নারী ও শিশু ডেস্ক: জন্মের পর বা শৈশবে কোনো শিশু সহিংস ঘটনার সম্মুখীন হলে তার জন্য অত্যন্ত ভয়ানক। এই ঘটনা তাদের মনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এটা এমন এক মানসিক অবস্থা; যা কোনো ভয়ঙ্কর বা কষ্টদায়ক ঘটনার পর মানুষ অনুভব করে। এটি মনের গভীর ক্ষত; যা দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের অনুভূতি, আচরণ ও চিন্তায় প্রভাব ফেলে।
যে কোনো সহিংস পরিস্থিতি, রাজনৈতিক বা পারিবারিক সহিংসতা শিশুদের মধ্যে ট্রমা সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক বা মানসিক আঘাত; যা দীর্ঘদিন শিশুর স্মৃতিতে থাকে এবং সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা না গেলে তা আজীবন শিশুকে তাড়া করে, তার জীবনে নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এই প্রতিকূল শৈশব অভিজ্ঞতাকেই সাধারণ ভাষায় বল্য হয় ট্রমা। গর্ভাবস্থায় অর্থাৎ শূন্য দিন থেকে শুরু করে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেককে শিশু বলা হয়। তাই এই সময়ে যে ট্রমা সেটিই চাইল্ডহুড ট্রমা। অ্যাডভার্স চাইল্ডহুড এক্সপেরিয়েন্সের মধ্য দিয়ে যেসব শিশু যায়। তাদের ট্রমা হয়। বিভিন্ন কারণে চাইল্ডহুড ট্রমা হতে পারে। যেমন।
গর্ভস্থ শিশুদের ক্ষেত্রে এ মা যদি কোনো পারিবারিক সংহিসতা, মানসিক স্ব স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যান, তাহ তাহলে সেটি গর্ভস্থ শিশুর উপর প্রভাব ফেলে। যত্ন পাওয়া শিশুর অধিকার। শিশু জন্মের পরে যদি সঠিক যত্ন না পায়, তখন সেই শিশুর এক ধরনের প্রতিকুল শৈশব অভিজ্ঞতা হয়, তার ট্রমা হয়। কোনো শিশু যত্ন পেল না, খাদ্য, পুষ্টি, কিংবা শিক্ষা পেল না সেটাও এক ধরনের ট্রমা।
অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, বৈষম্যের শিকার, এ ছাড়া শৈশবে কোনো কারণে যদি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বা পরিবার, স্কুলে বা কোথাও যদি শারীরিকভাবে আঘাত পায় সেটাও শিশুর ট্রিমার কারণ।
শিশুকে আমাত দিয়ে কথা বলা, মনের ওপর চাপ তৈরি হওয়াসা কারণে ইমোশনাল ট্রমা হতে পারে
যৌন নির্যাতন খুব বেশি ঘটছে; যা থেকে শিশুর ট্রমা হয়। বিশ্বব্যাপি প্রতি ৪টি মেয়ে শিশুর মধ্যে ১ জন এবং হাতি ৬টি ছেলে শিশুর মধ্যে একজন জীবনে কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
শিশু সরাসরি কোনো নির্যাতনের শিকার হলো না কিন্তু পারিবারিক সংহিসতা দেখন, বাবা-মায়ের মধ্যে কগড়া, অশান্তি, বিবাদ দেখল, সেটিও তার জন্য ট্রমা। এ ছাড়া পরিবারে কারো মধ্যে যদি অপরাধের ইতিহাস থাকে, কোনো ধরনের সমস্যা থাকে সেটাও এক ধরনের ট্রমা।
শিশু যদি সরাসরি নানাভাবে কখনো ট্রমার ভুক্তভোগী হিসেবে নিজেকে প্রত্যক্ষ করে, মৌখিকভাবে বুলিংয়ের শিকার হয় স্কুলে বা বিভিন্ন স্থানে, আবার নিজে ট্রমার ভুক্তভোগী না কিন্তু অন্য কারো ভেতর ট্রমাগুলো দেখছে যেমন- পরিবারের ভেতর মারপিট, ঝগড়া, মা-বাবার বিচ্ছেদ- এ সবকিছুই শিশুর ট্রমা হিসেবে কাজ করে।
লক্ষণ: শৈশবে শিশুর ট্রমা হলে শিশু ঠিকমতো খেতে চায় না; শিশুর চিন্তা, আচরণ ও ঘুমের পরিবর্তন হয়; বিছানায় প্রস্রাব করে; ভয়ার্ত হয়ে যায়, ভয় পায়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে; লেখাপড়া ব্যাহত হয়, পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকে; কারো সঙ্গে মেলামেশা ও খেলাধুলা করতে চায় না; সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয় না।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শাহনীলা তৈয়ব চাইল্ডহুড ট্রমার প্রভাবে শিশুর স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে। এক্ষেত্র স্বত্তমেয়াদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ভেতর শিশুর উদ্বিগ্নতা বাড়ে, আচরণে সমস্য হয়, মেজাজ খিটখিটে এটখিটে হয়ে যায়, ঘুমের সমস্যা হয়, ৫ বছর বয়সের পরও শিশু বিছানায় প্রস্রাব করে এবং অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে যায়। তবে তিনি বলেন, চাইল্ডহুড ট্রমা কাটিয়ে উঠা কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়। এটিকে বোঝা এবং মেনে নেয়া ট্রমা থেকে পুনরুদ্ধারের প্রথম ধাপ। এরপর অবশ্বই একজন ট্রমা ঘেরাপিস্ট বা পরামর্শদাতার সাথে দেখা করতে হবে। তারা শিশুর অভিজ্ঞতাগুলো বোঝার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করবে। শৈশবের ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে নিজস্ব পদ্ধতির পাশাপাশি পেশাদার সহায়তা নিলে উপকৃত হওয়া যায়।
অনেক সময় ট্রমা থেকে কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তবে নিচের পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব-
= পেশাদারের সাহায্য নিন। একজন থেরাপিস্ট বা কাউন্সিলর- যার ট্রমা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তিনি আপনাকে কী ঘটেছে তা বুঝতে এবং এটি মোকাবিলার উপায়গুলো নিয়ে আসতে সহায়তা করতে পারেন।
= আপনার শরীর মনকে শৈশবের ট্রমা কীভাবে প্রভাবিত করছে তা জানতে; আপনার সাথে কী ঘটেছে তা বুঝতে এবং আপনার নিরাময়ের দায়িত্ব নিতে সহায়তা করবে।
= স্ব-যত্ন হলো আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া। এর অর্থ হতে পারে পছন্দের কাজ করা, ভালো খাওয়া এবং পর্যাপ্ত ঘুমের মতো কাজ করা।
= অন্যান্য মানুষের সাথে সুসম্পর্ক অন্যন্য মানুষের সাথে ভালো। সম্পর্ক করুন, বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সাথে কথা বলুন বা কোনো গ্রুপে যোগদান করে আপনি আপনার অনুভতি গুলো শেয়ার করুন। এটি ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম কার্যকর একটি পদ্ধতি।
অন্যান্য পদ্ধতি: কগনিটিভ-বেহেভিওরাল থেরাপি (ঈইঞ), আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন এবং রিপ্রসেসিং (ঊগউজ), এবং সোম্যাটিক এক্সপেরিয়েন্সিং ইত্যাদি পদ্ধতি সাধারণত ব্যবহার হয় ট্রমা কাটিয়ে উঠতে।
মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ: ধ্যান, যোগব্যায়াম বা তাই-চির মতো মননশীলতা ব্যায়াম আপনাকে শান্ত থাকতে এবং মানসিক আঘাতের প্রভাব মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে।
নিজের প্রতি ধৈর্যশীল হন। ট্রমা থেকে নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগে। তাই নিজের প্রতি ধৈর্য রাখতে এবং নিজের গতিতে। চলা গুরুত্বপূর্ণ।
এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে চাইল্ডহুড ট্রমায় প্রভোকের অভিজ্ঞতা আলাদা এবং সেটি থেকে পুনরুদ্ধারের পদ্ধতিটি প্রত্যেকের জন্য আলাদা। সবার জন্য উপরোক্ত পদ্ধতি গুলো কাজ করবেনা, তাই একজন থেরাপিস্টের সাথে কথা বলা এবং আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে ভাল কাজ করে তা খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ।