প্রত্যাশা ডেস্ক: রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তিনি। পরিবার নিয়ে থাকেন ঢাকার আদাবর এলাকায়।
গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শেষে বাসায় ফেরার জন্য তিনি শেরেবাংলা নগর থেকে একটি লোকাল বাসে ওঠেন। বসেন বাসের ডান দিকে, জানালার পাশে।
বাসটি শ্যামলী স্কয়ারে এসে যাত্রী ওঠানো-নামানোর জন্য গতি খুব ধীর করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ডান হাতে একটি দামি মুঠোফোন ছিল। হঠাৎ বাসের বাইরের দিক থেকে তাঁর ডান হাত বরাবর চাপাতি দিয়ে এক যুবক আঘাত করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরো এক যুবক। শিক্ষকের ডান হাতে থাকা মুঠোফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে দৌড় দেন তাঁরা।
চাপাতির আঘাত ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় শিক্ষক হতবিহ্বল-আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে তিনি চিৎকার শুরু করেন। চালককে বাস থামাতে বলেন। কিছুটা দূরে বাস থামলে তিনি হন্তদন্ত হয়ে নেমে পড়েন। ঠিক যে স্থান (শ্যামলী স্কয়ার) থেকে তাঁর মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়, সেখানে ছুটে যান তিনি। মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়া যুবকদের হদিস পাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রায় ৩০ মিনিট শ্যামলী স্কয়ারে অবস্থান করেন তিনি। যুবকদের খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পরে রিকশায় বাসায় ফেরেন।
ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনে দুটি অপারেটরের সিম ব্যবহার করছিলেন এই শিক্ষক। বাসায় ফিরেই তিনি তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোন থেকে দুটি অপারেটরকে ফোন দেন। বলেন, তাঁর মুঠোফোন ছিনতাই হয়েছে। দ্রুত যেন তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নম্বর সচল আছে নাকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তা বুঝতে ঘটনার দিন দিবাগত রাত ১২টার পর তিনি তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোন থেকে ছিনতাই হওয়া মুঠোফোনে কল দেন। মুঠোফোনে কল ঢোকে, কিন্তু কেউ ধরেনি। এতে তিনি আরো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরদিন সকাল ৯টার পর তিনি তাঁর হিসাব (অ্যাকাউন্ট) থাকা ব্যাংকে যান। ব্যাংক হিসাবের বিবরণী তোলেন। বিবরণীতে দেখতে পান, তাঁর মুঠোফোনে থাকা অ্যাপস ব্যবহার করে ছিনতাইকারীরা হিসাব থেকে ৬০ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন।
বিবরণীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেন, তাঁর ব্যাংক হিসাব থেকে দুটি মুঠোফোন নম্বরে এই টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।
ব্যাংক থেকে এই শিক্ষক সোজা চলে যান আদাবর থানায়। থানার পুলিশ তাঁকে বলে, ঘটনাস্থল শ্যামলী স্কয়ার। এলাকাটি মোহাম্মদপুর থানার মধ্যে পড়েছে। তাই তাঁকে মোহাম্মদপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। আদাবর থানা থেকে তিনি যান মোহাম্মদপুর থানায়। পরে তিনি এই থানায় দণ্ডবিধি (ছিনতাই) ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
ব্যাংক হিসাব থেকে যে দুটি মুঠোফোন নম্বরে টাকা স্থানান্তর হয়েছে, সেই তথ্যের ভিত্তিতে মামলায় আসামি হিসেবে কামাল হোসেন নামের এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া কয়েকজনকে করা হয় অজ্ঞাত আসামি। মামলার পর পুলিশ অভিযান চালিয়ে কামাল হোসেন (৫১) ও রাসেল মিয়া (২১) নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে।
পুলিশের তথ্য বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কামাল একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের সদস্য। আর রাসেলের সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। কামালের কাছ থেকে ছিনতাইকারী দলটির নেতা হিসেবে সম্রাটের নাম জানতে পারে পুলিশ। তবে এই সম্রাটকে এখনো পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি।
আসামির ছেলে শিক্ষকের বাসায়: কামাল ও রাসেল গ্রেফতার হওয়ার দিন কয়েক পরের ঘটনা। আদাবর এলাকার বাসায় অবস্থান করছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। হঠাৎ বাসার নিরাপত্তারক্ষী তাঁকে জানান, দুজন লোক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান। পরে তিনি দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেন, দেখা করেন। দুই ব্যক্তির একজন নিজেকে গ্রেফতার হওয়া কামালের ছেলে বলে পরিচয় দেন।
কামালের ছেলে এই শিক্ষককে প্রস্তাব দেন, তিনি যেন মামলাটি তুলে নেন। আসামির ছেলের মুখে এ কথা শুনে ভয় পেয়ে যান শিক্ষক। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রকে বলেন, ‘আমার মোবাইল ফোন ছিনতাই করল। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আমার ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা নিয়ে নিল। আমি মামলা করলাম। যে দুজন আমার মোবাইল ফোন ছিনতাই করল, তাদের কাউকে পুলিশ ধরতে পারল না। এখন দেখছি, ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা আমার বাসাও চিনে ফেলেছে। মামলা উঠিয়ে নেওয়ার কথা বলছে। এখন আমার স্ত্রী-সন্তানেরা বলছে, বাসা পরিবর্তন করতে। আমিও বাসা পরিবর্তন করার চিন্তা করছি।’
মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমান গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বলেন, ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। ছিনতাইকারী দলের নেতাসহ অন্যদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে।
আতঙ্কে কাটছে দিন: ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর থেকে আতঙ্কে দিন কাটছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহযোগী অধ্যাপকের। তিনি জানান, এখন মুঠোফোন নিয়ে বাইরে চলাচল করতে ভয় পান। আরো ভয় পান এটিএম কার্ড নিয়ে বের হতে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেন, ‘একজন নাগরিক যদি রাত-বিরাতে চলাচল করতে ভয় পান, ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কা যদি সারাক্ষণ তাঁর মধ্যে কাজ করে, তাহলে বিষয়টি ভীষণ উদ্বেগের। ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর আমি ট্রমাটাইজড (মানসিক আঘাতের ধকল) হয়ে পড়েছি। নতুন মোবাইল কিনেছি, কিন্তু সেটি নিয়ে চলতে আমার ভয় লাগে।’
একটি মুঠোফোনে একজন ব্যক্তির নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য থাকে বলে উল্লেখ করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘ছিনতাইকারীরা আমার মোবাইল ফোনে থাকা গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকে যে হিসাবে আমার বেতন আসে, তার সঙ্গে আমার মোবাইল ফোন যুক্ত। তাই আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ছিনতাইকারীরা আমার বেতনের টাকা তুলে নিয়ে যায় কি না। তারা বেতনের টাকা নিতে পারেনি। কিন্তু আমার ব্যাংক হিসাব থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে নিল। পরে আমি দুটি নম্বরই বন্ধ করে দিই। নতুন সিম নিই। কিন্তু মোবাইল ফোন নম্বর দিয়ে যদি ছিনতাইকারী কিংবা অন্য কেউ কোনো অপরাধ করে, তখন দায়ভার তো মূল ব্যবহারকারীর ঘাড়েই চলে আসবে।’
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, ‘প্রতিদিন কারও না কারও মোবাইল ফোন ছিনতাই হওয়ার খবর জানতে পারি। বেশির ভাগ মোবাইল ফোন উদ্ধার হয় না। যার মোবাইল যায়, সে জানে, কতটা ঝুঁকিতে সে পড়েছে।’
আদাবর ও মোহাম্মদপুরে ডাকাত-ছিনতাইকারী সন্দেহে গ্রেফতার ৩: রাজধানীর আদাবর ও মোহাম্মদপুরে গত বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) রাতে অভিযান চালিয়ে ডাকাত ও ছিনতাইকারী সন্দেহে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ছয়টি সামুরাই ও একটি চায়নিজ কুড়াল উদ্ধার করা হয়েছে।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন শুভ হাওলাদার (২১), মো. রোহান (২০) ও আবদুল্লাহ হোসেন ওরফে মইদুল (২৫)।
শুক্রবার (১৪ মার্চ) র্যাব-২-এর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-২এর একটি দল গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে, রাজধানীর আদাবর থানা এলাকায় ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে ডাকাতেরা জড়ো হয়েছেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-২-এর একটি আভিযানিক দল সেখানে বিশেষ অভিযান চালায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাত দলের সদস্যরা দৌড়ে পালানোর সময় র্যাব-২–এর একটি দল ধাওয়া করে শুভ হাওলাদার ও রোহানকে আটক করে। তাঁদের চার-পাঁচজন সহযোগী পালিয়ে যান।
র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গ্রেফতার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁরা সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে পরস্পর যোগসাজশে আদাবর এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছিলেন। তাঁরা সামুরাই, চাকু ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে নগদ টাকাপয়সা, মুঠোফোন ও জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-২-এর আরেকটি দল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী আবদুল্লাহ হোসেন নামের আরেক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। এ সময় তাঁর কাছ থেকে একটি সামুরাই উদ্ধার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ডাকাতি, ছিনতাইসহ মাদকদ্রব্য আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।