আমীন আল রশীদ : ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো’- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের এই বক্তব্যটি একসময় নানাবিধ রসিকতার জন্ম দিয়েছিল। কেননা যখনই তাকে সাংবাদিকরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করতেন, তিনি তোতাপাখির মতো এই একই বুলি আওড়াতেন।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার রহস্য ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উন্মোচন করার কথা বলেও তিনি দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। কেননা, ওই ঘটনার পরে এক যুগ পার হয়ে গেলেও খুনিরা অধরাই রয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ পর্যন্ত সময় নিয়েছে ১১৫ বার। কোনো একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এতবার সময় নেয়ার ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সম্ভবত সারা পৃথিবীতেই বিরল।
গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশের মানুষের মনে পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, বিশেষ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার অন্তত দেশের মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তির বোধ তৈরি করতে পারবে বলে যে বিশ্বাস ও ভরসা তৈরি হয়েছিল- সেটি ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরে গত ছয় মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কোনো উন্নতি হয়নি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। ডাকাতি, ছিনতাই ও ধর্ষণের মতো ঘটনায় মানুষের মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনায় জনমনে এই প্রশ্নও তৈরি হয়েছে যে, সেনাবাহিনী বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে থাকার পরেও কী করে এই ধরনরে অপরাধ বাড়ছে বা কেন জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না?
যে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলো এবং যে শিক্ষার্থীদেরকে এই সরকারের ‘প্রধান স্টেকহোল্ডার’ বলা হয়, তারাও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন এবং সরকারের কড়া সমালোচনা করছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি দিনভর রাজধানীতে বিক্ষোভ করেছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এদিন রাতেই রাজধানীর বনশ্রীতে দুর্র্ধষ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণ ও টাকা লুট করে নেয়ার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত একটার দিকে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলে হলে গিয়ে মিছিল করে পরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হন। এ সময় মিছিল থেকে ‘এক দুই তিন চার, জাহাঙ্গীর গদি ছাড়’, ‘দফা এক দাবি এক, জাহাঙ্গীরের পদত্যাগ’, ‘মা বোনদের নিরাপত্তা দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’– ইত্যাদি স্লোগান দেওয়া হয়। পরদিন সোমবার সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগ দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাও।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মধ্যরাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। যদিও সেখানে তিনি অতীতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের মতো বিরোধীদের ওপর দায় চাপানো তথা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাইরে বের হতে পারেননি। তার অভিযোগ, আওয়ামী লীগের দোসররা পাচার করা টাকা এনে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। যারা এই ধরনের কাজ করছে তাদের ঘুম হারাম করে দেয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে তাদেরকেও শাস্তির আওতা আনা হবে বলে জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি আশ্বস্ত করেন, আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হবে। প্রশ্ন হলো, এই কথাটি বলতে তাকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হলো কেন? পাচার করা টাকা কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কারা দেশে নিয়ে আসছে, সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে? থাকলে সেগুলো জাতিকে জানানো দরকার। এই ইস্যুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যও জরুরি। সেটি অবশ্য অন্য তর্ক এবং অন্য আলোচনা।
বাস্তবতা হলো, যখন কোনো দেশ একটি অন্তর্বর্তী বা অস্থির সময় পার করে, একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে। বলা হচ্ছে, এতদিন যারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করতো, তাদের সেসব অবৈধ আয় বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং টাকা উপার্জনের পথ হিসেবে তারা ছিনতাইকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। আবার বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ তা প্রমাণ করার জন্য দেশে-বিদেশে যে ষড়যন্ত্র চলছে, তারাও নানাভাবে খেলতে পারে। অর্থাৎ অনেক কিছুই হতে পারে। যে কোনো কারণেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সেখানে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। স্যাবোটাজ হতে পারে। এমনকি নতুন কোনো প্লট তৈরির জন্যও পরিস্থিতি ঘোলা করার চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের মনে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করা। কিন্তু মুশকিল হলো, অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই এই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। ছয় মাসেও তারা মব থামাতে পারেনি। বরং তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হয়, তারাও মবকে ভয় পায়।
এই সরকারের আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করার মতো। সেটি হলো, কিছু ঘটলেই বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জ্ঞাপন। বিবৃতি দেয়া আর নিন্দা জানানো সরকারের কাজ নয়। বিবৃতি দেয় সুশীল সমাজ, যাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই। সুতরাং সরকার যখন বিবৃতি দিয়ে অঘটনের নিন্দা জানায় তখন বুঝতে হবে তারা এখনও সুশীল সমাজ আছে- সরকার হয়ে উঠতে পারেনি।
প্রশ্ন হলো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে বা দেশের মানুষের মনে শান্তি ও স্বস্তি ফিরবে? অপরাধীরা নির্মূল হয়ে যাবে বা ভয় পাবে? যদি ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করতে হয়,তাহলে এই সরকারের আরও একাধিক উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে হবে। বছরের প্রায় দুই মাস চলে গেলো, অথচ শিক্ষার্থীরা এখনও সব বই পায়নি। আমার মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। এখন পর্যন্ত সে সরকারি পাঠ্যক্রমের বই পেয়েছে মাত্র দুটি। এর মধ্যে শুরু হয়েছে ক্লাস পরীক্ষা। বইয়ের খবর নেই অথচ পরীক্ষা! শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এই ধরনের মকারির দায় নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার কি পদত্যাগ করা উচিত নয়?
আমাদের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, যিনি এই সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তিনি একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ। সৎ ও নির্লোভ মানুষ হিসেবে পরিচিত। জীবনের শেষবেলায় এসে এমন একটি দায়িত্ব নিয়েছেন যে, এখন তার সারা জীবনের অর্জন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। প্রশ্ন হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে শিক্ষার্থীদের বই ছাপানো এবং সময়মতো বই পৌঁছে দেয়া কি বেশি কঠিন? অন্যান্য উপদেষ্টাদের নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন আছে। সুতরাং লোম বাছতে গেলে কম্বল উজাড় হয়ে যাবে।
এটা ঠিক যে, তারা যে পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে সফল হওয়া কঠিন। কিন্তু এরকম কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যেরকম দক্ষ লোক প্রয়োজন ছিল, সবখানে সেরকম দক্ষ লোক বসানো হয়নি। শুধুমাত্র আন্তরিকতা আর ভালো মানুষি দিয়ে রাষ্ট্র চালানো যায় না। এটি একটি জটিল কাজ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেখানে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভেতরে প্রায় ২০ কোটি মানুষ বসবাস করে, সেই দেশটি চালানো চাট্টিখানি কথা নয়।
সুতরাং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেই যে রাতারাতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে যাবে- সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করলে সেটি ভবিষ্যতে যারা দায়িত্বে আসবেন, তাদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মনে সেই উপলব্ধিটা জাগ্রত হলে ভালো। তবে সেইসঙ্গে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে আটকে না থেকে ঘটনাগুলোকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার।
কথাসাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল ফেইসবুকে লিখেছেন: “যারা মাজার ভেঙেছে, শহীদ মিনার ভেঙেছে, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও ম্যুরাল ভেঙেছে, বাউল উৎসব পণ্ড করেছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করেছে, মেয়েদের ফুটবল খেলা বন্ধ করেছে, প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের কতলের ঘোষণা দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছে, তাদের একজনকেও গ্রেপ্তার হতে দেখেছেন? কিংবা সরকারকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখেছেন? না দেখেননি। কেন দেখেননি? কারণ, এই সন্ত্রাসীরা সরকারেরই লোক। তেমনই এখন যারা খুন-ধর্ষণ-ছিনতাই-ডাকাতি করছে তারাও সরকারেরই প্রিয়ভাজন। আপনাদের সরল মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে সরকার কেন দেশে অরাজকতা-অস্থিতিশীলতা রাখতে চাইবে?…এই ধরনের পরিস্থিতি থাকলে সরকার খুব সহজেই বলতে পারবে- দেশে নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতি নাই। জি, জাতীয় নির্বাচনকে বছর পাঁচেকের জন্য ঝুলিয়ে দেয়ার জন্যই এইসব খেলাধুলা চলছে।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদের প্রশ্নটাও প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন: “আর্মি দায়িত্ব নিয়েছিলো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার, ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ারও নিয়েছিলো। কিন্তু আর্মি কি করছে! এই ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার পেয়ে কত অস্ত্র উদ্ধার করেছে? কতজন আওয়ামী সন্ত্রাসী অ্যারেস্ট করেছে? কতজন চাঁদাবাজ-দখলদার অ্যারেস্ট করেছে? আর্মি সহযোগিতা করছে না, আর সব দোষ চাপানো হচ্ছে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপর! আর্মি প্রধান তো দায়িত্ব নিয়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা ঠিক করে দেয়ার, করছে না ক্যান!!! প্রশ্ন করেন।”…
আসুন আমরাও প্রশ্ন করতে থাকি। যদিও সব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে না।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট