ঢাকা ০৪:০২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন

রোহিঙ্গা সংকটের প্রধান সমাধান প্রত্যাবাসন

  • আপডেট সময় : ০৯:১৩:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশ নেওয়ার পর মতবিনিময় করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস- ছবি সংগৃহীত

প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য রেশন কমানো ঠেকাতে জাতিসংঘ সম্ভব সবকিছু করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এ বিশ্ব সংস্থার মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

শুক্রবার (১৪ মার্চ) কক্সবাজারের উখিয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। এমন এক সময়ে গুতেরেস কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করলেন যখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের খাবারের রেশন কমে অর্ধেক হতে পারে বলে সতর্ক করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় নিয়ে আছে কক্সবাজারের এই ক্যাম্পে। শরণার্থী জীবনে তাদের চাকরি বা শিক্ষার সুযোগও সীমিত। গুতেরেস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের মানবিক সহায়তার বরাদ্দ ‘নাটকীয়ভাবে’ কমিয়ে দিয়েছে, আর সে কারণেই রোহিঙ্গাদের রেশন বরাদ্দ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, তহবিলের অভাবে মানুষের যেন আরো বেশি কষ্ট পেতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমি বিশ্বের সব দেশকে আহ্বান জানাব, যারা আমাদের সহায়তা করতে পারে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, অর্থায়নের অভাবে এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য রেশন সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করা হতে পারে, যা আশ্রয় শিবিরের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।

গুতেরেস বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমি জোর গলায় বলব, আমাদের জরুরি ভিত্তিতে আরো সহায়তা প্রয়োজন, কারণ এই জনগোষ্ঠীর মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার জন্য এই সহায়তা খুবই জরুরি।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএআইডির মাধ্যমে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার কারণেই যে শুধু এ সংকট তৈরি হয়েছে- বিষয়টা সেরকম নয়। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে। তবে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, মার্কিন তহবিল সংকোচন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই এককভাবে সবচেয়ে বড় দাতা দেশ।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৩১ বছর বয়সী শরণার্থী মোহাম্মদ সাবির বলেন, আমরা এখন যে পরিমাণ খাবার পাই, সেটাই যথেষ্ট নয়। যদি এটা অর্ধেক করা হয়, তবে আমরা না খেয়েই মারা যাব।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজারে পৌঁছান। সেখান থেকে পরে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যান তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা লার্নিং সেন্টার, রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। মুহাম্মদ ইউনূস পরে আন্তোনিও গুতেরেসকে সঙ্গে নিয়ে উখিয়ায় প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতারে যোগ দেন।

রোহিঙ্গাদের ভুলে যাবে বিশ্ব? রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন যারা কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে আছেন, তাদের বড় অংশটি ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তবে গত বছরও প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার একটি বড় কারণ ছিল রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকট।

পাঁচ সন্তানের বাবা সাবির বলেন, আমরা এখানে কাজ করতে পারি না। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে অসহায় বোধ করি। আমি কী খাওয়াব তাদের? আমি আশা করি, বিশ্ব আমাদের কথা ভুলে যাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, শরণার্থীদের আগের মত রেশন দিতে এপ্রিল মাসে তাদের ১৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। তার আগে মার্চ মাস জুড়ে চলছে রমজান মাস। ফলে এপ্রিলে রেশন অর্ধেক হয়ে গেলে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। ৮০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শরণার্থী আব্দুর সালাম বলেন, কাজ বা আয়ের সুযোগ ছাড়া রেশন কমানো হলে সেটা আমাদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। তিনি বলেন, এ কেমন জীবন? যদি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দিতে না পারেন, তবে দয়া করে আমাদেরকে আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিন। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আশা করছে, এ সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং সহায়তা তহবিল সংগ্রহ করতে গুতেরেসের এই সফর সহায়ক হবে।

রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরতে চায়, সংকটের প্রধান সমাধান প্রত্যাবাসন: কয়েক দশক ধরে বৈষম্য ও নির্যাতনের পর আট বছর আগে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে বাংলাদেশে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে এসেছেন। এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। তারা বাড়ি ফিরতে চায়, মিয়ানমার তাদের মাতৃভূমি। নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এই সংকটের প্রধান সমাধান।

শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আজ আমি অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং তাদের সাহসে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাদের সংকল্প আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। অনেকেই মিয়ানমারে তাদের যন্ত্রণা এবং তাদের এখানে আসার গল্প শেয়ার করেছেন।

মিয়ানমারের সব পক্ষের প্রতি আমার বার্তা, সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করুন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। আর কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সহিংসতা উদ্রেক না করতে সহায়তা করুন।

আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও সংকটময়, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে। যতক্ষণ না রাখাইনে সংঘাত এবং ব্যবস্থাগত নির্যাতন শেষ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের তাদের সাহায্য করতে হবে। আমরা একটি গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে আছি। আর্থিক সহায়তায় কাটছাঁটের কারণে একটি অবর্ণনীয় বিপর্যয় হবে। মানুষ কষ্ট পাবে এবং মানুষ মারা যাবে।

গুতেরেস বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বিশাল সহায়তা করেছে। তারা তাদের ভূমি, বন, সীমিত পানি এবং অপ্রচলিত সম্পদ ভাগ করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন সময় এসেছে সহায়তার। সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এর আগে ২০১৮ সালে আমি কক্সবাজারে এসেছিলাম। এই শিবিরগুলো জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা অত্যন্ত গরম এবং আগুনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় এবং বর্ষা মৌসুমে বন্যা এবং বিপজ্জনক ভূমি স্লাইড ঘরবাড়ি এবং জীবন ধ্বংস করে দেয়। আবশ্যক খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, এখানে মানুষের শিক্ষার, দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো— যেমন মানবিক এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোও বিশাল বাজেট কাটছাঁটের মুখোমুখি। এটি মানুষের উপর সরাসরি এবং মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শরণার্থী জনগণ মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। অবশেষে সমাধানটি মিয়ানমারে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা ছেড়ে দেব না যতক্ষণ না পরিস্থিতি শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ছিনতাইয়ের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বাসায় আসামির ছেলে

রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন

রোহিঙ্গা সংকটের প্রধান সমাধান প্রত্যাবাসন

আপডেট সময় : ০৯:১৩:০৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ মার্চ ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য রেশন কমানো ঠেকাতে জাতিসংঘ সম্ভব সবকিছু করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এ বিশ্ব সংস্থার মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

শুক্রবার (১৪ মার্চ) কক্সবাজারের উখিয়ায় বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির ঘুরে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দেন। এমন এক সময়ে গুতেরেস কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির পরিদর্শন করলেন যখন জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের খাবারের রেশন কমে অর্ধেক হতে পারে বলে সতর্ক করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ ঘনীভূত হচ্ছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় নিয়ে আছে কক্সবাজারের এই ক্যাম্পে। শরণার্থী জীবনে তাদের চাকরি বা শিক্ষার সুযোগও সীমিত। গুতেরেস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের মানবিক সহায়তার বরাদ্দ ‘নাটকীয়ভাবে’ কমিয়ে দিয়েছে, আর সে কারণেই রোহিঙ্গাদের রেশন বরাদ্দ কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, তহবিলের অভাবে মানুষের যেন আরো বেশি কষ্ট পেতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে আমি বিশ্বের সব দেশকে আহ্বান জানাব, যারা আমাদের সহায়তা করতে পারে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, অর্থায়নের অভাবে এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের মাসিক খাদ্য রেশন সাড়ে ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ৬ ডলার করা হতে পারে, যা আশ্রয় শিবিরের খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে।

গুতেরেস বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমি জোর গলায় বলব, আমাদের জরুরি ভিত্তিতে আরো সহায়তা প্রয়োজন, কারণ এই জনগোষ্ঠীর মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার জন্য এই সহায়তা খুবই জরুরি।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউএসএআইডির মাধ্যমে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার কারণেই যে শুধু এ সংকট তৈরি হয়েছে- বিষয়টা সেরকম নয়। বরং রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে। তবে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, মার্কিন তহবিল সংকোচন এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, কারণ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রই এককভাবে সবচেয়ে বড় দাতা দেশ।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ৩১ বছর বয়সী শরণার্থী মোহাম্মদ সাবির বলেন, আমরা এখন যে পরিমাণ খাবার পাই, সেটাই যথেষ্ট নয়। যদি এটা অর্ধেক করা হয়, তবে আমরা না খেয়েই মারা যাব।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে কক্সবাজারে পৌঁছান। সেখান থেকে পরে উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যান তারা। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা লার্নিং সেন্টার, রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও পাটজাত পণ্যের উৎপাদন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। মুহাম্মদ ইউনূস পরে আন্তোনিও গুতেরেসকে সঙ্গে নিয়ে উখিয়ায় প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সঙ্গে ইফতারে যোগ দেন।

রোহিঙ্গাদের ভুলে যাবে বিশ্ব? রোহিঙ্গাদের মধ্যে এখন যারা কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরে আছেন, তাদের বড় অংশটি ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তবে গত বছরও প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যার একটি বড় কারণ ছিল রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান খাদ্য সংকট।

পাঁচ সন্তানের বাবা সাবির বলেন, আমরা এখানে কাজ করতে পারি না। আমি আমার সন্তানদের নিয়ে অসহায় বোধ করি। আমি কী খাওয়াব তাদের? আমি আশা করি, বিশ্ব আমাদের কথা ভুলে যাবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, শরণার্থীদের আগের মত রেশন দিতে এপ্রিল মাসে তাদের ১৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। তার আগে মার্চ মাস জুড়ে চলছে রমজান মাস। ফলে এপ্রিলে রেশন অর্ধেক হয়ে গেলে খাদ্য নিরাপত্তার ওপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। ৮০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শরণার্থী আব্দুর সালাম বলেন, কাজ বা আয়ের সুযোগ ছাড়া রেশন কমানো হলে সেটা আমাদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। তিনি বলেন, এ কেমন জীবন? যদি আমাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার দিতে না পারেন, তবে দয়া করে আমাদেরকে আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে দিন। আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আশা করছে, এ সংকটের দিকে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং সহায়তা তহবিল সংগ্রহ করতে গুতেরেসের এই সফর সহায়ক হবে।

রোহিঙ্গারা বাড়ি ফিরতে চায়, সংকটের প্রধান সমাধান প্রত্যাবাসন: কয়েক দশক ধরে বৈষম্য ও নির্যাতনের পর আট বছর আগে রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে বাংলাদেশে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে অনেকেই সাম্প্রতিক সময়ে এসেছেন। এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখন বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। তারা বাড়ি ফিরতে চায়, মিয়ানমার তাদের মাতৃভূমি। নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এই সংকটের প্রধান সমাধান।

শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে এসব কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, আজ আমি অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং তাদের সাহসে অনুপ্রাণিত হয়েছি। তাদের সংকল্প আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। অনেকেই মিয়ানমারে তাদের যন্ত্রণা এবং তাদের এখানে আসার গল্প শেয়ার করেছেন।

মিয়ানমারের সব পক্ষের প্রতি আমার বার্তা, সর্বোচ্চ সংযম অবলম্বন করুন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী সাধারণ মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন। আর কোনো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সহিংসতা উদ্রেক না করতে সহায়তা করুন।

আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও সংকটময়, বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে। যতক্ষণ না রাখাইনে সংঘাত এবং ব্যবস্থাগত নির্যাতন শেষ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের তাদের সাহায্য করতে হবে। আমরা একটি গভীর মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে আছি। আর্থিক সহায়তায় কাটছাঁটের কারণে একটি অবর্ণনীয় বিপর্যয় হবে। মানুষ কষ্ট পাবে এবং মানুষ মারা যাবে।

গুতেরেস বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বিশাল সহায়তা করেছে। তারা তাদের ভূমি, বন, সীমিত পানি এবং অপ্রচলিত সম্পদ ভাগ করে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন সময় এসেছে সহায়তার। সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই।

জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, এর আগে ২০১৮ সালে আমি কক্সবাজারে এসেছিলাম। এই শিবিরগুলো জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা অত্যন্ত গরম এবং আগুনের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় এবং বর্ষা মৌসুমে বন্যা এবং বিপজ্জনক ভূমি স্লাইড ঘরবাড়ি এবং জীবন ধ্বংস করে দেয়। আবশ্যক খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি, এখানে মানুষের শিক্ষার, দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলো— যেমন মানবিক এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোও বিশাল বাজেট কাটছাঁটের মুখোমুখি। এটি মানুষের উপর সরাসরি এবং মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শরণার্থী জনগণ মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল। অবশেষে সমাধানটি মিয়ানমারে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা ছেড়ে দেব না যতক্ষণ না পরিস্থিতি শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাই।