নিজস্ব প্রতিবেদক: রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাত তিনটায় নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে সংবাদ সম্মেলন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সেখানে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসরেরা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন উঠেছে, গভীর রাতে কেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সংবাদ সম্মেলন ডাকতে হলো? সকালে ডাকলে কী সমস্যা হতো? কেউ কেউ বলছেন, গভীর রাতের সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা তো গতানুগতিক কথাই বলেছেন। এটাকে কেন জরুরি সংবাদ সম্মেলন বলা হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এই সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর পদত্যাগের দাবি ওঠার মধ্যে। সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিমুখে গণপদযাত্রা কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে।
এর আগে সারা দেশে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সোমবার বেলা একটার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে রাজু ভাস্কর্যে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, দেশে চাঁদাবাজরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তার মানে হলো, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের আগে রোববার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজধানীর ছিনতাইয়ের ঘটনার একটি ভয়ংকর ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, এক ব্যক্তিকে গুলি করে ও কুপিয়ে তাঁর ব্যাগ ছিনিয়ে নিচ্ছেন কয়েক ব্যক্তি। সোমবার সকালে পুলিশ জানিয়েছে, ভিডিওটি সঠিক এবং তা বনশ্রীর।
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ রোববার রাতে বলেন, ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তির নাম মো. আনোয়ার। তাঁর দোকান বনশ্রীর ডি ব্লকে। প্রতিদিন তিনি দোকান থেকে রাতে বাসায় ফেরেন। রোববার বাসায় যাওয়ার সময় তাঁকে তিনটি মোটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীরা ঘিরে ধরেন। এ সময় তাঁর কাছে থাকা স্বর্ণালংকার লুট করা হয়।
ওসি আতাউর রহমান আরও বলেন, মো. আনোয়ারকে লক্ষ্য করে ছিনতাইকারীরা গুলি ছোড়েন ও ছুরিকাঘাত করেন। তাঁর শরীরে গুলি ও কোপের চিহ্ন রয়েছে।
রামপুর থানা-পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, ওই ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ছিনতাইকারীরা তাঁর কাছ থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একই রাতে মোহাম্মদপুরে ছিনতাইয়ের আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। যদিও সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ওই ভিডিওর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। অনেকেই আতঙ্কের কথা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, মসজিদের মাইকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।
হাজারীবাগ থানার ওসি মো. সাইফুল ইসলাম সোমবার একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শংকরে আলী হোসেন কলেজের সামনে ১০ জনের মতো যুবক জড়ো হয়েছিলেন। সেটা দেখে স্থানীয় একটি মসজিদ থেকে ডাকাত পড়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দুই দিন আগে পুলিশের সঙ্গে একটি সভায় স্থানীয় মানুষকে অপরাধের আশঙ্কা দেখতে মাইকিং করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। তার অংশ হিসেবেই মাইকিং করা হয়, তবে অপরাধের কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আতঙ্কজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাত তিনটার দিকে রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচএসে নিজ বাসভবনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসরেরা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবেই হোক, এটা প্রতিহত করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টহল কার্যক্রম আরও বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আজ থেকে যেন কোথাও কোনো অপরাধ না ঘটে, তারা সে ব্যবস্থা নেবে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এই নির্দেশনা কার্যকর করতে না পারে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিনে দিনে আরও উন্নত হবে। অবনতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয়েছিল, তবে ১৬ আগস্ট সাখাওয়াত হোসেনকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করা হয় জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে।
নতুন সরকার যেসব ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এবং যেসব পরিস্থিতি উদ্বেগের, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম মনে করা হয় আইনশৃঙ্খলাকে। মানুষ এখন ছিনতাই ও ডাকাতির আতঙ্কের মুখে রয়েছেন। ভোরে ও রাতে অনেকে বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন। দিনের বেলা বাসে ডাকাতি ও নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটছে। কয়েক দিনে অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে।
কয়েক দিন ধরেই দেশের কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এবং অনেক সাধারণ জনতাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির প্রতিবাদ ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন।
এদিকে রাতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলন ডাকার পর কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাত তিনটার সময় যে সাংবাদিকেরা প্রেস কনফারেন্সে যাবেন, তাঁরা ঘড়ি, মোবাইল, মানিব্যাগ ও মাইক্রোফোন ইত্যাদি সাবধানে রাইখেন।’