নিজস্ব প্রতিবেদক : শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের কুখ্যাত গোপন টর্চার সেল পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের একটা নমুনা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। গতকাল বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কচুক্ষেত, উত্তরা, আগারগাঁও এলাকায় বিগত সরকারের তিনটি গোপন কারাগার পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা। বিগত বছরগুলোতে শেখ হাসিনার সরকার ভিন্নমতের মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে এসব গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখে এবং নির্যাতন করে।
গোপন এসব কারাগার ভুক্তভোগীসহ দেশবাসীর কাছে ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত। আয়নাঘরে খাঁচার মতো জায়গায় যেখানে বন্দিদের আটকে রাখা হতো সেসব জায়গা ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা। পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের একটা নমুনা প্রতিষ্ঠা করে গেছে। অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, আমাকে নতুন করে বলতে হবে না। বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়—আয়নাঘরের ভেতরে খুবই বীভৎস দৃশ্য। এখানে মনুষ্যত্ববোধের কিছু নেই, যা হয়েছে তা নৃশংস। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটা কি আমাদেরই সমাজ? এটার কোনো ব্যাখ্যা নাই। যতটাই শুনি, অবিশ্বাস্য মনে হয়। যারা নিগৃহীত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে তারাও আমাদের সঙ্গে এসেছে, তাদের মুখেই শুনলাম। বিনা দোষে কতগুলো সাক্ষী নিয়ে, হাতে এক্সপ্লোসিভ ধরিয়ে দিয়ে কাউকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি বলে রাখা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের বিনা কারণে, বিনা দোষে উঠিয়ে আনা হতো। সন্ত্রাসী, জঙ্গি বলে এখানে ঢুকিয়ে রাখা হতো।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই রকম টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) সারা দেশজুড়ে আছে। ধারণা ছিল এখানে কয়েকটা আছে। এখন শুনছি বিভিন্ন ভার্সনে (সংস্করণে) সারা দেশজুড়ে আছে। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি। মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন বলছিলেন খুপরির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে। গুম-খুনের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সমাজ টিকবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা নতুন সমাজ গড়া, অপরাধীদের বিচার করা, প্রমাণ রক্ষার ওপর জোর দেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটা এখন প্রাধান্য। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।
অধিকার লঙ্ঘনকারীদের ‘জবাবদিহি’র আওতায় আনার আহ্বান
এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তার প্রেস অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। গত বছরের জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যা ও নির্বিচার গুলির একাধিক বড় অভিযান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ ও তদারকিতে হয়েছে বলে উঠে এসেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের এই প্রতিবেদনে।
২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ অগাস্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি নিয়ে তৈরি করা এ প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে। জেনিভায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্ক। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “শেখ হাসিনার শাসনামলে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার খাতে ‘কাঠামোগত ঘাটতি’ তৈরি হয়েছে। “আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারে, এজন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সকল ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে।” এসব প্রতিষ্ঠানের সবাইকে অধিকার সমুন্নত রাখতে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, “যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসুন।” বুধবার প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন বলে তাদের ধারণা। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং শটগানের গুলিতে হয়েছে। প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, ‘এই ধরনের ‘শটগান’ সাধারণত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে থাকে।
বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। জুলাই-অগাস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সংঘঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের মত ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন এবং বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও জড়িত ছিলেন বলে সেখানে তুলে ধরা হয়েছে।