সাহিত্য ডেস্ক: বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে প্রতি বছর নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে এমনটিই দেখে আসছি। কোনোবার শুনি মেলায় অতিরিক্ত ভিড়। ধুলাবালুতে নিঃশ্বাস নেওয়া দায়। ছুটির দিন হলে তো কথাই নেই। মেলায় ঢুকতে শাহবাগ থেকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। কোনো কোনোবার শুনি এবারের বেচাবিক্রি ভালো না। লোকজন মেলায় এসে বই কেনে না। খালি ঘোরে আর ছবি তোলে। এটা কি তামাশার জায়গা! বিশেষত পরিচিত প্রকাশক ভাই-বন্ধুদের তরফ থেকে এমনটাই শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আবার মেলা শেষ হলে প্রতিবছরই প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে পত্রপত্রিকায় দেখি, বই বিক্রি অন্য সব বছরের রেকর্ড ছাড়াল!
একটা বিষয়ে অবশ্য প্রায় প্রতিবছরই মিল দেখি। সেটা বাংলা একাডেমি পুরস্কার সম্পর্কিত। যদিও পুরস্কার মেলার অংশ নয়, তবুও পুরস্কারটি মেলার প্রথম দিন দেওয়া হয় বলে এই আলোচনা মাসজুড়ে শীতের আমেজের মেলার মাঠকে বেশ গরম করে রাখে। মেলার মাঠে এবং এর বাইরে প্রতিবারই শুনি, এবারের পুরস্কার জঘন্য হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অধিকাংশ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। যারা পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশই তদবির করে পেয়েছেন। যোগ্যরা বাদ পড়েছেন। গেল! গেল! শিল্প-সাহিত্য-গবেষণা রসাতলে গেল! দু’একজন ভালো লেখক অবশ্য পুরস্কার পান প্রতি বছরই। তারা শোভা পান পায়েসের মধ্যে ভেসে থাকা এলাচির মতো। সংখ্যায় অত্যন্ত কম। কিন্তু মনে হয় বেশ। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না! এবারের পুরস্কারও ভালো হতে হতেও ভালো হলো না বলে বেশ শোরগোল উঠল। হায় পুরস্কার! তুমি কবে মনঃপূত হবে!
এ তো গেল ‘কমন’ আলাপ-আলোচনা। ব্যক্তি পর্যায়ে আলোচনা করতে গেলে নানা বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। বিশেষত কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে নানা মত-পথ পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন, মেলাটা বাংলা একাডেমি থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হোক। কেউ বলেন, না না না সেটা হবে গর্হিত! বাঙালির আবেগ নিয়ে খেলা চলবে না। বাংলা একাডেমি বাঙালির আবেগের জায়গা। জাতির জন্মের সঙ্গে এর নাড়ি লাগানো। এই নাড়ি কাটলেই শেষ। একাডেমিও বাঁচবে না, মেলাও নয়। এই বর্ধমান হাউসের প্রাঙ্গণের ছোঁয়া আমাদের লাগবেই! কেউ কেউ বলেন, এই মেলা আয়োজনের দায়িত্ব বাংলা একাডেমির পালন করার দরকার কী! এটা তাদের কাজ নয়। বাংলা একাডেমি ব্যস্ত থাকুক গবেষণা-সৃজনশীল চর্চা নিয়ে। বলা বাহুল্য, এগুলোও ৩০ বছর ধরেই শুনে আসছি।
এবারের গ্রন্থমেলা কেন্দ্র করে এসব আলাপের কোনোটাই বাদ যায়নি। আলাপগুলো অনেকটা জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ গোছের। সেই পুরোনো কথকতা। প্রতিবছর পুনরাবৃত্তি। কারণ, প্রতিবছর গ্রন্থমেলা হয় স্বাভাবিক নিয়ম ও পরিবেশে। শুধু ব্যতিক্রম ঘটেছিল ১৯৮৩ সালে। সে বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের এরশাদবিরোধী মিছিলের ওপর ট্রাক উঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে দুজন ছাত্র মারা যান। এই শোকের ভেতর সেবার গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে সেবার কোনো কথাও ওঠেনি। নাকি অভ্যাসবশত সেবারও বিচিত্র কথা উঠেছিল!
অমর একুশের গ্রন্থমেলা ২০২৫-এর পটভূমি ছিল একেবারেই ভিন্ন। মাত্র পাঁচ মাস আগে দেশে ঘটে গেল একটা গণ-অভ্যুত্থান। প্রাণহানি ঘটল শত শত মানুষের। দেশ পরিচালনা করছে একটি অন্তর্বর্তী সরকার। বলা যায়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। দেশ ও মানুষ স্থির নয়। দেশের সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও মানুষের মধ্যে আছে নানা কথা। এ অবস্থার মধ্যে একুশের গ্রন্থমেলা হয়ে গেল। মেলার মাসজুড়ে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটল। গ্রন্থমেলার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বলছে, ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৫১ লাখ মানুষের সমাগম ঘটেছে। এত মানুষের সমাগম! ভাবতে গেলেও অবাক লাগে!
শুধু তা নয়; আরও আছে। বলা যায় গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কারণ নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এবার ছিল না মেলার অন্যতম সহায়ক সংগঠন বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতির ঘোষিত কমিটি। বাংলাদেশের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই সৃষ্টি হয়েছে মেলা সংশ্লিষ্ট নতুন প্রতাপশালী শ্রেণি। তাদের অন্তর্ভুক্তির চাপ ছিল বাংলা একাডেমির ওপর। পুরোনো প্রতাপশালীদের রাখা হবে নাকি বাদ দেওয়া হবে, রাখলে কীভাবে রাখা হবে এসবেরও চাপ থাকার কথা বাংলা একাডেমির ওপর। এসব চ্যালেঞ্জ নিয়েই এবারের গ্রন্থমেলা হয়েছে বলে বাইরে থেকে অনুমান করছি। ফলে এবার কিছু নতুন কথার সূত্রপাত হওয়া অসম্ভব নয়। হয়েছেও বটে। কিন্তু আমি মনে করি, সম্ভাব্যতার তুলনায় কমই হয়েছে। বরং অধিকাংশ কথাই ওই ‘হাজার বছর ধরে’ গোছের পুরোনো। এসব কথার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পুরোনো হলেও প্রতিবারই নতুন ও জীবন্ত মনে হয়।
এবার বিশেষভাবে কথা হয়েছে গ্রন্থমেলার নিরাপত্তা নিয়ে। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় রাষ্ট্রের তরফ থেকে; বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে নয়। এবারের গ্রন্থমেলা যে অনেকটাই অরক্ষিত ছিল, এ কথা মিথ্যা নয়। তার মানে এই নয় যে, নিরাপত্তা বাহিনী বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। ছিল; বরং বিগত বছরের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। কিন্তু তা সংখ্যায়; তৎপরতায় নয়। পুলিশ বাহিনী প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। এই সুযোগে মেলায় ঢুকে পড়েছে ব্যাপকভিত্তিক হকার। যত্রতত্র দেখা গেছে ফুডকার্ট। এসব নিয়ে মানুষ নিন্দামন্দও কম করেনি। বেচারা বাংলা একাডেমি!
এত কিছুর ভেতরেও এবার মেলায় স্টল-বিন্যাস ভালো ছিল বলে মনে হয়। চলাচলের রাস্তা ছিল আগের চেয়ে প্রশস্ত। যদিও এবার গত বছরের চেয়ে প্রায় ১০০ স্টল বেশি ছিল। লিটলম্যাগ চত্বরটি ছিলে চোখে পড়ার মতো গোছানো ও পরিসরবান্ধব (যদিও একটা বড়সংখ্যক লিটলম্যাগ এবার স্টলে আসেনি। এর কারণ কি বাংলাদেশে লিটলম্যাগ কমে যাওয়া! নাকি অন্য কিছু!)। ঢোকার পথে ভিড় তুলনামূলক কম হয়েছে। কারণ, এবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের দিকেও প্রবেশপথের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রবেশপথ বিচিত্র হলেও সব পথ এসে মিশেছে বইয়ের কাছে। বই মানে বিচিত্র ধরনের বই। প্রতিবারই কথা ওঠে, কোন ধরনের বইয়ের কেমন কাটতি হলো এবারের গ্রন্থমেলায়? এবারও উঠেছে। পাই-টু-পাই হিসাব দেওয়া মুশকিল। তবে চোখ-কান খোলা রেখে যতটুকু বোঝা যায়, এবারের গ্রন্থমেলায় বহুল বিক্রীত বইয়ের তালিকার শীর্ষে থাকবে নতুন জেনারেশনের আগ্রহের বইয়ের জগতের মধ্যে। এদিক থেকে মোটিভেশনাল বই, নেটওয়ার্কিং, প্রোগ্রামিংয়ের বইসহ বিচিত্র পেশাগত দক্ষতাভিত্তিক বইয়ের কাটতি বরাবরের মতোই বেশি ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। পুরোনোদের ফিকশনের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের লেখা ফিকশনের স্টলগুলোতেও ভিড় ছিল লক্ষ করার মতো। ইসলামি বইয়ের বেচা-বিক্রিও শীর্ষের দিকে থাকবে বলে মনে হয়। তবে মননশীল লেখার প্রতি ঝোঁক বোধ করি দিন দিন বাড়ছে। এবং এই বাড়ার গতি ভবিষ্যতেও ঊর্ধ্বমুখী থাকবে বলে মনে হয়। কারণ, একটি জনগোষ্ঠী যখন চিন্তায় প্রকাশ করে, তখন মননশীল বইপত্রের কদর বাড়ে, বৈকি!
গ্রন্থমেলা নিয়ে নানা কথা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। হওয়াটাই স্বাস্থ্যপ্রদ বলে মনে করি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, বাংলাদেশের গ্রন্থমেলা বরাবর বাংলাদেশের মতোই হবে। এটি ফ্রাঙ্কফুর্টের গ্রন্থমেলা হবে না। দেখতে হবে আয়োজক প্রতিষ্ঠানের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে কি না। বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলাকে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার আমি পক্ষপাতী নই। গ্রন্থমেলার ওপর অতিরিক্ত ভাবগাম্ভীর্য ও আদর্শের আরোপণেও আমি আস্থাবান নই। বই একটি পণ্য। এটি সহজে এক জায়গায় পাওয়ার বন্দোবস্তের নাম গ্রন্থমেলা। গ্রন্থমেলা ঘিরে বিচিত্র মানুষ এখানে আসবে। পছন্দের সব বাংলাদেশি বই নির্দিষ্ট একটা পরিসরের মধ্যে পেয়ে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে বইপড়ুয়াদের জন্য দারুণ একটা ব্যাপার। আজকাল বইপত্র অনলাইনে সহজেই দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ঘরে বসেই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবু মানুষ গ্রন্থমেলায় দূরদূরান্ত থেকে আসে। এখানে আসার সঙ্গে সম্মিলিত হওয়ার আনন্দের একটা ব্যাপার আছে। গ্রন্থমেলায় মাসব্যাপী পাঠক, লেখক ও প্রকাশকের ত্রিবেণি সংগম ঘটে। এই ত্রিবেণি সংগমের আনন্দই গ্রন্থমেলাকে প্রাণবান করে তোলে। একই সঙ্গে এটিও সত্যি যে, বাংলা একাডেমির আয়োজনে হওয়া গ্রন্থমেলার আরেকটি গুরুত্বও আছে। সেই গুরুত্ব কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে তা একটি স্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছে।
এখানকার মানুষ ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমিকে তাদের সাংস্কৃতিক লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক মনে করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সাংস্কৃতিক বাতিঘর মনে করে এই প্রতিষ্ঠানটিকে। তাই এখানকার মানুষ চায় শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমির আয়োজনেই গ্রন্থমেলা হোক। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই হোক, এটাও চায়। এই চাওয়ার মধ্যে আবেগের আতিশয্য থাকতে পারে। কিন্তু এই আবেগেরও একটা মূল্য আছে বলে মনে করি।
অনেকে বলেছেন, অনেক কবি-সাহিত্যিক-পাঠক এবার গ্রন্থমেলায় আসেননি। এ জন্য বেচাবিক্রিও কিছতা কম হয়েছে বলে অনেকে আশঙ্কা করেছেন। অনেক কবি-সাহিত্যিক কেন আসেননি, তা হয়তো কারও অজানা নয়। যে কারণেই ব্যাপারটা ঘটুক না কেন, এতে মেলার সম্মিলনের সৌন্দর্য কিছতা হলেও ম্লান হয় বৈকি! রাজনৈতিক ময়দানের মতো মেলার ময়দানের মধ্যে গণতান্ত্রিক একটি পরিসরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ, বুদ্ধিবৃত্তির মাঠ ও মেলার মাঠ বরাবরই এই সৌন্দর্যের ঘাটতিতে ভুগেছে। এবারও বোধ করি তার ব্যতিক্রম হলো না। এ আমাদের সম্মিলিত দৈন্য বটে! সচ্ছল স্বাচ্ছন্দ্য, তুমি কবে আসবে!
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ