্বি জমে, তখন শরীরের বাইরে কিছু পরিবর্তন হয়, যেমন ঘাড় কালো হয়ে যায়। রক্তচাপ বেড়ে যায়।

এ সময় অরূপ জিজ্ঞেস করল, আজকাল কি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, ঐঙগঅ-ওজ, ওহংঁষরহ-এর মাত্রা এগুলো করব নাকি? দেখো, টাইপ-২ ডায়াবেটিস মানেই ইনসুলিন আধিক্য বা ইনসুলিন রেসিসটেন্স, যারা হাঁটে না, খাবার খায় বেশি, ওজন বেশি, তারা সবাই ইনসুলিন রেসিসটেন্স। তাদের বেশি থাকবে, এটাই গবেষণায় প্রমাণিত। এ জন্য পয়সা খরচ করে ইনসুলিন লেভেল সব রোগীর পরীক্ষা করার দরকার নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। বরং ওজিটিটি করলে বোঝা যাবে, ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে কার কত গ্লুকোজ বাড়ে? যার ইনসুলিন লেভেল যত শরীরে কমে যাবে অথবা বেশি ইনসুলিন খাকা সত্ত্বেও কম কাজ করবে, তার গ্লুকোজের মাত্রা তত বেশি। কখনো কখনো ঈ-ঢ়বঢ়ঃরফব দেখা হয় টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগীদের থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আলাদা করার জন্য।

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খালি পেটে ৭ মিলিমোল ও ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে ১১.১ মিলিমোল ও তার বেশি থাকলেই ডায়াবেটিস। আর খালি পেটে ৬.১-এর বেশি গ্লুকোজ এবং খাওয়ার পরে ৭.৮ মিলিমোল এর কম থাকলে প্রিডায়াবেটিস। অর্থাৎ খালি পেটে ৬.১ থেকে ৭ মিলিমোল-এর মধ্যে, আর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পরে ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোলের মধ্যে থাকা প্রিডায়াবেটিকের রোগীরা ব্যায়াম, খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরোপুরি ডায়াবেটিস হওয়া থেকে বাঁচতে পারেন।
ডায়াবেটিস এক ধরনের নীরব ঘাতক। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে ধীরে ধীরে আমাদের চোখ, হার্ট, কিডনি নষ্ট করে দেয়। রক্তনালিগুলোয় চর্বি জমে হার্টের রোগ হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, পায়ে ঘা হয়, চিকিৎসা দেরি হলে পা কেটে ফেলতে হয়। চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণের কারণে অন্ধত্ব দেখা দেয়। কিডনির কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়। একটা সময়ে কিডনি বদলাতে হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। চুল, নখ, চামড়া, হাড়, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময় যত যায়, ডায়াবেটিসের বয়স বাড়ে, শরীরের ক্ষতিও বাড়তে থাকে।
যে রোগীর ৫০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, আর যার ২০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, দেখা গেছে, কম বয়সের তিনি ৫০ বছরে আসার আগেই চোখ, হার্ট, কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। এ জন্য কম বয়সের রোগীদের অনেক বেশি সজাগ থাকতে হয়। ওষুধ অথবা ইনসুলিন নিতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে। সকাল, দুপুর ও রাতে যাদের খালি পেটে ৫ থেকে ৬ মিলিমোল এবং সকাল, দুপুর ও রাতে খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৮ থেকে ১০ মিলিমোলের মধ্যে রাখতে পারে এবং তিন মাসের গড় ডায়াবেটিস ৭ শতাংশের নিচে রাখতে পারে, তাদের ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা খুব একটা দেখা দেয় না।
খালি পেটে (৭) অথবা খাওয়ার পরে (১০) গ্লুকোজ বেশি থাকলে ধীরে ধীরে সমস্যা দেখা দেয়। হাত-পা জ্বালাপোড়া থেকে অনুভূতি কমে যায়। গ্লুকোজের মাত্রা যত বেশি, ক্ষতির পরিমাণও তত বেশি। এ জন্য গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে আমরা ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি। মুখে খাওয়ার ওষুধ শরীরের জমানো ইনসুলিন বের করে। কিন্তু ইনসুলিন তৈরি করে না। এ কারণে মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে খেতে এক সময় বিটা সেলে জমানো ইনসুলিন ঘাটতি দেখা দেয়, ইনসুলিন আর বের করতে পারে না, রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। তাই বাইরে থেকে ইনসুলিন নেওয়াটা একমাত্র সমাধান।

যার খালি পেটে গ্লুকোজ সব সময় ১১ বা ১২ মিলিমোল থাকে, অথবা এর বেশি থাকে, গবেষণায় প্রমাণিত সত্য যে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তার বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেবে। সঙ্গে যদি রক্তচাপ থাকে, মা–বাবারও ডায়াবেটিস থাকে, ধূমপান করে থাকেন, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস না থাকে, রক্তে চর্বি বেশি থাকে তাহলে বিভিন্ন জটিলতা সময়ের আগেই দেখা দেয়। আর খালি পেটে ৯ বা ১০ মিলিমোল থাকলে তাদেরও একই জটিলতা দেখা দেবে, হয়তো ৪ বা ৫ বছর দেরি হবে, কিন্তু হবেই। অনেক রোগী ভেবে থাকেন সকালে ভালো আছে, তার মানে সারা দিনও রিপোর্ট ভালো, কিন্তু দেখা গেছে দুপুরে খাওয়ার পর তার গ্লুকোজ অনেক বেশি ১৬, ১৭ অথবা ১৮-এর ওপরে। তিনি কখনো চেকও করেননি, জানেন না। এ জন্য প্রত্যেক রোগীর নিজেদের গ্লুকোমিটার থাকা দরকার। ভালো থাকতে হলে ২৪ ঘণ্টাই গ্লুকোজ নরমাল রাখতে হবে। নিয়মিত চেক করতে হবে।

কথার মাঝখানে একজন রোগী বলল, কিটোডায়েটের কথা শোনা যায়, এ নিয়ে কী ভাবনা আপনার? দেখুন কিটোডায়েট অনেকটা মেইন বই না পড়ে নোট বই পড়ার মতো। সাময়িক কাজ করে, ওজনও কমে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটা না। খাবারে যদি গ্লুকোজ কম থাকে, তাহলে শরীরে জমানো প্রোটিন/মাংস, চর্বি থেকে গ্লুকোজ নতুন করে তৈরি করে, কিন্তু যদি ইনসুলিন শরীরে না থাকে অথবা পরিমাণে কমে গেলে, চর্বি ভেঙে কিটো অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এ রোগীরাই ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসে মারা যান। নিকট অতীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লোকের ব্যবসায়িক প্ররোচনায় টাইপ–১ রোগীরা ইনসুলিন বন্ধ করে দেয়, তাদের আইসিইউ নিয়েও বাঁচাতে পারিনি। আবার টাইপ-২ রোগীরা বেশিদিন যারা কিটোডায়েট মেনেছে, তাদের হার্টের, লিভারের জটিলতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। প্রোটিন বেশি খাওয়ার কারণে ইউরিক অ্যাসিড, কোলোন ক্যানসার ও কিডনির জটিলতা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রত্যেক রোগীর জন্য গাইড বুক ছাপিয়েছে, যেখানে ডায়াবেটিস সম্পর্কে একটা সহজ ভাষায় তথ্য, ব্যায়াম, খাবারের নিয়ম, সময়, ওজন অনুযায়ী খাবারের চার্ট সব দেওয়া আছে। সুস্থ থাকার জন্য নিজেদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে হবে। শুধু ওষুধ খেলেই হবে না, গ্লুকোজের পরিমাণ সকাল, দুপুর ও রাতে তিনবেলাতেই ভালো আছে কি না, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে কি না, রক্তে কোলেস্টেরল লেভেলের নিচে আছে কি না, ওজন কেমন রাখতে হবে, তিন মাসের গড় ৭ শতাংশের নিচে কি না, ইউরিনের সঙ্গে প্রোটিন যাচ্ছে কি না, কিডনি, চোখ এসবের কী অবস্থা- সবকিছু সম্পর্কে আপনার চিকিৎসক থেকে জেনে নেবেন। আর নিজে বুঝলেই ভালো থাকবেন। পরিবারকে ভালো রাখতে পারবেন।

লেখক: অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা