আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা উপত্যকার পুরো জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে বের করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে তা আরব বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ট্রাম্প প্রশাসন এই প্রস্তাবকে পুনর্ব্যাখ্যা করে মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানায়, আরব দেশগুলো যদি ভালো কোনও পরিকল্পনা নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তা বিবেচনা করা হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত সপ্তাহে বলেছিলেন, এই সব দেশই বলে যে তারা ফিলিস্তিনিদের জন্য কতটা চিন্তিত।
যদি আরব দেশগুলোর কাছে ভালো কোনও পরিকল্পনা থাকে, তাহলে সেটাই ভালো। এখন, বেশ কয়েকটি আরব দেশের সরকার ঠিক সেই কাজটিই করতে চেষ্টা করছে। কূটনৈতিক সূত্র এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, মিসর, জর্ডান, সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধিরা গাজা উপত্যকার জন্য একটি বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন। তাদের প্রস্তাবে, আরব দেশগুলো গাজা পুনর্গঠনে অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু গাজাবাসীদের সেখানেই রাখা হবে এবং একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা বজায় রাখা হবে।
এই পাঁচ দেশের প্রতিনিধিরা আগামী শুক্রবার সৌদি আরবে এক বৈঠকে বসবেন এবং এরপর ৪ মার্চ কায়রোতে একটি বৃহত্তর সম্মেলনে অংশ নেবেন। দুই আরব কূটনীতিক, একজন সিনিয়র পশ্চিমা কর্মকর্তা এবং মেরিল্যান্ডের সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেনের বরাত দিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এই বৈঠকে মিসর হামাস থেকে মুক্ত ফিলিস্তিনি প্রযুক্তিবিদ ও স্থানীয় নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব করতে পারে, যারা যুদ্ধের পর গাজা পরিচালনা করবে। সিনেটর ভ্যান হোলেন বলেন, তাদের মূল লক্ষ্য হলো ট্রাম্প ও অন্যান্যদের দেখানো যে, হ্যাঁ, গাজা পুনর্গঠনের একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আছে, আমরা সেখানে সম্পদ বিনিয়োগ করব। তিনি আরও বলেন, তাদের ধারণা হলো, ট্রাম্প একজন রিয়েল এস্টেট বিশেষজ্ঞ, তিনি গাজা পুনর্গঠনের কথা বলেছেন।
তারা এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে চান, যা ট্রাম্পকে দেখাবে যে গাজাবাসীদের বের না করেও গাজা পুনর্গঠন করা সম্ভব এবং সেখানকার ২০ লাখ ফিলিস্তিনির জন্য একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যায়। কয়েক মাস ধরে মিসর একটি কারিগরি কমিটি গঠনের ধারণা প্রচার করে আসছে এবং এই বিষয়ে আলোচনা করতে ফিলিস্তিনি নেতাদের কায়রোতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। দশক ধরে আরব নেতারা গাজাসহ একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের দাবি করে আসছেন। এমনকি ইসরায়েলি সরকারও গত এক বছরের বেশি সময় ধরে গোপনে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, যুদ্ধের পর গাজায় আরব নেতাদের তত্ত্বাবধানের ভূমিকা পালনে তারা আপত্তি করবে না।
তবে এই পরিকল্পনাগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ইসরায়েলি নেতারা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথ প্রশস্ত করে এমন কোনও পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে, আরব নেতারা শুধু এমন একটি কাঠামো সমর্থন করবেন, যা অন্তত নামমাত্র হলেও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পথ তৈরি করে। এছাড়া, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সমর্থনও চাইছেন আরব নেতারা। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজা শাসন করত, কিন্তু প্রায় দুই দশক আগে হামাস সেখানকার নিয়ন্ত্রণ দখল করে নেয়। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এমন কোনও শাসন কাঠামো সমর্থন করতে অনিচ্ছুক, যা তাকে স্পষ্টভাবে গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেবে না। এই অবস্থান তাকে একটি কারিগরি কমিটির বিপরীত অবস্থানে নিয়ে গেছে। হামাস কর্মকর্তারা বলেছেন যে, তারা এমন একটি কমিটিকে নাগরিক বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু তারা তাদের সামরিক শাখা ভেঙে দিতে রাজি নয়। ইসরায়েল ও ট্রাম্প উভয়েই হামাসের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ চান।
রামাল্লাহভিত্তিক রাজনৈতিক গবেষণা সংস্থা হরাইজন সেন্টারের পরিচালক ইব্রাহিম দালালশা বলেন, আরব নেতাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এমন একটি বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা উপস্থাপন করা, যা ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে। এটি একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। এই পরিকল্পনার আরেকটি অনিশ্চিত বিষয় হলো, গাজায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং হামাসকে ইসরায়েলে হামলা করতে বাধা দিতে কাকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দীর্ঘমেয়াদে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অপারেশনাল স্বাধীনতা চান, কিন্তু এই ব্যবস্থা আরব নেতারা প্রকাশ্যে সমর্থন করতে চাইবেন না। কেউ কেউ আশা করছেন যে, মিসর ও পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের নিজস্ব সেনা প্রেরণ করবে। গত মাসে, মিসর একটি বেসরকারি মিসরীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে গাজার ভেতরে একটি চেকপয়েন্টে কাজ করতে অনুমতি দিয়েছে। কিছু কূটনীতিক ও বিশ্লেষক এই ব্যবস্থাকে একটি বৃহত্তর অপারেশনের প্রোটোটাইপ হিসেবে দেখছেন। তবে আরব নেতারা বৃহত্তর অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও বড় বাহিনী প্রেরণ করতে প্রস্তুত কিনা, তা স্পষ্ট নয়। এছাড়া হামাসও এই হস্তক্ষেপ মেনে নেবে বলে মনে হয় না।
মিসরের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড় অংশ হলো গাজা পুনর্গঠন করা এবং ফিলিস্তিনিদের মিসর ও জর্ডানে বের করে দেওয়ার পরিবর্তে সেখানেই রাখা। মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি গত রবির ওয়ার্ল্ড জিউইশ কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড লডার এবং জর্ডানের যুবরাজ হুসেইনের সঙ্গে বৈঠকে এই প্রস্তাবের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। মিসরের প্রেসিডেন্সির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আল-সিসি জর্ডানের যুবরাজের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূমি থেকে বের না করে গাজা উপত্যকা পুনর্গঠন শুরু করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এই পরিকল্পনার বিস্তারিত এখনও অস্পষ্ট। মিসরের সাবেক সামরিক জেনারেল সামির ফারাগ বলেন, মিসর আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরে গাজা পুনর্গঠনের জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানিকে আহ্বান জানাবে।
প্রথম ধাপে গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়ানো এবং ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা হবে, এরপর হাসপাতাল, স্কুল এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। তবে কে এই পুনর্গঠনের জন্য অর্থায়ন করবে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। ফারাগ বলেন, মিসর আগামী এক সম্মেলনে অন্যান্য আরব দেশগুলোর কাছে গাজা পুনর্গঠনে অর্থায়নের জন্য আহ্বান জানাবে। তবে এই ধরনের সম্মেলনের সময়সূচি নিয়েও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। মিসর প্রথমে ২৭ ফেব্রুয়ারিতে একটি জরুরি সম্মেলনের জন্য আরব নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু পরে তা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।