ঢাকা ০৩:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

  • আপডেট সময় : ০৬:৪৮:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ১৮ বার পড়া হয়েছে

পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই। রক্তের বিনিময়ে এ বাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। একঝাঁক থোকা থোকা নাম সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো অনেকের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার ভাষা, স্বকীয়তা এবং গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির নবতর উত্থান ও অভ্যুদয়ের দিন।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতির হৃৎপিণ্ড। বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মর্যাদায় উন্নীত করতে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেয়ার যে ইতিহাস বাংলার বীর সেনারা সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে আর এমন দৃষ্টান্ত নেই।
বুকের তাজা রক্তের আখরে সৃষ্টি বাংলাভাষা, সময় পরিক্রমায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের কথা, দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যারা পরাক্রমশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার সূর্য পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল। ওই বিজয়ের পিছনে ছিল কোটি কোটি মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ও অকুণ্ঠ সমর্থন। ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বহু রাষ্ট্র ও শান্তিকামী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা।
একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালিদের ঐক্য-চেতনার অগ্নিস্মারক। এই এক অবিনাশী, অনশ্বর-চৈতন্যের জ্যোতির্ময় শিখা। এ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, তা হলো অমর এ রক্তাক্ত একুশের বিশ্ব স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এবং তা ২০০০ সাল থেকে বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা নিয়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এ মহান কার্যাদি একদিনে সুসম্পন্ন হয়নি এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়, পৃথিবীর সব দেশের জনগণ প্রতি বছর এ নদীবিধৌত পলিমাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিত প্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে এবং আরও জানবে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের শহিদ ও মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ আজ পরম শ্রদ্ধার দেদীপ্যমান সারা বিশ্বের জনগণের কাছে। অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত শস্য-শ্যামল-সবুজের সমারোহে ভরা নয়ন জুড়ানো আমার সাধের বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষীর মানুষের গর্বে ধন্য ও প্রাণের সম্পদ। স্বাভাবিকভাবে একুশ আজ প্রতিটি বাঙালির অহঙ্কারের প্রতীক। একুশ প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালির গর্ব, সাহস ও প্রেরণার উৎস। ‘ইউনেস্কো’র সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের ফলে একুশ আজ গোটা বিশ্বের সম্পদে দাঁড়িয়েছে।
বাংলা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পঞ্চম ভাষা। আর আমাদের রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা। এ ভাষার প্রগতি, উন্নতি উৎকর্ষের জন্য কারও কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালি খুঁজে পায় নিজস্ব সত্তা। আর এর ফলেই বাঙালি লাভ করে স্বাধীন রাষ্ট্র। বিভিন্নভাবে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে বলা যায়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, সেগুলোর কি নিষ্পত্তি আজও আমরা করতে পেরেছি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য। কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরে? একুশের অন্যতম তাৎপর্য ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদি থাকবে না। এই মহৎ আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে কি? বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখার ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত প্রচেষ্টা কি দেখা যাচ্ছে সমাজে? চিন্তার দিক থেকে আমরা হব আন্তর্জাতিক: কিন্তু পরিচয়ে থাকব বাঙালি- এই ধারায় কি যাপন করছি জীবন? পরিশেষে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেই বীর শহিদ ও বীর সৈনিকদের- যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

আপডেট সময় : ০৬:৪৮:৫৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

পাকিস্তানিদের সৃষ্টি করা সাম্প্রদায়িকতা তাতে কোনো বাদ সাধতে পারেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সেদিন এক হয়ে একটিই প্রতিজ্ঞা করেছিল- মায়ের ভাষার সম্মান রাখবই, নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করবই। রক্তের বিনিময়ে এ বাংলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। একঝাঁক থোকা থোকা নাম সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো অনেকের জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার ভাষা, স্বকীয়তা এবং গৌরবোজ্জ্বল সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির নবতর উত্থান ও অভ্যুদয়ের দিন।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সংস্কৃতির হৃৎপিণ্ড। বাংলা আমাদের দেশমাতৃকা, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা বাঙালি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সবার মাতৃভাষা। এই ভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সব ধর্মাবলম্বীদের রয়েছে অবদান। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে মর্যাদায় উন্নীত করতে ত্যাগ করতে হয়েছে অনেক কিছু, দিতে হয়েছে লাখো প্রাণের তাজা রক্ত। মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দেয়ার যে ইতিহাস বাংলার বীর সেনারা সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে আর এমন দৃষ্টান্ত নেই।
বুকের তাজা রক্তের আখরে সৃষ্টি বাংলাভাষা, সময় পরিক্রমায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বন্যায় এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আব্রুর বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন এই বাংলাদেশ। সমগ্র জাতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতুলনীয় সাহস ও আত্মত্যাগের কথা, দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে যারা পরাক্রমশালী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার সূর্য পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল। ওই বিজয়ের পিছনে ছিল কোটি কোটি মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ও অকুণ্ঠ সমর্থন। ছিল ভারত ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বহু রাষ্ট্র ও শান্তিকামী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা।
একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাঙালিদের ঐক্য-চেতনার অগ্নিস্মারক। এই এক অবিনাশী, অনশ্বর-চৈতন্যের জ্যোতির্ময় শিখা। এ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, তা হলো অমর এ রক্তাক্ত একুশের বিশ্ব স্বীকৃতি। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান সংস্থা ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এবং তা ২০০০ সাল থেকে বাস্তবায়িত করার ব্যবস্থা নিয়ে বাঙালি জাতিকে বিশ্বে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। এ মহান কার্যাদি একদিনে সুসম্পন্ন হয়নি এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। আজ আমাদের হৃদয় গর্বে ভরে যায়, পৃথিবীর সব দেশের জনগণ প্রতি বছর এ নদীবিধৌত পলিমাটির মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক সমর্থনে সাধারণ মানুষ কতটা নিবেদিত প্রাণ ও দেশপ্রেমিক হতে পারে এবং কতটা আত্মত্যাগী হতে পারে এ বিষয়ে জানছে এবং আরও জানবে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার আর একাত্তরের শহিদ ও মা-বোনের ইজ্জত হারানো শাশ্বত এ বাঙালির রক্তের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ আজ পরম শ্রদ্ধার দেদীপ্যমান সারা বিশ্বের জনগণের কাছে। অসংখ্য নদ-নদী বিধৌত শস্য-শ্যামল-সবুজের সমারোহে ভরা নয়ন জুড়ানো আমার সাধের বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের প্রতিটি ভাষাভাষীর মানুষের গর্বে ধন্য ও প্রাণের সম্পদ। স্বাভাবিকভাবে একুশ আজ প্রতিটি বাঙালির অহঙ্কারের প্রতীক। একুশ প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাঙালির গর্ব, সাহস ও প্রেরণার উৎস। ‘ইউনেস্কো’র সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের ফলে একুশ আজ গোটা বিশ্বের সম্পদে দাঁড়িয়েছে।
বাংলা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পঞ্চম ভাষা। আর আমাদের রাষ্ট্রের একমাত্র ভাষা। এ ভাষার প্রগতি, উন্নতি উৎকর্ষের জন্য কারও কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালি খুঁজে পায় নিজস্ব সত্তা। আর এর ফলেই বাঙালি লাভ করে স্বাধীন রাষ্ট্র। বিভিন্নভাবে দেশ অনেকটাই এগিয়েছে বলা যায়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়, সেগুলোর কি নিষ্পত্তি আজও আমরা করতে পেরেছি? বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সত্য। কিন্তু তা কি চালু করা সম্ভব হয়েছে সর্বস্তরে? একুশের অন্যতম তাৎপর্য ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে অসাম্য, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের আধিপত্য ইত্যাদি থাকবে না। এই মহৎ আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটেছে কি? বাঙালির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, আবহমানকালের সংস্কৃতি ইত্যাদি সমুন্নত রাখার ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত প্রচেষ্টা কি দেখা যাচ্ছে সমাজে? চিন্তার দিক থেকে আমরা হব আন্তর্জাতিক: কিন্তু পরিচয়ে থাকব বাঙালি- এই ধারায় কি যাপন করছি জীবন? পরিশেষে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানাই সেই বীর শহিদ ও বীর সৈনিকদের- যারা এ ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন এবং লড়েছেন।