ঢাকা ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫

মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে নারী গোয়েন্দা

  • আপডেট সময় : ০৮:০৯:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫
  • ৭ বার পড়া হয়েছে

বিদেশের খবর ডেস্ক : চীনের ইয়ুননানের সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করছেন নারী গোয়েন্দাদের একটি দল। অসম সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন তারা। চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশে বেড়ে ওঠা লু ইয়াও (ছদ্মনাম) কখনো কল্পনাও করেননি যে ইয়ুননানের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালান এতটা ভয়াবহ হতে পারে।

মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্তসংলগ্ন এই অঞ্চল ট্রান্সন্যাশনাল মাদক চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্র। কিন্তু চায়না পিপলস পুলিশ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় লু মাদকবিরোধী মামলাগুলো নিয়ে গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার স্নাতকের থিসিসের বিষয় হিসেবেও এটিকে বেছে নেন।

সীমান্ত পরিদর্শন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর আগের চাকরি ছেড়ে তেহং তাই ও চিংপো স্বায়ত্তশাসিত প্রিফেকচারের মাংশি শহরের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ইউনিটে যোগ দেন লু। ৩৭ বছর বয়সী লু বলেন, ‘বাবা-মা বা আমার বোন কখনো মাদকের সংস্পর্শে আসেননি। তাদের কাছে অপরাধ মানে হয়তো ছোটখাটো চুরি। কিন্তু এখানে আমরা শত শত কেজি মাদকের চালান আটক করি। প্রতিটি অভিযানে সঙ্গে অস্ত্র রাখতে হয়। এটি এমন এক বাস্তবতা, যা সাধারণ অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না।’

দলটির বিশেষত্ব হলো, এর সদস্য সবাই নারী। এখন আছেন মোট আটজন। ২০১৫ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে এই নারী দলটি ২৪০টির বেশি মাদক মামলা পরিচালনা করেছে, ৩০০টিরও বেশি সীমান্ত নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা মোকাবিলা করেছে, আট শতাধিক সন্দেহভাজনকে আটক করেছে এবং এক হাজার কেজিরও বেশি অবৈধ মাদক উদ্ধার করেছে। এই অসামান্য অবদানের জন্য দলটিকে সম্প্রতি ‘৮ মার্চ লাল-ব্যানার সম্মাননা’ দিয়েছে প্রশাসন।

নারী দলটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। দিন দিন এমন নারীদের সংখ্যা বাড়ছিল, বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও কিশোরী, যারা বাধ্য হয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে মাদক চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়ছিল। স২০১৭ সালে দলে যোগ দেওয়া ৩৭ বছর বয়সী সান লিলি (ছদ্মনাম) বলেন, নারী তদন্তকারীরা নারী সন্দেহভাজনদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে পারদর্শী। তিনি বলেন, ‘নারী হিসেবে আমরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মাতৃত্বজনিত উদ্বেগ বুঝতে পারি, কিংবা তাদের সন্তানের দেখভালের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারি।’ মাদক সংক্রান্ত তদন্তকে সাধারণত শারীরিক শক্তিমত্তার কাজ হিসেবে ধরা হয়।

তবে তদন্তের মূল অংশজুড়ে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অভিযান পরিচালনা—যেখানে চীনা নারীরা বেশ দক্ষতা দেখাচ্ছেন। ৩৯ বছর বয়সী তদন্ত কর্মকর্তা পান ইয়ালি (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সন্দেহভাজনরা সতর্ক থাকে। তবে তারা একজন নারী কর্মকর্তার মুখোমুখি হলে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়। আর এটিই আমাদের বাড়তি সুবিধা দেয়।’ দলটির কাজের বড় অংশ চলে পর্দার আড়ালে। সদস্যরা প্রায়ই হোটেলের রিসেপশনিস্ট, নার্স, দোকানদার, রাস্তার হকার কিংবা এমনকি মাদকাসক্ত ছদ্মবেশেও অভিযানে নামেন।

এই পেশায় মানসিক দৃঢ়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পান ইয়ালি। তিনি বলেন, ‘আমরাও ভয় পাই। কিন্তু আমি জানি, সন্দেহভাজনরা আমাদের চেয়ে বেশি নার্ভাস থাকে, কারণ তারা অপরাধী। আইনই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’ এই দলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো নিখুঁত অনুসন্ধান। লু বলেন, ‘সন্দেহভাজনরা মাদক এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখে, যা কল্পনাতীত—জুতার তলায়, চুলের ক্লিপে, এমনকি কানের দুলেও! কখনো তারা গিলেও ফেলে। আর আমাদের একটি ছোট ভুলও পুরো অভিযান ব্যর্থ করে দিতে পারে।’ দলটির মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাও প্রশংসনীয়।

একটানা তিন ঘণ্টারও বেশি জিজ্ঞাসাবাদ চালানো কিংবা গভীর অরণ্যে দিনরাত নজরদারি করা তাদের জন্য নতুন কিছু নয়। মশার কামড় সহ্য করা থেকে শুরু করে হাড়কাঁপানো শীতে রাত কাটানো—সবই এ কাজের অংশ। সান লিলি বললেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকি। ফোন বাজলেই বেরিয়ে পড়তে হয়। অপরাধীরা তো আর ৯টা-৫টা শিডিউল মেনে চলে না।’ তবে অপরাধের হার ছুটির দিন ও সপ্তাহান্তে বাড়ে। একবার নববর্ষের আগের রাতে দীর্ঘ শিফট শেষ করে ভোরের দিকে বাড়ি পৌঁছান সান। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে আবার সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফিরে যেতে হয়। এসব কষ্টের পরও যখন অপরাধী সাজা পায়, তখন সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পান তারা। দলের আরেক সদস্য জানালেন, ‘যখন আদালত রায় দেয়, তখন মনে হয় আমাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে।’ তবে শুধু অপরাধী ধরা নয়, আইনি সচেতনতা বাড়াতেও ভূমিকা রাখছে নারী দলটি। সূত্র: সিএমজি

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে নারী গোয়েন্দা

আপডেট সময় : ০৮:০৯:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

বিদেশের খবর ডেস্ক : চীনের ইয়ুননানের সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করছেন নারী গোয়েন্দাদের একটি দল। অসম সাহসিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন তারা। চীনের পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশে বেড়ে ওঠা লু ইয়াও (ছদ্মনাম) কখনো কল্পনাও করেননি যে ইয়ুননানের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এলাকায় মাদক চোরাচালান এতটা ভয়াবহ হতে পারে।

মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্তসংলগ্ন এই অঞ্চল ট্রান্সন্যাশনাল মাদক চোরাচালানের অন্যতম কেন্দ্র। কিন্তু চায়না পিপলস পুলিশ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় লু মাদকবিরোধী মামলাগুলো নিয়ে গভীর আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার স্নাতকের থিসিসের বিষয় হিসেবেও এটিকে বেছে নেন।

সীমান্ত পরিদর্শন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর আগের চাকরি ছেড়ে তেহং তাই ও চিংপো স্বায়ত্তশাসিত প্রিফেকচারের মাংশি শহরের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ইউনিটে যোগ দেন লু। ৩৭ বছর বয়সী লু বলেন, ‘বাবা-মা বা আমার বোন কখনো মাদকের সংস্পর্শে আসেননি। তাদের কাছে অপরাধ মানে হয়তো ছোটখাটো চুরি। কিন্তু এখানে আমরা শত শত কেজি মাদকের চালান আটক করি। প্রতিটি অভিযানে সঙ্গে অস্ত্র রাখতে হয়। এটি এমন এক বাস্তবতা, যা সাধারণ অনেকে কল্পনাও করতে পারবে না।’

দলটির বিশেষত্ব হলো, এর সদস্য সবাই নারী। এখন আছেন মোট আটজন। ২০১৫ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে এই নারী দলটি ২৪০টির বেশি মাদক মামলা পরিচালনা করেছে, ৩০০টিরও বেশি সীমান্ত নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা মোকাবিলা করেছে, আট শতাধিক সন্দেহভাজনকে আটক করেছে এবং এক হাজার কেজিরও বেশি অবৈধ মাদক উদ্ধার করেছে। এই অসামান্য অবদানের জন্য দলটিকে সম্প্রতি ‘৮ মার্চ লাল-ব্যানার সম্মাননা’ দিয়েছে প্রশাসন।

নারী দলটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। দিন দিন এমন নারীদের সংখ্যা বাড়ছিল, বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা ও কিশোরী, যারা বাধ্য হয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে মাদক চোরাচালানে যুক্ত হয়ে পড়ছিল। স২০১৭ সালে দলে যোগ দেওয়া ৩৭ বছর বয়সী সান লিলি (ছদ্মনাম) বলেন, নারী তদন্তকারীরা নারী সন্দেহভাজনদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে পারদর্শী। তিনি বলেন, ‘নারী হিসেবে আমরা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মাতৃত্বজনিত উদ্বেগ বুঝতে পারি, কিংবা তাদের সন্তানের দেখভালের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারি।’ মাদক সংক্রান্ত তদন্তকে সাধারণত শারীরিক শক্তিমত্তার কাজ হিসেবে ধরা হয়।

তবে তদন্তের মূল অংশজুড়ে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অভিযান পরিচালনা—যেখানে চীনা নারীরা বেশ দক্ষতা দেখাচ্ছেন। ৩৯ বছর বয়সী তদন্ত কর্মকর্তা পান ইয়ালি (ছদ্মনাম) বলেন, ‘সন্দেহভাজনরা সতর্ক থাকে। তবে তারা একজন নারী কর্মকর্তার মুখোমুখি হলে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়। আর এটিই আমাদের বাড়তি সুবিধা দেয়।’ দলটির কাজের বড় অংশ চলে পর্দার আড়ালে। সদস্যরা প্রায়ই হোটেলের রিসেপশনিস্ট, নার্স, দোকানদার, রাস্তার হকার কিংবা এমনকি মাদকাসক্ত ছদ্মবেশেও অভিযানে নামেন।

এই পেশায় মানসিক দৃঢ়তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পান ইয়ালি। তিনি বলেন, ‘আমরাও ভয় পাই। কিন্তু আমি জানি, সন্দেহভাজনরা আমাদের চেয়ে বেশি নার্ভাস থাকে, কারণ তারা অপরাধী। আইনই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।’ এই দলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হলো নিখুঁত অনুসন্ধান। লু বলেন, ‘সন্দেহভাজনরা মাদক এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখে, যা কল্পনাতীত—জুতার তলায়, চুলের ক্লিপে, এমনকি কানের দুলেও! কখনো তারা গিলেও ফেলে। আর আমাদের একটি ছোট ভুলও পুরো অভিযান ব্যর্থ করে দিতে পারে।’ দলটির মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতাও প্রশংসনীয়।

একটানা তিন ঘণ্টারও বেশি জিজ্ঞাসাবাদ চালানো কিংবা গভীর অরণ্যে দিনরাত নজরদারি করা তাদের জন্য নতুন কিছু নয়। মশার কামড় সহ্য করা থেকে শুরু করে হাড়কাঁপানো শীতে রাত কাটানো—সবই এ কাজের অংশ। সান লিলি বললেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টা প্রস্তুত থাকি। ফোন বাজলেই বেরিয়ে পড়তে হয়। অপরাধীরা তো আর ৯টা-৫টা শিডিউল মেনে চলে না।’ তবে অপরাধের হার ছুটির দিন ও সপ্তাহান্তে বাড়ে। একবার নববর্ষের আগের রাতে দীর্ঘ শিফট শেষ করে ভোরের দিকে বাড়ি পৌঁছান সান। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে আবার সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফিরে যেতে হয়। এসব কষ্টের পরও যখন অপরাধী সাজা পায়, তখন সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পান তারা। দলের আরেক সদস্য জানালেন, ‘যখন আদালত রায় দেয়, তখন মনে হয় আমাদের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে।’ তবে শুধু অপরাধী ধরা নয়, আইনি সচেতনতা বাড়াতেও ভূমিকা রাখছে নারী দলটি। সূত্র: সিএমজি