নিজস্ব প্রতিবেদক : দুই ছেলে থাকেন ঢাকায়। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে একাই থাকতেন ৬১ বছর বয়সী বিধবা নাদিরা বেগম। প্রতিবেশী এক তরুণ তার কাছে কিস্তি দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা ধার চেয়েছিল। টাকা দিতে অপারগতা জানান নাদিরা বেগম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় নাদিরা বেগমকে। এরপর তার ব্যবহৃত মোবাইল, গলায় থাকা স্বর্ণের চেইন আর কানের দুল খুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। কিন্তু পুলিশ মূল আসামি রাহিনুরকে গ্রেফতারের কথা জানালেও তার এক সহযোগীকে লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে মোবাইল বন্ধ ছিল দিনাজপুরের পার্বতীপুর থানার জাহানাবাদ কালেখাপাড়ার বাসিন্দা নাদিরা বেগমের।
ঢাকায় বসবাসরত ছেলে নাহিদ হাসান মায়ের মোবাইল বন্ধ পেয়ে জানান বোন নাছিমাকে। নাছিমা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে মায়ের কোনও হদিস না পেয়ে একদিন পর পার্বতীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৩৯৩) দায়ের করেন। ওই সাধারণ ডায়েরির সূত্র ধরে তদন্তে নামে থানা পুলিশ। সূত্র জানায়, নাদিরা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে স্থানীয় সফদার আলী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। সফদার আলীর কাছ থেকে নাদিরা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে সফদারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আটক করা হয় স্থানীয় রাহিনুর নামে আরেক যুবককে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাহিনুর দাবি করে, একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি দেওয়ার জন্য নাদিরা বেগমের কাছে সে ৫০০ টাকা ধার চেয়েছিল। কিন্তু নাদিরা বেগম ৫০০ টাকা না দেওয়ায় সে তাকে পেছন থেকে ধাক্কা মারে। এতে তিনি দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। এসময় নাদিরা বেগমের ব্যবহৃত ওড়না দিয়ে তার শ্বাসরোধ করে মৃতদেহ টেনে পাশের স্টোররুমে নিয়ে রাখে। পরবর্তীতে স্টোররুম তালাবদ্ধ করে চলে যায়।
রাহিনুরের বরাত দিয়ে পার্বতীপুর থানা পুলিশ জানায়, যাবার সময় নাদিরা বেগমের গলা থেকে একটি আট আনা ওজনের চেইন ও কানে থাকা স্বর্ণের দুল নিয়ে যায়। রাহিনুরের দাবি, সেই স্বর্ণের দুল ও মোবাইলটি স্থানীয় সফদারের কাছে ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পার্বতীপুর থানার এসআই সাহেব আলী জানান, তারা সফদারকে আটক করার পর তার কাছ থেকে নাদিরা বেগমের ব্যবহৃত মোবাইল ও কানের দুল উদ্ধার করে। এরপর রাহিনুরকেও আটক করা হয়। দুজনকেই আদালতে পাঠালে রাহিনুর দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পুলিশ কর্মকর্তা সাহেব আলী দাবি করেন, আদালতের পরামর্শে সফদারকে সাক্ষী হিসেবে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়। এজন্য সফদারকে মামলায় গ্রেফতার না দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, আইন অনুযায়ী চুরি-ডাকাতি বা লুটের মালামাল যার কাছে পাওয়া যাবে সেও অপরাধী। চোরাই মাল নিজের হেফাজতে রাখাটাও অন্যায়। এখানে সফদারও আসামি হওয়ার কথা। স্থানীয় পুলিশ কেন তাকে ছেড়ে দিলো তা বোধগম্য নয়। এছাড়া আসামি হিসেবে কাউকে আদালতে পাঠানোর সময় ফরোয়ার্ডিং লিখে পাঠাতে হয়। সেই ফরোয়ার্ডিংয়ে আসামি হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। কোর্টে গিয়ে জামিন ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে আসামিকে ছাড়ার নিয়ম নেই। মামলার বাদী ও তার স্বজনদের অভিযোগ, এলাকায় সফদার একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশ তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তাকে মামলা থেকে তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই ছেড়ে দিয়েছে।
আদালতে নিয়ে যাওয়ার পথে অর্থের বিনিময়ে সমঝোতা হয়েছে বলে তাদের ধারণা। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাহেব আলী দাবি করেন, ‘আমি আসামি বা বাদী পক্ষ কারও কাছ থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত খাইনি। আপনি খোঁজ নিতে পারেন। যা করা হয়েছে, তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এজন্য পার্বতীপুর থানার ওসি আব্দুস সালামের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। যোগাযোগ করা হলে পার্বতীপুর থানার ওসি আব্দুস সালাম প্রথমে সফদারের বিষয়ে সাফাই ভাষ্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। আব্দুস সালাম বলেন, সফদার সরল বিশ্বাসে মোবাইল কিনেছে। কানের দুলের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সফদার সরল বিশ্বাসে এসব কিনেছে বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু চোরাই মাল নিজের কাছে রাখাটা অপরাধ কিনা জানতে চাইলে তিনি আইনের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যস্ত বলে ফোন কেটে দেন তিনি। আলোচিত এই ঘটনার ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, নাদিরা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পরপরই প্রথমে সফদারকে মোবাইলসহ এবং পরবর্তীতে রাহিনুরকে আটক করা হয়। থানায় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতেই নাদিরা বেগমের লাশ যে স্টোররুমে রয়েছে তা জানতে পারে পুলিশ। কিন্তু পুলিশ আসামিদের ঘটনাস্থলে নিয়ে তাদের দেখানো মতে লাশ উদ্ধার না করে স্বজনদের বাসায় গিয়ে তালাবদ্ধ স্টোররুম চেক করতে বলে। পররর্তীতে লাশের সুরতহাল করে রাতেই ময়নাতদন্তের জন্য দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অপরদিকে থানায় দুই জন আসামি আটক থাকা অবস্থায়ও অজ্ঞাতনামা আসমিদের নামে এজাহার দায়ের করা হয়। আসামিরা যেন ভবিষ্যতে মামলা থেকে অব্যাহতি পান এজন্যই কৌশলে এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যার কাছে ভিকটিমের মোবাইল এবং কানের দুল পাওয়া গিয়েছে, তার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৪১৩ ধারা অনুযায়ী চার্জশিট হওয়ার কথা। এই ধারায় চোরাই মালামাল নিজের কাছে রাখার বিষয়ে শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়া তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করাও প্রয়োজন ছিল। পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, একমাত্র আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও মামলায় তা প্রমাণ করা কঠিন। মামলা প্রমাণ করতে বস্তুগত সাক্ষ্য প্রয়োজন। এজন্য যার কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করা হয়েছে, তারও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রয়োজন ছিল। কীভাবে তার কাছে মোবাইলটি এসেছে তা মামলা প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ। তাকে সাক্ষী বানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে সে মামলার শুনানিতে সাক্ষ্য নাও দিতে পারে। সেরকম কিছু হলে মূল আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারে।