প্রত্যাশা ডেস্ক: বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকাল ছয়টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের পক্ষ থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়।
রাজধানীর একটি হাসপাতালে আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যু হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবীর খান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আজ (মঙ্গলবার) ভোরে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আবদুল্লাহ আল নোমান। দ্রুত রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। আবদুল্লাহ আল নোমানের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে থাকা নুরুল আমিন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার ঢাকার একাধিক স্থানে কয়েক দফায় জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী শুক্রবার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানের গহিরায় আবদুল্লাহ আল নোমানের জানাজা হবে। এরপর তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা রয়েছে।
মঙ্গলবার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সমাবেশে প্রধান বক্তা থাকার কথা ছিল আবদুল্লাহ আল নোমানের। মৃত্যুর পর এ সমাবেশ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ আল নোমান মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে রাজনীতি করেন। পরে বিএনপিতে যোগ দেন জিয়াউর রহমানের সময়। আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার এক শোক বার্তায় নোমানকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণী নেতা হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ষাটের দশকের শুরু থেকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) সক্রিয় থেকে তিনি চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মৎস্য ও খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সব দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তিনি। নোমানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন মুহাম্মদ ইউনূস।
বাসসের খবরে জানা যায়, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এক শোকবার্তায় আবদুল্লাহ আল নোমানের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন আইন উপদেষ্টা। এতে তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এক শোকবার্তায় তিনি মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান একজন সদালাপী ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন বিনয়ী ব্যক্তিত্বকে হারাল।
বাম রাজনীতি থেকে বিএনপির শীর্ষনেতা: বড় ভাই ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। পরে তিনিও সেই সংগঠনে যুক্ত হয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্রজীবন শেষে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে সক্রিয় হন শ্রমিক রাজনীতিতে। গোপনে ভাসানীপন্থী ন্যাপের রাজনীতিতে জড়িত হন। একাত্তরের রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা ১৯৮১ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। এরপর একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারের মন্ত্রিসভায়।
চট্টগ্রামের বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সব দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তিনি। অর্ধশতাব্দীর বেশি তাঁর রাজনীতির বয়স।
চট্টগ্রামে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম নোমান। দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনীতির নেতৃত্বও ছিল তাঁর হাতে। মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলার প্রায় সব জায়গায় ছিল তাঁর নেতৃত্ব। এসব এলাকায় তাঁর অনুসারীরাই নেতৃত্বের আসনে থাকতেন সব সময়। তাঁকে ছাড়া চট্টগ্রামে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিও একসময় যেন ছিল অকল্পনীয়।
নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম নেওয়া আবদুল্লাহ আল নোমানের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল হারুন ছিলেন চট্টগ্রামে ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ষাটের দশকের শুরুতে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে নোমান যোগ দেন ছাত্র ইউনিয়নে। মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
ছাত্রজীবন শেষ করে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর হাত ধরে যোগ দেন শ্রমিক রাজনীতিতে। পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৭০ সালে তাঁকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধ শেষে আবারও ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের পর ১৯৮১ সালে যোগ দেন দলটিতে।
আবদুল্লাহ আল নোমান চট্টগ্রামের কোতোয়ালি আসন থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির হয়ে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৯১, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ২০০১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ১৯৯১ সালে তাঁকে সরকারের মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর বিভিন্ন মেয়াদে তিনি খাদ্যমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থানমন্ত্রী এবং বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
এক-এগারোর সময় বিদেশে ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। ফিরে আসার পর দলে কোণঠাসা হয়ে পড়েন; সঙ্গে যোগ হয় শারীরিক অসুস্থতা। সরকারবিরোধী আন্দোলনের চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণসমাবেশে দেখা যায়নি তাঁকে। প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামে বিএনপির বড় কোনো কর্মসূচিতে তাঁর অনুপস্থিতি তখন নেতা-কর্মী ও বিএনপির সমর্থকদের হতাশ করে।
নোমানের অনুসারী নেতা-কর্মীরা জানান, সরকার পতনের আন্দোলনের কর্মসূচিতে অসুস্থ শরীর নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন নোমান। তবে নানা কারণে তাঁর অভিমানও ছিল। তাঁর হাত ধরে রাজনীতিতে আসা অনেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ শীর্ষ পদে অবস্থান করলেও সেভাবে নোমানের মূল্যায়ন হয়নি দলে।
দীর্ঘদিন আবদুল্লাহ আল নোমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুস সাত্তার। তিনি মঙ্গলবার সকালে একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মেহনতি মানুষের নেতা ছিলেন নোমান ভাই। চট্টগ্রামসহ বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর শূন্যতা কখনো পূরণ হবে না। মাটি ও মানুষের এই নেতা মানুষের মনে থাকবেন অনন্তকাল।’
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে নগরের কাজীর দেউড়িতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল আবদুল্লাহ আল নোমানের। কিন্তু আর হয়ে ওঠেনি। এ জন্য সমাবেশ স্থগিত করা হয়েছে। আবদুল্লাহ আল নোমানের শূন্যতা দলে কখনো পূরণ হবে না।