ঢাকা ১২:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ মার্চ ২০২৫

সুদান থেকে পাচার হচ্ছে কোকাকোলার উপাদান

  • আপডেট সময় : ০৪:৩৮:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫
  • ৯ বার পড়া হয়েছে

বিদেশের খবর ডেস্ক: কোকাকোলা থেকে শুরু করে এমঅ্যান্ডএমসের চকলেট, মুখরোচক সব খাদ্যপণ্যের অপরিহার্য উপাদান গাম অ্যারাবিক এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এত পরিমাণে পাচার হচ্ছে যে তা সংঘাত থেকে পণ্যটির সরবরাহ চেইনকে আলাদা রাখতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর প্রচেষ্টাকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। ব্যবসায়ী ও শিল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

বিশ্বজুড়ে পাওয়া গাম অ্যারাবিকের ৮০ শতাংশই আসে সুদান থেকে। বাংলায় বহুল পরিচিত বাবলা গাছ বা অ্যাকাশিয়া গাছ থেকে সংগ্রহ করা এ প্রাকৃতিক উপাদান খাদ্য ও প্রসাধনীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নেসলে, ল’রিয়ালসহ নানা কোম্পানি লিপস্টিক, কোমল পানীয় ও পোষা প্রাণীর খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যে এটি ব্যবহার করে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের জাতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত আধাসামরিক র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) গত বছরের শেষদিকে পশ্চিম সুদানের কোরদোফান ও দারফুর অঞ্চলের প্রধান গাম অ্যারাবিক উৎপাদনকারী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর সুদান থেকে ওই কাঁচামালের মান ঠিকঠাক যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রতিবেশী দেশগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে বলে সুদানের গাম অ্যারাবিক ব্যবসায় জড়িত ৮ উৎপাদক ও ক্রেতার সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পেরেছে রয়টার্স।
ব্যবসায়ীরা এখন নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে গাম অ্যারাবিক বাজারজাত করতে পারছেন। ফলে ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে গাম অ্যারাবিক অবৈধ পাচারের ঘটনা বেড়েছে; যা সঠিক সার্টিফিকেশন ছাড়াই সুদানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাচার হচ্ছে।
দুই ব্যবসায়ী বলেছেন, ওই গাম বা আঠাল নির্যাসটি অপ্রাতিষ্ঠানিক সীমান্ত বাজার দিয়েও রপ্তানি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরএসএফের এক প্রতিনিধি বলেছেন, তাদের বাহিনী কেবল এই গাম অ্যারাবিক বাণিজ্যের সুরক্ষা দিচ্ছে, বিনিময়ে সামান্য ফি নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় আইনের লঙ্ঘন নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা প্যারামিলিটারি গ্রুপের বিরুদ্ধে অপপ্রচার দাবি তার।

গত মাসে আরএসএফ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠায় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একটি সনদে স্বাক্ষরও করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় চাদ ও সেনেগাল, যারা সুদানের তুলনায় খুবই কম গাম অ্যারাবিক উৎপাদন করে, এমনকী যুদ্ধের আগে রপ্তানি করতো না বললেই চলে এমন দেশ, যেমন মিশর আর দক্ষিণ সুদানও ব্যবসায়ীদের কাছে খুবই কম দামে এই গাম বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া শুরু করেছে, এটি যে সংঘাতমুক্ত এলাকার নয় তার প্রমাণও তারা দিচ্ছে না, রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন প্রস্তাব পাওয়া দুই ক্রেতা।

গাম অ্যারাবিক যে অ্যাকাশিয়া গাছ থেকে হয় তা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আফ্রিকার শুষ্ক সাহেল অঞ্চলে, যেটি ‘গাম বেল্ট’ নামেও পরিচিত। এই অ্যাকাশিয়া গাছের বিস্তৃত সব বাগান থাকায় সুদান এই গামের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।

খাদ্যপণ্যে বিশেষ উপাদান সরবরাহকারী সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকো-এগ্রির গ্লোবাল মার্কেটিং স্পেশালিস্ট হার্ভে কানেভেট বলেন, ব্যবসায়ীরা যেহেতু পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে চান না, সেহেতু কোথা থেকে এই গাম এসেছে তা বের করা বেশিরভাগ সময়ই কঠিন হয়, । আজ সুদান থেকে যত গাম আসছে, আমি বলবো এর সবই পাচার হওয়া। কেননা দেশটিতে এখন সত্যিকারের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।

এদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল প্রমোশন অব গামস (এআইপিজি) এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা সুদানের বিবদমান বাহিনীগুলোর সঙ্গে গাম অ্যারাবিক সরবরাহ চেইনের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ দেখছে না।
গামের এই চোরাগোপ্তা বাণিজ্য বৈশ্বিক খাদ্য উপাদান প্রস্তুতকারকদের ক্রয় প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে বলে জানিয়েছে খাত সংশ্লিষ্ট ৫টি সূত্র।

নেক্সাইরা, অ্যালান্ড অ্যান্ড রবার্ট ও ইনগ্রেডিয়নের মতো কোম্পানিগুলো পীতাভ রঙের আঠাল নির্যাসটির পরিশোধিত সংস্করণ কেনে এরপর সেটিকে এমালসিফিয়ারে (মিশবে না এমন দুটি তরলকে একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে) পরিণত করে এবং পরে বড় ভোগ্যপণ্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে।
রয়টার্স যোগাযোগ করলে ইনগ্রেডিয়ন জানায়, তারা তাদের সরবরাহ চেইনে সব লেনদেন যেন পুরোপুরি বৈধ থাকে তা নিশ্চিতে কাজ করছে। পাশাপাশি যুদ্ধ শুরুর পর তারা সুদানের বিকল্প হিসেবে ক্যামেরুনসহ অন্যান্য দেশ থেকেও গাম সংগ্রহ শুরু করেছে।

নেক্সাইরা জানিয়েছে, গৃহযুদ্ধের কারণে তারা সুদান থেকে আমদানি কমিয়েছে এবং অন্যান্য দশটি দেশ থেকে গাম সংগ্রহের ব্যবস্থাসহ সংঘাতের প্রভাব কমিয়ে আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অ্যাল্যান্ড অ্যান্ড রবার্ট, নেসলে ও কোকাকোলা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এমঅ্যান্ডএম’স নির্মাতা মার্স এবং ল’রিয়েলও মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

যুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যে ব্যবহৃত আঠা সরবরাহ করা খার্তুমভিত্তিক ইউনিটি অ্যারাবিক গামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হুসেইন সোরগে জানান, গত ডিসেম্বরে তিনি সেনেগাল ও চাদ থেকে গাম অ্যারাবিক কেনার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। চাদের ব্যবসায়ীরা তাকে ৩ হাজার ৫০০ ডলারে প্রতি টন হাশাব গাম (গাম অ্যারাবিকের দামী জাত) বিক্রির প্রস্তাব দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায়ও এর দাম ৫ হাজার ডলারের বেশি থাকে। সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়—বিক্রেতারা তাকে সিডেক্স সার্টিফিকেশন দিতে পারবেন না, যে সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করে সরবরাহকারীরা টেকসই ও নৈতিক মান যথাযথভাবে পূরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওই গাম কেনেননি সোরগে। স্বল্পমূল্য ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায় এগুলো সুদান থেকে পাচার হয়ে এসেছে কিংবা আরএসএফ সংশ্লিষ্ট অবৈধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রফতানি হয়েছে বলে সন্দেহ হয় তার। তিনি বলেন, চারাচালানকারীরা আরএসএফের মাধ্যমেই গাম অ্যারাবিক পাচার করতে পারে, কারণ আরএসএফই এখন সব উৎপাদন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।

২০২৩ সালে আরএসএফ তার গাম সরবরাহ ব্যবসার পুরোটা জব্দ করে নিলে মিশর পালিয়ে যাওয়া সোরগে রয়টার্সের সাথে তাকে পাঠানো কিছু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন; সেখানে দেখা যাচ্ছে ওই ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে পাঁচবার যোগাযোগ করেছিলেন। সর্বশেষ যোগাযোগ হয় গত ৯ জানুয়ারি।
মিসরের বিমান হামলার পাল্টায় আরএসএফ দেশটিতে ১২টি পণ্যের রফতানি নিষিদ্ধ করেছে; যার মধ্যে গাম অ্যারাবিকও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আধাসামরিক বাহিনীটি জানায়, সুদানের লাভ না হওয়ায় তাদের ভাষায় মিশরে পণ্যগুলোর পাচার নিষিদ্ধ করেছে তারা।
নিরাপত্তাজনিত কারণে আরেক ক্রেতা জানান, তার কাছেও সন্দেহভাজন পাচারকারীরা গাম বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। এক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে তাকে ১ হাজার ৯৫০ ডলার প্রতি টনে সেয়াল গাম (তুলনামূলক সস্তা ধরনের গাম অ্যারাবিক) বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়। অথচ এই গামের বাজারমূল্য প্রতি টন সাধারণত ৩ হাজার ডলার। পৃথক এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় অন্য এক ব্যবসায়ী এ ক্রেতাকে জানান, গাম অ্যারাবিক বহনকারী ট্রাক সুদানের সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ সুদান ও মিশরে যাচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রেই তাকে সিডেক্স সার্টিফিকেশন দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। এসব গাম আরএসএফ সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক থেকে আসছে সন্দেহে এই ক্রেতাও শেষ পর্যন্ত ওই বিক্রেতাদের কাছ থেকে গাম অ্যারাবিক কেনেননি।
পাচারের নতুন রুট: গৃহযুদ্ধের আগে গাছ থেকে সংগ্রহ করা গাম অ্যারাবিক খার্তুমে প্রক্রিয়াজাত শেষে লোহিত সাগরের পোর্ট সুদান থেকে জাহাজে সুয়েজ খাল হয়ে বিশ্বজুড়ে নানা গন্তব্যে পৌঁছে যেত। গত বছর থেকে সুদানের প্রদেশ ওয়েস্ট করদোফান ও দক্ষিণ সুদানের মাঝে সীমান্তের দুটি অপ্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটে আরএসএফ-সংশ্লিষ্ট গাম বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে রাজি না হওয়া এক ক্রেতা।

ওয়েস্ট কর্দোফানের অন্যতম বড় এ ক্রেতা জানান, ব্যবসায়ীরা এখন জমির মালিকদের কাছ থেকে গাম সংগ্রহ করে এবং পরে সেগুলো দক্ষিণ সুদানের ব্যবসায়ীদের কাছে মার্কিন ডলারে বিক্রি করে। সবই হয় আরএসএফ-এর নিরাপত্তায়। এজন্য ব্যবসায়ীদেরকে ফি দিতে হয়।

ওয়েস্ট করদোফানে অ্যাকাশিয়া বাগান আছে গাম উৎপাদনকারী আবদাল্লাহ মোহাম্মদেরও জানান, নিরাপত্তার বিনিময়ে আরএসএফ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফি নেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দক্ষিণ সুদানের তথ্যমন্ত্রী মাইকেল মাকুয়ি বলেন, দক্ষিণ সুদানের ভেতর দিয়ে গাম পরিবহন তার সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। রয়টার্স দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী জোসেফ মুম মাজাকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। তবে তিনি সাড়া দেননি।
আরএসএফ এই গাম সীমান্ত শহর উম দাফংয়ের ভেতর দিয়ে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রেও নিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক ক্রেতা, কিছু গাম যাচ্ছে চাদেও।

সুদানের এক পাইকারি ক্রেতা জানান, গাম অ্যারাবিক এখন দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা ও কেনিয়ার মোমবাসা হয়ে বিশ্ববাজারে রপ্তানি হচ্ছে।
অবৈধ উৎসের গাম অ্যারাবিক বিক্রি হচ্ছে অনলাইনেও। এখন যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেওয়া ইসাম সিদ্দিক কয়েক বছর আগেও সুদানে গাম প্রক্রিয়াজাত করতেন। ২০২৩ সালে সুদান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আরএসএফ তার খার্তুমের গুদামে অভিযান চালায়। এক বছর পর তিনি তার গাম দেখেন অনলাইনে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক স্ক্রিনশটে দেখা গেছে, ফেইসবুকের একটি গ্রুপে তার কোম্পানির ব্র্যান্ড নামসহ প্যাকেটজাত গাম বিক্রি হচ্ছে।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

সুদান থেকে পাচার হচ্ছে কোকাকোলার উপাদান

আপডেট সময় : ০৪:৩৮:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মার্চ ২০২৫

বিদেশের খবর ডেস্ক: কোকাকোলা থেকে শুরু করে এমঅ্যান্ডএমসের চকলেট, মুখরোচক সব খাদ্যপণ্যের অপরিহার্য উপাদান গাম অ্যারাবিক এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে এত পরিমাণে পাচার হচ্ছে যে তা সংঘাত থেকে পণ্যটির সরবরাহ চেইনকে আলাদা রাখতে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর প্রচেষ্টাকে ক্রমশ জটিল করে তুলছে। ব্যবসায়ী ও শিল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এ তথ্য দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

বিশ্বজুড়ে পাওয়া গাম অ্যারাবিকের ৮০ শতাংশই আসে সুদান থেকে। বাংলায় বহুল পরিচিত বাবলা গাছ বা অ্যাকাশিয়া গাছ থেকে সংগ্রহ করা এ প্রাকৃতিক উপাদান খাদ্য ও প্রসাধনীতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। নেসলে, ল’রিয়ালসহ নানা কোম্পানি লিপস্টিক, কোমল পানীয় ও পোষা প্রাণীর খাবারসহ বিভিন্ন পণ্যে এটি ব্যবহার করে।

২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে সুদানের জাতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত আধাসামরিক র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) গত বছরের শেষদিকে পশ্চিম সুদানের কোরদোফান ও দারফুর অঞ্চলের প্রধান গাম অ্যারাবিক উৎপাদনকারী এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর সুদান থেকে ওই কাঁচামালের মান ঠিকঠাক যাচাই-বাছাই ছাড়াই প্রতিবেশী দেশগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছে বলে সুদানের গাম অ্যারাবিক ব্যবসায় জড়িত ৮ উৎপাদক ও ক্রেতার সঙ্গে কথোপকথন থেকে জানতে পেরেছে রয়টার্স।
ব্যবসায়ীরা এখন নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে গাম অ্যারাবিক বাজারজাত করতে পারছেন। ফলে ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে গাম অ্যারাবিক অবৈধ পাচারের ঘটনা বেড়েছে; যা সঠিক সার্টিফিকেশন ছাড়াই সুদানের প্রতিবেশী দেশগুলোতে পাচার হচ্ছে।
দুই ব্যবসায়ী বলেছেন, ওই গাম বা আঠাল নির্যাসটি অপ্রাতিষ্ঠানিক সীমান্ত বাজার দিয়েও রপ্তানি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরএসএফের এক প্রতিনিধি বলেছেন, তাদের বাহিনী কেবল এই গাম অ্যারাবিক বাণিজ্যের সুরক্ষা দিচ্ছে, বিনিময়ে সামান্য ফি নিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় আইনের লঙ্ঘন নিয়ে যা বলা হচ্ছে, তা প্যারামিলিটারি গ্রুপের বিরুদ্ধে অপপ্রচার দাবি তার।

গত মাসে আরএসএফ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠায় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে একটি সনদে স্বাক্ষরও করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় চাদ ও সেনেগাল, যারা সুদানের তুলনায় খুবই কম গাম অ্যারাবিক উৎপাদন করে, এমনকী যুদ্ধের আগে রপ্তানি করতো না বললেই চলে এমন দেশ, যেমন মিশর আর দক্ষিণ সুদানও ব্যবসায়ীদের কাছে খুবই কম দামে এই গাম বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া শুরু করেছে, এটি যে সংঘাতমুক্ত এলাকার নয় তার প্রমাণও তারা দিচ্ছে না, রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন প্রস্তাব পাওয়া দুই ক্রেতা।

গাম অ্যারাবিক যে অ্যাকাশিয়া গাছ থেকে হয় তা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় আফ্রিকার শুষ্ক সাহেল অঞ্চলে, যেটি ‘গাম বেল্ট’ নামেও পরিচিত। এই অ্যাকাশিয়া গাছের বিস্তৃত সব বাগান থাকায় সুদান এই গামের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে।

খাদ্যপণ্যে বিশেষ উপাদান সরবরাহকারী সিঙ্গাপুরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইকো-এগ্রির গ্লোবাল মার্কেটিং স্পেশালিস্ট হার্ভে কানেভেট বলেন, ব্যবসায়ীরা যেহেতু পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করতে চান না, সেহেতু কোথা থেকে এই গাম এসেছে তা বের করা বেশিরভাগ সময়ই কঠিন হয়, । আজ সুদান থেকে যত গাম আসছে, আমি বলবো এর সবই পাচার হওয়া। কেননা দেশটিতে এখন সত্যিকারের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই।

এদিকে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল প্রমোশন অব গামস (এআইপিজি) এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা সুদানের বিবদমান বাহিনীগুলোর সঙ্গে গাম অ্যারাবিক সরবরাহ চেইনের যোগসাজশের কোনো প্রমাণ দেখছে না।
গামের এই চোরাগোপ্তা বাণিজ্য বৈশ্বিক খাদ্য উপাদান প্রস্তুতকারকদের ক্রয় প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে বলে জানিয়েছে খাত সংশ্লিষ্ট ৫টি সূত্র।

নেক্সাইরা, অ্যালান্ড অ্যান্ড রবার্ট ও ইনগ্রেডিয়নের মতো কোম্পানিগুলো পীতাভ রঙের আঠাল নির্যাসটির পরিশোধিত সংস্করণ কেনে এরপর সেটিকে এমালসিফিয়ারে (মিশবে না এমন দুটি তরলকে একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে) পরিণত করে এবং পরে বড় ভোগ্যপণ্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে।
রয়টার্স যোগাযোগ করলে ইনগ্রেডিয়ন জানায়, তারা তাদের সরবরাহ চেইনে সব লেনদেন যেন পুরোপুরি বৈধ থাকে তা নিশ্চিতে কাজ করছে। পাশাপাশি যুদ্ধ শুরুর পর তারা সুদানের বিকল্প হিসেবে ক্যামেরুনসহ অন্যান্য দেশ থেকেও গাম সংগ্রহ শুরু করেছে।

নেক্সাইরা জানিয়েছে, গৃহযুদ্ধের কারণে তারা সুদান থেকে আমদানি কমিয়েছে এবং অন্যান্য দশটি দেশ থেকে গাম সংগ্রহের ব্যবস্থাসহ সংঘাতের প্রভাব কমিয়ে আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অ্যাল্যান্ড অ্যান্ড রবার্ট, নেসলে ও কোকাকোলা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। এমঅ্যান্ডএম’স নির্মাতা মার্স এবং ল’রিয়েলও মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

যুদ্ধের আগে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যে ব্যবহৃত আঠা সরবরাহ করা খার্তুমভিত্তিক ইউনিটি অ্যারাবিক গামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হুসেইন সোরগে জানান, গত ডিসেম্বরে তিনি সেনেগাল ও চাদ থেকে গাম অ্যারাবিক কেনার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। চাদের ব্যবসায়ীরা তাকে ৩ হাজার ৫০০ ডলারে প্রতি টন হাশাব গাম (গাম অ্যারাবিকের দামী জাত) বিক্রির প্রস্তাব দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায়ও এর দাম ৫ হাজার ডলারের বেশি থাকে। সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়—বিক্রেতারা তাকে সিডেক্স সার্টিফিকেশন দিতে পারবেন না, যে সার্টিফিকেশন নিশ্চিত করে সরবরাহকারীরা টেকসই ও নৈতিক মান যথাযথভাবে পূরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত ওই গাম কেনেননি সোরগে। স্বল্পমূল্য ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায় এগুলো সুদান থেকে পাচার হয়ে এসেছে কিংবা আরএসএফ সংশ্লিষ্ট অবৈধ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রফতানি হয়েছে বলে সন্দেহ হয় তার। তিনি বলেন, চারাচালানকারীরা আরএসএফের মাধ্যমেই গাম অ্যারাবিক পাচার করতে পারে, কারণ আরএসএফই এখন সব উৎপাদন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।

২০২৩ সালে আরএসএফ তার গাম সরবরাহ ব্যবসার পুরোটা জব্দ করে নিলে মিশর পালিয়ে যাওয়া সোরগে রয়টার্সের সাথে তাকে পাঠানো কিছু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তার স্ক্রিনশটও শেয়ার করেছেন; সেখানে দেখা যাচ্ছে ওই ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে পাঁচবার যোগাযোগ করেছিলেন। সর্বশেষ যোগাযোগ হয় গত ৯ জানুয়ারি।
মিসরের বিমান হামলার পাল্টায় আরএসএফ দেশটিতে ১২টি পণ্যের রফতানি নিষিদ্ধ করেছে; যার মধ্যে গাম অ্যারাবিকও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আধাসামরিক বাহিনীটি জানায়, সুদানের লাভ না হওয়ায় তাদের ভাষায় মিশরে পণ্যগুলোর পাচার নিষিদ্ধ করেছে তারা।
নিরাপত্তাজনিত কারণে আরেক ক্রেতা জানান, তার কাছেও সন্দেহভাজন পাচারকারীরা গাম বিক্রির প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। এক হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে তাকে ১ হাজার ৯৫০ ডলার প্রতি টনে সেয়াল গাম (তুলনামূলক সস্তা ধরনের গাম অ্যারাবিক) বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়। অথচ এই গামের বাজারমূল্য প্রতি টন সাধারণত ৩ হাজার ডলার। পৃথক এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় অন্য এক ব্যবসায়ী এ ক্রেতাকে জানান, গাম অ্যারাবিক বহনকারী ট্রাক সুদানের সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ সুদান ও মিশরে যাচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রেই তাকে সিডেক্স সার্টিফিকেশন দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়। এসব গাম আরএসএফ সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক থেকে আসছে সন্দেহে এই ক্রেতাও শেষ পর্যন্ত ওই বিক্রেতাদের কাছ থেকে গাম অ্যারাবিক কেনেননি।
পাচারের নতুন রুট: গৃহযুদ্ধের আগে গাছ থেকে সংগ্রহ করা গাম অ্যারাবিক খার্তুমে প্রক্রিয়াজাত শেষে লোহিত সাগরের পোর্ট সুদান থেকে জাহাজে সুয়েজ খাল হয়ে বিশ্বজুড়ে নানা গন্তব্যে পৌঁছে যেত। গত বছর থেকে সুদানের প্রদেশ ওয়েস্ট করদোফান ও দক্ষিণ সুদানের মাঝে সীমান্তের দুটি অপ্রাতিষ্ঠানিক মার্কেটে আরএসএফ-সংশ্লিষ্ট গাম বিক্রি হয় বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে রাজি না হওয়া এক ক্রেতা।

ওয়েস্ট কর্দোফানের অন্যতম বড় এ ক্রেতা জানান, ব্যবসায়ীরা এখন জমির মালিকদের কাছ থেকে গাম সংগ্রহ করে এবং পরে সেগুলো দক্ষিণ সুদানের ব্যবসায়ীদের কাছে মার্কিন ডলারে বিক্রি করে। সবই হয় আরএসএফ-এর নিরাপত্তায়। এজন্য ব্যবসায়ীদেরকে ফি দিতে হয়।

ওয়েস্ট করদোফানে অ্যাকাশিয়া বাগান আছে গাম উৎপাদনকারী আবদাল্লাহ মোহাম্মদেরও জানান, নিরাপত্তার বিনিময়ে আরএসএফ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ফি নেয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দক্ষিণ সুদানের তথ্যমন্ত্রী মাইকেল মাকুয়ি বলেন, দক্ষিণ সুদানের ভেতর দিয়ে গাম পরিবহন তার সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। রয়টার্স দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী জোসেফ মুম মাজাকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল। তবে তিনি সাড়া দেননি।
আরএসএফ এই গাম সীমান্ত শহর উম দাফংয়ের ভেতর দিয়ে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রেও নিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এক ক্রেতা, কিছু গাম যাচ্ছে চাদেও।

সুদানের এক পাইকারি ক্রেতা জানান, গাম অ্যারাবিক এখন দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবা ও কেনিয়ার মোমবাসা হয়ে বিশ্ববাজারে রপ্তানি হচ্ছে।
অবৈধ উৎসের গাম অ্যারাবিক বিক্রি হচ্ছে অনলাইনেও। এখন যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেওয়া ইসাম সিদ্দিক কয়েক বছর আগেও সুদানে গাম প্রক্রিয়াজাত করতেন। ২০২৩ সালে সুদান থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আরএসএফ তার খার্তুমের গুদামে অভিযান চালায়। এক বছর পর তিনি তার গাম দেখেন অনলাইনে।
রয়টার্সকে দেওয়া এক স্ক্রিনশটে দেখা গেছে, ফেইসবুকের একটি গ্রুপে তার কোম্পানির ব্র্যান্ড নামসহ প্যাকেটজাত গাম বিক্রি হচ্ছে।